‘পারিবারিক ব্যবসা থেকে আরএসআরএম-কে বহুজাতিক কোম্পানিতে রূপান্তর করতে চাই’
রতনপুর গ্রুপ (রতনপুর স্টিল রি রোলিং মিলস লিমিটেড)। যা সংক্ষেপে আরএসআরএম নামে পরিচিত।
মাকসুদুর রহমান এবং ইউনসু ভূইয়া এই দুই সহোদরের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় গ্রুপটি। যা এর আগে ১৯৬৫ সালে স্ক্র্যাপ ব্যবসার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল।
আরএসআরএম বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যেখানে ৮০০ কর্মী সরাসরি নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ৭০০ কোটি টাকা। মাকসুদুর রহমানের দুই ছেলে বিদেশ থেকে বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে বর্তমানে কোম্পানিটির হাল ধরেছে।
গত এক বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকার পর চলতি মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রচার সম্পাদক এবং প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধার মারজানুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যত পরিকল্পনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে।
কীভাবে আরএসআরএম প্রতিষ্ঠা পায়?
বাবা স্টিলের প্রধান উপাদান স্ক্রাপের ব্যবসা করতেন। স্ক্রাপ খাতে দীর্ঘদিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি প্রজেক্টের পরিকল্পনা করে। চিন্তা করেন একটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি সামাজিক কর্মকান্ড, মানুষের কর্মক্ষেত্র তৈরি এবং শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের চিন্তা করেন। এরপর তিনি ফেনী জেলার নিজ গ্রাম রতনপুরের নামে ১৯৮৬ সালে স্টিল ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৬ সালে স্টিলের কাঁচামাল বিলেট উৎপাদন শুরু করি। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আমাদের।
বর্তমানে আরএসআরএম-এর ব্যবসার অবস্থা কেমন?
আমরা দীর্ঘদিন ধরে রড উৎপাদন করে আসছি। বিদ্যুতের সাব স্টেশনের সমস্যার কারণে ২০২০ সালের আগস্ট থেকে আমাদের রড উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে দুটি সমস্যা রয়েছে, একটি হলো- বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত বিল এবং অপরটি হলো- সাব স্টেশনের টেকনিক্যাল সমস্যা। এই কারণে দুর্ভাগ্যবশত আমাদের উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে।
স্টিলে আমাদের অভিজ্ঞতা অনেক, আমরা সরকারের অনেক বড় প্রজেক্টে রড সরবরাহ করি। ইতোমধ্যে আমরা অতীত সমস্যাগুলোতে উত্তরণ হয়েছি এখন আমাদের মনযোগ হচ্ছে কিভাবে ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা উৎপাদন শুরু করবো।
আমরা এমন একটি ব্যবস্থা স্থাপন করেছি যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা ঘটার আগে অনুমান করতে পারি। এই সংকট থেকে আমরা তিনটি জিনিস শিখেছি- কী করতে হবে, কি করতে হবে না এবং কীভাবে অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
ব্যবসা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যায়। যাতে নতুন নতুন শেখার থাকে। নতুন ব্যবস্থাপনা কাস্টমারদের পুনরায় আস্থা ফেরার কাজ করছে।
কীভাবে ঘুরে দাড়াচ্ছে আরএসআরএম?
স্টিল ব্যবসায় আমাদের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা জানি একটি সংকট থেকে উত্তরণ পেতে হয়। গত চার দশকে আমরা অনেক উত্তান-পতন দেখেছি। সুতারাং আমাদের জানা রয়েছে সংকটের সময় কি করতে হয়। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সংকট মোকাবেলা করেছি।
করোনা অতিমারি কীভাবে মোকাবিলা করেছে আরএসআরএম?
আমরা দুটি সংকট মোকাবেলা করেছি। একটি হলো আমাদের নিজস্ব অপরটি হলো করোনা মহামারি। আমরা বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে বিল নিয়ে যে সমস্যা ছিল সেটা থেকে উত্তরণ করেছি। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের সমস্যা সমাধান করেছি। খুব শিগগিরই পুনঃউৎপাদন শুরু করছি।
করোনার সময় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে আমরা ঢেলে সাজিয়েছি। অতিরিক্ত মানব সম্পদ কমিয়েছি। করোনায় আমরা কীভাবে কাস্টমারদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হয় তা শিখেছি।
আরএসআরএম এর প্রধান পণ্যগুলো কী?
আরএসআরএম টিএমটি ৫০০ওয়াট, টিএমটি বার, ৬০ গ্রেড, ৪০ গ্রেডসহ সব কোয়ালিটির স্টিল ৮এমএম থেকে ৪০এমএম এর সব স্টিল বাজারজাত করে। আমাদের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে যেখান থেকে স্ক্র্যাপ পণ্য বের হয়। এসব স্ক্র্যাপ দিয়ে প্রথমে বিলেট ও পরে এমএস রডসহ সব কোয়ালিটির স্টিল তৈরি করে থাকি।
আরএসআরএম কোন খাতে ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে?
আমরা স্টিল সম্পর্কিত পণ্য উৎপাদনে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছি। যথাসময়ে আমরা এই কাজ করবো। বিশেষ করে এঙ্গেল, ক্যানেল এবং কাস্টমাইজড পণ্য নিয়ে খাতটি সম্প্রসারিত হবে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা নিয়েছি নির্মাণ কাজে সময় এবং ব্যয় সংকোচনে সহায়তা করবে এমন পণ্য নিয়ে আমরা কাজ করবো। খুব শিগগিরই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের সম্ভাবনা কেমন?
ইস্পাত সব খাতের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশের উন্নয়ন, জিডিপি বৃদ্ধি, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিকেন্দ্রিকরণ; সব কিছুই ইস্পাত ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকার অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, নাগরিকদের ভোগের সক্ষমতা বেড়েছে। ইস্পাত ব্যবহারের কারণে আগামী ২০-৩০ বছরে বাংলাদেশের ইস্পাতের বাজার বড় হবে। উন্নত এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশের ইস্পাত রপ্তানির বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী দশক বাংলাদেশের রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের বড় সুযাগ রয়েছে। কারণ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এমনকি চীনও আর ইস্পাত উৎপাদন করতে পারবে না। আফ্রিকার উন্নয়নের ফলে ইস্পাতের বাজার সম্প্রসারণ হবে। আমরা এই রপ্তানির সুযোগটা লুফে নিতে পারি।
সরকার পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ি বন্দরসহ অনেক বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের রপ্তানি ও আমদানি খাত সমৃদ্ধির জন্য এই বন্দরগুলো তৈরি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানুষকে থাকার ঘর তৈরি করতে হবে; বেশি মানুষের থাকার বাসস্থানের জন্য বর্তমানের ভবনগুলোকে বহুতল ভবনে রূপান্তর করতে হবে। কারণ দেশের ভৌগোলিক সীমানা সম্প্রসারণের কোন সুযোগ নেই। তাই আমাদের সম্প্রসারণ করতে হবে উপরের দিকে। যার জন্য ইস্পাতের প্রয়োজন।
আপনাদের কি রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে?
আমাদের পণ্য রপ্তানি করার লক্ষ্য রয়েছে। ভবিষ্যতে, আমরা দেখব কোন ধরনের স্টিলের চাহিদা বাড়ছে। শক্তির দক্ষতা, সবুজ স্টিল এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত। এসব বিষয় আফ্রিকা এবং উন্নয়নশীল দেশে রপ্তানি বাজার দখলে বড় ভূমিকা রাখবে। বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই আমরা নতুন পণ্য আনবো যেন রপ্তানির বাজার ধরতে পারি।
আরএসআরএম এর পণ্য কি লবাণাক্ততা সহিষ্ণু?
ইস্পাতের মরিচিকা ঠেকাতে আমরা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করি যেন ইস্পাত দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং লবণাক্ততা মোকাবিলা করতে পারে।
আপনার সম্পর্কে বলুন..
আমি ২০০৯ সালে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করি। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক থেকে ইঞ্জিয়ারিং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্নাতকোত্তর শেষ করি। আমি লন্ডন থেকে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার অব টয়োটা এবং এবারডিন স্টিল মিলস থেকে ইন্টার্নশিপ করি। এরপর ২০১২ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিয়ার হিসেবে আরেএসআরএম-এ যোগদান করি। এরপর আমি বিজনেস ডেভলাপমেন্ট এবং ব্যবসা পরিচালনায় পরিচালক হিসেবে কাজ করি।
এর আগে কোম্পানিটি ম্যানুয়ালি পরিচালনা হতো। পরবর্তীতে আমি এটা পরিবর্তন করি। বর্তমানে এটা ডিজিটালি পরিচালনা করা হয়। সব বিভাগে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) কার্যকর। এটি কার্য়কর করতে আমাদের তিন বছর সময় লেগেছে।
আপনি কেন ব্যবসায় আসলেন?
ব্যবসা অনেকের নেশা, অনেকের কাছে এটি অর্থ উপার্জনের উপায়। এমনকি অনেকে পারিবারিক ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যবসায় আসে। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল তাদের থেকে ভিন্ন। আমি পারিবারিক ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই একটি টেকসই পরিবেশবান্ধব কোম্পানি গড়ে তুলতে কাজ করছি। আমি এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি মালিক পক্ষের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না।
আরএসআরএমকে যেন নিজ গতিতে চলতে পারে, পরবর্তী ১০০ বছর আমাদের সন্তানদের ওপর নির্ভরশীল থাকা উচিত না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে, এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে হবে যেন সামনের বছরগুলো প্রতিষ্ঠানটি নিজ গতিতে চলতে পারে। পারিবারিক ব্যবসাগুলো এই স্টেরিওটাইপ ধারনা থেকে বের হয়ে আসা দরকার। আমি চাই, পারিবারিক ব্যবসা যোগ্য ও দক্ষ মানুষ দ্বারা পরিচালিত হোক। যেন এক সময়, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। আমার লক্ষ্য, আরএসআরএমকে বহুজাতিক করপোরেশনে রূপান্তর করা।
আপনি পারিবারিক ব্যবসায় না আসলে কী করতেন?
পারিবারিক ব্যবসায় না আসলে আমি পেশাদার প্রকৌশলী হতাম। আমি রিসাইক্লিং নিয়ে কাজ করতাম। কারণ আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর সব শক্তি একদিন শেষ হয়ে যাবে।
অবসরে আপনি কী করতে ভালোবাসেন?
আমি নিউজ পড়তে পছন্দ করি। দেশি-বিদেশি সব নিউজই আমি পড়ি। আমি একটি কোম্পানির বিস্তারিত এবং বায়োগ্রাফি পড়তে পছন্দ করি। তাছাড়া আমি সম্পাদকীয় পড়ি যেখানে বিভিন্ন মন্তব্যগুলো বুঝতে সহজ হয়।