বিচিত্রা: বাংলাদেশের সংবাদ জগতের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিল যে সাময়িকী
১৯৭২ সাল। আত্মপ্রকাশ করল একটি ম্যাগাজিন—সাপ্তাহিক বিচিত্রা। প্রথম সংখ্যার বেরোনোর পরপরই সাড়া ফেলে দেয় সাময়িকীটি। এ যেন 'Veni, Vidi, Vici'—'এলাম, দেখলাম, জয় করলাম'!
ম্যাগাজিনটি বাজারে আসে একেবারেই অভিনব স্লোগান নিয়ে—'সংস্কারমুক্ত না হলে বিচিত্রা পড়বেন না'!
স্লোগানটি যে স্রেফ বাগাড়ম্বর ছিল না, তা স্পষ্ট হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সংবাদপত্র জগতে একঝলক তাজা বাতাস নিয়ে আসে বিচিত্রা। বিষয়বস্তু, লেখা, মননশীলতা, আধুনিকতা—সবকিছুতেই সময়ের চেয়ে বহু এগিয়ে ছিল ম্যাগাজিনটি।
বিচিত্রার জন্মকথা
একেবারে জন্মলগ্ন থেকে পরের দীর্ঘ দুই দশক পর্যন্ত বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শাহরিয়ার কবির। পালন করেছেন সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব। তাই বোধকরি নির্দ্বিধায়ই বলা যায়, বিচিত্রার নাড়িনক্ষত্র তাঁর চাইতে ভালো খুব কম মানুষই জানেন। কাজেই বিচিত্রার সম্পর্কে জানার জন্য গত ৬ জুন ধরনা দিলাম তাঁর কাছে। তিনিও হতাশ করলেন না, খুলে বসলেন গল্পের ঝাঁপি।
শাহরিয়ার কবির জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দৈনিক বাংলা (স্বাধীনতার আগে দৈনিক পাকিস্তান) থেকে একটা সাময়িকী বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দৈনিক বাংলার তৎকালীন সংস্কৃতি বিভাগের সম্পাদক, বিশিষ্ট কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ইচ্ছা ছিল সংস্কৃতিবিষয়ক সাময়িকী করবেন। আর সেই সাময়িকী বের করার দায়িত্ব দিলেন বিশিষ্ট লেখক, সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরীকে।
দায়িত্ব পেয়েই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শাহাদত চৌধুরী। সম্পাদনা দলে নিলেন একঝাঁক টগবগে তরুণকে। শাহরিয়ার কবির, মাহফুজ উল্লাহ, চিন্ময় মুৎসুদ্দি, সাযযাদ কাদির প্রমুখ যুক্ত হলেন বিচিত্রার সঙ্গে। এই তরুণেরা প্রায় সবাই-ই পরবর্তীতে সাংবাদিকতা জগতের দিকপালে পরিণত হন।
যা-হোক, শাহাদত চৌধুরী একটা সংবাদ সাময়িকী করার মডেল দাঁড় করালেন, সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা না। এটা নিয়ে প্রথমে একটু দ্বন্দ্ব হলেও পরে দৈনিক বাংলার সম্পাদকমণ্ডলী শাহাদত চৌধুরীর প্রস্তাবই পছন্দ করেন।
আবির্ভাবেই আলোড়ন
সংবাদ সাময়িকী হিসেবেই ১৯৭২ সালের ১৮ মে আত্মপ্রকাশ করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা। প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলে দেয় ম্যাগাজিনটি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে কোথাওই বিচিত্রার আগে আর কোনো বাংলা সংবাদ সাময়িকী ছিল না। তবে সংবাদ সাময়িকী হলেও বিচিত্রায় কবিতা, গল্পসহ বইয়ের ওপর আলোচনাও ছাপা হতে থাকে।
আর ঠিক করা হয়, সাময়িকীটির প্রতি সংখ্যায় একটি প্রচ্ছদকাহিনি থাকবে। অবধারিতভাবেই প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনিতে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রচ্ছদকাহিনির শিরোনাম ছিল—'শেখ মুজিব নতুন সংগ্রাম'।
নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বৈচিত্র্যময় সব বিষয় নিয়ে লেখা হতো বিচিত্রায়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, খেলাধুলা, আন্তর্জাতিক ঘটনা—হেন বিষয় নেই যা নিয়ে বিচিত্রা প্রচ্ছদকাহিনি করেনি।
অভিনব সব বিষয়বস্তু সংবলিত ঝকঝকে চাররঙা প্রচ্ছদে ছাপা ম্যাগাজিনটি পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠতে বেশি সময় নেয়নি। ঋদ্ধ সম্পাদনা টিমের নেতৃত্বে এক ঝাঁক পোড় খাওয়া ও প্রতিভাবান নবীন সাংবাদিক-লেখক নানা বিষয়ে লিখতে থাকেন পত্রিকাটিতে। তাতেই হয় বাজিমাত।
পাঠকের ভালোবাসায় প্রচার সংখ্যায়ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে বিচিত্রা। শাহরিয়ার কবির জানালেন, সাময়িকীটির সার্কুলেশন সাধারণত ছিল ৭০ থেকে ৮০ হাজারের মধ্যে।
একসময় বিচিত্রার জনপ্রিয়তা এমনই তুঙ্গে পৌঁছে যে স্রোতের মতো বিজ্ঞাপন আসতে থাকে। এত বিজ্ঞাপনের স্থান সংকুলান করা যাচ্ছিল না। তখন বেশি বিজ্ঞাপনকে নিরুৎসাহিত করবার জন্য আমাকে ফি বাড়িয়ে দিতে হয়।
বিচিত্র, সাহসী সব বিষয়বস্তুর সম্ভার
প্রথম থেকেই দারুণ সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিয়ে সর্বশ্রেণির পাঠকের পাঠক্ষুধা মেটাতে থাকে বিচিত্রা। প্রচ্ছদকাহিনি হিসেবে বেছে নেওয়া হতো অভিনব, সাহসী, সমাজঘনিষ্ঠ সব বিষয়।
যেমন ১৯৭৮ সালে অ্যাবর্শন, অর্থাৎ গর্ভপাতের পক্ষে প্রচ্ছদকাহিনি করে ম্যাগাজিনটি। এছাড়া ১৭ এপ্রিল ১৯৯৬ সংখ্যায় ছাপা 'গোলাম আযম ও জামাতের রাজনীতি' শিরোনামের প্রচ্ছদ কাহিনি সারা দেশে আলোড়ন তোলে। এ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেছিলেন, 'একাত্তরে আমরা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে ভুল করিনি।' এ বক্তব্য ওই সময় সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। রাজাকারদের বিরুদ্ধে নতুন করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে মানুষ।
বেকারত্ব সমস্যাও উঠে এসেছে বিচিত্রায়। ১৯৭৭ সালের একটি সংখ্যায় বেকারত্ব ও চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে অভিনব এক প্রচ্ছদকাহিনি করে ম্যাগাজিনটি। ওই সময়ের বেকার তরুণদের মর্মান্তিক যন্ত্রণার চিত্র উঠে আসে এ প্রতিবেদনে।
বিচিত্রার ১৯৮৩ সালের ২৫ নভেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনির বিষয় ছিল নারী নির্যাতন বা ফেমিসাইড। ১৯৮৪-র অক্টোবরের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি ছিল 'ঢাকার ছবিতে সমাজচিত্র'। এ নিবন্ধে ঢাকাই ছবির মানের নিম্ন-গমন নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়। এ লেখার একটি অংশ রইল পাঠকদের জন্য:
'সরকারী প্রটেকশনে কতিপয় মেধাহীন রুচিহীন ব্যক্তি তস্করবৃত্তি করে যাচ্ছে। যারা দেশ জাতি ভাষা কোন কিছু সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেন না। ফলে চলচ্চিত্র আজ এক নতুন জগৎ তৈরি করেছে। এখন থেকে একশ বছর পরে যদি কেউ জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষিত চলচ্চিত্র দেখে, তারা বাঙালী জাতির এক অভিনব পরিচয় পাবেন। যেমন, বিংশ শতাব্দীর বাঙালীরা জরির পাশাক পরে বহু-হুঙ্কার সমেত অসি যুদ্ধ করত। বাঙালী নারীরা শাড়ি পরত বিহার প্রদেশের স্টাইলে, কুমারীদের পোশাক ছিল রাজস্থানবাসী তরণীদের মত। (আঁখি মিলন ও বানজারন, সওদাগর, রাজসিংহাসন ইত্যাদি ছবিগুলো স্মরণ করা যেতে পারে)। এদেশে বাঁশী বাজালেই সাপ পাহাড়-পর্বত, সাগর, নদী-খাল-বিল অতিক্রম করে চলে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভূগোলবিদরা সমস্যায় পড়ে যাবেন বাংলাদেশে যত্রতত্র পাহাড়ি ঝরণা ছিল অথবা সর্বত্র বাস করতো ভূত-প্রেত বিশ্বাসী আদিবাসীরা। পরচুলাধারী নায়করা বোতলের পর বোতল মদ পান করে কুংফু, কারাতের নামে কাট-টু-কাট লম্ফঝম্ফ।'
আমলাদের দৌরাত্ম্য নিয়েও প্রচ্ছদকাহিনি করেছে বিচিত্রা। ১৯৮৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি করা হয় আমলাতন্ত্র নিয়ে। শিরোনাম—'আমলাতন্ত্র বনাম জনগণ'। এ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে বলা হয়: '…অস্বীকার করার উপায় নেই, আমলারা শাসক। প্রশাসনের তারা শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। তারাও ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের "অপর পক্ষ" ভাবতে ভালোবাসেন। এবং প্রশাসনের কেতাবী বিধান পড়ে তারা হয়েছেন আমলা। সে বিধান লেখা হয়েছে অনেক আগে। আমলার ফাইল চলে কিংবা হিম হয়ে যায় কেতাবী বিধানে অথবা ব্যক্তি স্বার্থে। বিধানকে জনমুখী করতে হবে বলে বার বার বলা হয়েছে।'
দেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি ও নৈরাজ্য নিয়ে বিচিত্রায় ১৯৮৭ সালে একটি প্রচ্ছদকাহিনি হয়। ম্যাগাজিনটির ৩১ মার্চ ১৯৮৯ সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি ছিল 'নকলের দৌরাত্ম্য' নিয়ে। ওই বছরের ৩ মার্চ সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি ছিল ডাকসু নির্বাচন ঘিরে সংঘটিত সহিংসতার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন নিয়ে।
১৯৯১ সালের ১৪ জুন সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি ছিল খেলাপি ঋণ নিয়ে। ওই বছরেরই ডিসেম্বরের একটি সংখ্যায় এক অভিনব বিষয় নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি করে পত্রিকাটি। বিষয়বস্তু—ঢাকা শহরের মাজার এবং এসব মাজারকে ঘিরে চলা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে অসাধু শ্রেণির ব্যবসা।
ওই সংখ্যা থেকে জানা যায়, 'ঢাকা নগরের ব্যস্ত সড়ক, বাণিজ্যিক এলাকায়, রেলস্টেশনে, বাস স্টপেজে, রাস্তার পাশে ফুটপাতে রয়েছে দুই শতাধিক মাজার। এই মাজারকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এক শ্রেণীর সমাজ বিরোধী লোকের আস্তানা। তারা মাজারের পবিত্রত নষ্ট করছে বার বার। এদের সম্পর্কে প্রশাসনও নীরব। কারণ, সমাজের একটি শক্তিশালী মহল মাজার নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। তারা ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি ব্যবহার করছে মাজার ব্যবসার উপাদান হিসাবে। বেশির ভাগ মাজার গড়ে উঠেছে সরকারী জমির ওপর। দানবাক্স বদলিয়ে ধর্মের নামে, ওরশের নামে উপার্জন করা হচ্ছে টাকা, পথযাত্রী-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তোলা হছে চাঁদা। কিন্তু এ টাকা কোথায় যায়, কেউ জানে না।'
এছাড়া ১৯৯৬ সালের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনির শিরোনাম ছিল 'চাকরির খোঁজে কম্পিউটার জেনারেশন'। এ নিবন্ধের এক জায়গায় বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে লেখা হয়েছে, 'রাষ্ট্র এখন সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে সুখী করতে পারছে না। পারছে না তার চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে এসব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান দেখতে হবে উদার দৃষ্টিতে এবং এদের উদ্যোক্তাদের পথের বাধা দূর করতে হবে। আজকের প্রজন্ম নিজেরাই তৈরি করে নেবে তাদের চাকরির ক্ষেত্র।'
১৯৯৬ সালের ওই সংখ্যাতেই ছাপা হয় ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন নেতা আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার। সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক বলেন, ''৭১-এ আমগো অবস্থান ছিল নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে।' ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও দাবি করেন, মঙ্গলগ্রহে যাওয়া তার জন্য মামুলি কাজ—'চাঁদে যাওয়া, মঙ্গল গ্রহে যাওয়া এইগুলা বড় কোনো কাম অইল নাকি? এইডা তো একটা পিকনিক, হেঃ হেঃ। আপনারা যেমন দল বাইধা পিকনিকে যান, এইডাও ঐরকমই।'
এরকমই নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তু নিয়ে সাজানো হতো বিচিত্রার একেকটি সংখ্যা। আর পাঠকও এসব লেখা রীতিমতো লুফে নিত।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিপ্লব
শুধু অভিনব, বৈচিত্র্যময় লেখা দিয়েই পাঠকের মন জয় করেনি বিচিত্রা, ম্যাগাজিনটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও পথ দেখিয়েছে দেশের সংবাদ জগতকে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে কম্বোডিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম, ইরান, পাকিস্তান ঘুরে প্রতিবেদন করেছেন সাময়িকীটির সাংবাদিকরা।
শাহরিয়ার কবিরের মুখ থেকেই শোনা যাক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে কীভাবে পথ দেখিয়েছে বিচিত্রা: 'ধরুন, তখন কম্বোডিয়াতে বিপ্লব হয়ে গেল। কম্বোডিয়াতে যেহেতু কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছে, এবং সেখানে কমিউনিস্ট সরকার এসেছে—খেমাররুজ—মাহফুজ উল্লাহকে আমরা কম্বোডিয়া পাঠিয়ে দিলাম।
'তারপর ইরানে খোমেনির বিপ্লব হচ্ছে। শাহাদত চৌধুরী ইরানে চলে গেলেন ইরান বিপ্লব নিয়ে লেখার জন্য। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন হচ্ছে; তখন আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ইস্ট ইউরোপে প্রতিবেদন করার জন্য। সারা ইউরোপ ঘুরে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেচ ওয়ালেসার—সমাজতন্ত্র ভেঙে যিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন; পোল্যান্ডের—তাঁর ইন্টারভিউ করি।
'এক একটা কাভার স্টোরির পেছনে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, সেই সময়ে। পুরো ট্রিপের খরচ পত্রিকা বহন করছে। …এগুলোর ব্যয় বিচিত্রা বহন করতে পেরেছে; কারণ হিউজ প্রফিট আমরা আর্ন করছি।'
শাহরিয়ার কবির জানালেন, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন থেকে মোটা লাভ পেত বিচিত্রা। আর সেই লাভের পুরোটাই ব্যয় করা হতো পত্রিকা ও সাংবাদিকতার মানোন্নয়নের জন্য।
১৯৯১ সালের বিচিত্রার ৩ মে সংখ্যায় পাকিস্তানে বাংলাদেশি নারী ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সাংবাদিক বেবী মওদুদ পাকিস্তানে গিয়ে দেখেছেন সেখানে আটকা পড়েছেন অসহায় বাংলাদেশি নারী। বিচিত্রা জানাচ্ছে, 'পাকিস্তান, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে, কারাগারে এবং পরিচারিকা রূপে গৃহের অভ্যন্তরে দুঃসহ জীবন যাপন করছে বাংলাদেশের অসহায় নারীরা। বিদেশী পত্রিকার সূত্রে জানা গেছে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি নারী এই সব দেশে পাচার হয়েছে।'
এছাড়া দেশে সর্বপ্রথম সরেজমিন ঘুরে ঘুরে যুদ্ধাপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করেন বিচিত্রার সাংবাদিকেরাই। যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিচিত্রা। পত্রিকাটির সাংবাদিকদের সংগ্রহ করা তথ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-আলামত হিসেবে কাজে লাগে।
শুধু তা-ই নয়, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর ব্যাপারে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে বিচিত্রা। দুর্নীতি, চোরাচালান, শিশু ও নারী পাচার, নারী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে একের পর এক প্রচ্ছদকাহিনি করে। এসব প্রতিবেদন আলোড়ন তুলেছে সমাজে।
বিচিত্রার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যে শুধু আলোড়ন তুলত তা-ই নয়, এসব প্রতিবেদনের ধাক্কায় অনেকবারই নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও পরিবর্তন এসেছে।
যেমন ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে শাহরিয়ার কবির একটি প্রচ্ছদকাহিনি করেন সিলেটের চা বাগানের শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে। ওই সময় ফিনলে, লিপটন প্রভৃতি বিদেশি কোম্পানি ছিল দেশে। বিচিত্রার প্রচ্ছদকাহিনি বেরোবার পর সেই প্রতিবেদন ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে চলে গেল ব্রিটেনে। এর ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলো বেশ কিছু সংস্কার আনতে বাধ্য হয় চা শ্রমিকদের জীবনযাপনের মান উন্নয়নের জন্যে।
আরও যত কিছুর পথিকৃৎ বিচিত্রা
সাপ্তাহিক বিচিত্রা বহু বিষয়ই 'প্রথম' পরিচয় বা প্রচলন করেছে এদেশে।
প্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশের মাধ্যমে ভারতীয় বইয়ের একচেটিয়া বাজারের অবসান
ফি বছর ঈদ উপলক্ষে দেশের প্রায় সমস্ত জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিন যে ঢাউস আকারের ঈদসংখ্যা বের করে—এবং সেই ঈদসংখ্যায় ৬-৭ জন প্রথিতযশা লেখকের উপন্যাস ছাপা হয়—তার শুরুটা কে করেছিল বিচিত্রা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বইয়ের বাজারে ছিল ভারতের বইয়ের একচেটিয়া দাপট। বাংলাদেশের বইয়ের বিক্রি তখন তলানিতে। এমন প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের লেখকদের জনপ্রিয় করবার জন্য বিচিত্রা নিয়ে আসে ঈদ সংখ্যার ধারণা। দেশের বিশিষ্ট লেখকদের মোটা অঙ্কের সম্মানী দিয়ে তাঁদের সেরা লেখা নিয়ে আসা হয় বিচিত্রায়।
বাংলাদেশের লেখকদের লেখা নিয়েও যে ঢাউস সাইজের ঈদ সংখ্যা বের করা যেতে পারে, এই চিন্তা বিচিত্রার আগে আর কোনো সংবাদমাধ্যমের মাথায়ই আসেনি। স্বল্পমূল্যে সম্পূর্ণ ৬-৭টি উপন্যাস পড়ার এমন অভূতপূর্ব সুযোগ করে দেওয়ায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যায়। পাঠক রীতিমতো লুফে নেয় এ সুযোগ। হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন প্রমুখের মতো প্রথিতযশা লেখক ছিলেন বিচিত্রার ঈদ সংখ্যার নিয়মিত মুখ।
সংস্কৃতি ও ফ্যাশন জগতে বিচিত্রা-বিপ্লব, দেশীয় তাঁতশিল্প রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা
ফ্যাশন জগতেও বিচিত্রা মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই ভারতীয় শাড়িতে বাংলাদেশ সয়লাব যায়। তার দাপটে হারিয়ে যেতে বসে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প। কারণ বাংলাদেশের কাপড়ের দাম ভারতীয়দের তুলনায় বেশি।
ভারতীয় কাপড়ের আধিপত্যের অবসান ঘটানোর জন্য ওই সময় বিচিত্রা শুরু করে ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা। এ আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বড় বড় ডিজাইনাররা। তাঁদের ডিজাইন করা শাড়ি পরিয়ে মডেলদের সাজিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো।
এ প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর থেকে বদলে যেতে থাকে ফ্যাশনের ট্রেন্ড। বিচিত্রার এসব ফ্যাশন প্রতিযোগিতার ছবির অ্যালবাম দেখে পোশাক কিনতে শুরু করে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে দেশীয় বুটিক শিল্প। বিচিত্রা মধ্যবিত্তের রুচি তৈরিতে বড় ভূমিকা তো রাখলই, দেশীয় বস্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা ছিল ম্যাগাজিনটির।
ইয়ারবুক ও রেফারেন্স লাইব্রেরি
এছাড়া বিচিত্রার আরেকটি অভিনব কাজ হলো ইয়ারবুক বের করা। প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে—রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ক্রীড়া সমস্ত ক্ষেত্রের—আগের বছরের সালতামামি করা হতো। সব বিষয়ে সারা বছর কী হয়েছে-না-হয়েছে সেসবের খতিয়ান থাকত ইয়ারবুকে।
এর ফলে বিচিত্রার এই ইয়ারবুকগুলো দারুণ রেকর্ড হিসেবে থেকে গেল। গোটা বছরের ঘটনাপ্রবাহ মোটামুটি আন্দাজ করা সম্ভব বিচিত্রার ইয়ারবুকে চোখ বোলালেই।
এছাড়া একটা বড় রেফারেন্স লাইব্রেরি গঠন করেছিল বিচিত্রা। পত্রিকা অফিসে যে একটা রেফারেন্স লাইব্রেরি থাকা দরকার—এই চিন্তাও বিচিত্রার আগে অন্য কোনো সংবাদপত্র ভাবতে পারেনি।
বিদায়
দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, পাক্ষিক আনন্দ বিচিত্রা ও বাংলাদেশ টাইমস নিজস্ব আয়েই চলত। অর্থাৎ পত্রিকাগুলো লাভে ছিল, সরকার থেকে ভর্তুকি নিতে হতো না।
তবে ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই ছিল সরকারের মালিকানাধীন কোনো পত্রিকা রাখা হবে না। ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা-টাইমস ট্রাস্ট বিলুপ্ত করে বিচিত্রাসহ উপরোল্লিখিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিন পত্রিকা ও সাময়িকীর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
চারটি পত্রিকার কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদেরকে 'গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে'র মাধ্যম অর্থকড়ি মিটিয়ে তৎক্ষণাৎ বিদায় করে দেওয়া হয়। এভাবেই থেমে যায় বিচিত্রার তিন দশকের বর্ণাঢ্য পথচলা। দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমসের ভবন হস্তান্তর করা হয় কর্মসংস্থান ব্যাংকের কাছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাময়িকী হওয়ায় বিচিত্রায় লেখালেখির ব্যাপারে নানা রকমের বাধ্যবাধকতা তো ছিলই। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের বাধা এসেছে। মামলাও হয়েছে বিচিত্রার বিরুদ্ধে।
কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেও মান ধরে রেখে দারুণ সাহসী সব প্রতিবেদন ছেপে গেছে পত্রিকাটি। বিষয়বস্তু, লেখা, মননশীলতা, আধুনিকতা—সবকিছুতেই সময়ের চেয়ে বহু এগিয়ে ছিল এই ম্যাগাজিনটি। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত কাল পর থেকে গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সময়কে ধরে রেখেছে বিচিত্রা। বাংলাদেশের ওই সময়ের চেহারা সম্পর্কে কেউ ধারণা পেতে চাইলে, বিচিত্রার পুরোনো সংখ্যাগুলো তার জন্য হতে পারে আকরগ্রন্থ।