আমানত শাহ থেকে মিয়া: অনলাইন-যাত্রা শুরু বাংলাদেশের এ লুঙ্গি জায়ান্টের
সবচেয়ে আটপৌরে পোশাক কোনটি, এ প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ বাঙালি পুরুষ নির্দ্বিধায় বলবেন, 'লুঙ্গি'। বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় আরামের জন্য লুঙ্গি অদ্বিতীয়। আর গত ১৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের একদল কারিগর পরিবার সবচেয়ে সেরা মানের লুঙ্গি তৈরি করে বাঙালির আরাম নিশ্চিত করে আসছে।
বাংলাদেশে উন্নতমানের লুঙ্গি আর আমানত শাহ গ্রুপ যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। বিশ্বের প্রায় ১৮টি দেশে বিশাল সংখ্যায় লুঙ্গি রপ্তানি করে এ গোষ্ঠীটি। লুঙ্গী শিল্পে এ গোষ্ঠী এখন অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠেছে। লুঙ্গিকে পুনরায় জনপ্রিয় করে তুলতে সাহায্য করেছে আমানত শাহ গ্রুপ। পেয়েছে দেশে-বিদেশের নানা পুরস্কারও।
এবার নতুন স্বপ্ন নিয়ে অনলাইনেও ব্যবসায় শুরু করেছে গোষ্ঠীটি।
আমানত শাহ লুঙ্গির উত্থান
'রূপসদী ক্লোথ স্টোর' দিয়ে ছোটখাটোভাবে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে বাংলাদেশের লুঙ্গি বাজারের শীর্ষে অবস্থান; ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আমানত শাহ লুঙ্গি বাজারে সবসময় নতুন নতুন 'ট্রেন্ড'-এর আগমন ঘটিয়েছে।
আজ থেকে ১৩০ বছর আগে লুঙ্গি বিক্রি করা একটি টেক্সটাইল শিল্প থেকে উত্থান ঘটেছিল বর্তমান তৃতীয় প্রজন্মের এ পারিবারিক ব্যবসায়।
আগেকার দিনে লুঙ্গি সেলাই ছাড়া কেনা হতো। মানুষ বাড়িতে নিয়ে সেলাই করে তারপর লুঙ্গি পরত। বাংলাদেশে আমানত শাহ ব্র্যান্ড প্রথমবারের মতো সেলাই করা লুঙ্গির সূচনা করে।
১৯৭০-এর দশকের আগে ব্র্যান্ডের নাম বা দামের ট্যাগ ছাড়া লুঙ্গি বিক্রি হতো। এরপর মেসার্স হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স'র (আমানত শাহ লুঙ্গির মূল কোম্পানি) মোহাম্মদ হেলাল মিয়া প্রতিটি ক্যাটাগরির লুঙ্গির জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম ও প্রাইস ট্যাগের প্রচলন ঘটান। তারপর থেকে লুঙ্গি শিল্প তার দেখানো নিয়ম অনুসরণ করতে শুরু করে।
এতকিছু থাকতে লুঙ্গি কেন?
'লুঙ্গির পছন্দ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়নি। মোগল সাম্রাজ্যের সময়কার বাংলাতেই তাঁতশিল্প ছিল। আমার স্বপ্ন ছিল ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নতুন প্রজন্ম লুঙ্গিকে প্রায় পরিত্যাগ করেছিল। কিন্তু তাদের কাছে নিজেদের এ ঐতিহ্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছি। এ জন্য আমি গর্বিতও,' বলেন আমানত শাহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হেলাল মিয়া।
তিনি মনে করেন তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে লুঙ্গির রং, বয়ন, নকশা, অলঙ্করণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- তুলার বিশুদ্ধতা।
কোনো একসময় লুঙ্গিকে কেবল গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত সেকেলে পোশাক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে লুঙ্গির জনপ্রিয়তায় এক ধরনের পুনরুত্থান ঘটেছে।
'লুঙ্গির ব্যবসায় এখন দারুণ, কারণ দেশের শহুরে তরুণদের ঘরে পরার জন্য লুঙ্গিকে বেছে নেওয়ার হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বাইরে লুঙ্গির চিরায়ত ব্যবহার তো রয়েছেই।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, গড়ে দেশের কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানুষ বছরে কমপক্ষে দুইটি লুঙ্গি পরে। এতে করে লুঙ্গির বাজার ১৫০০-২০০০ কোটিতে পৌঁছেছে,' বলেন হেলাল মিয়া।
তবে এ ব্র্যান্ডটিকেও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সুতার দাম বৃদ্ধি, দক্ষ শ্রমিক ও গ্যাস-বিদ্যুতের মতো সুবিধার অভাব ইত্যাদি।
তবে এসবের মধ্যেও হেলাল মিয়া কিছু আশার ঝিলিক দেখছেন। 'আসলে প্রতিবন্ধকতা হলো সকল সাফল্যের মূল। আমরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি,' বলেন তিনি।
তিনি বিশ্বাস করেন তাদের এ সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকার সাহায্য করতে পারে। তার মতে, সরকার যদি রং ও রাসায়নিক পদার্থের আমদানি করের ওপর ভর্তুকি দেয়, তাহলে উৎপাদন খরচ কমে যাবে।
'স্থানীয় চাহিদা মেটানো ও রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখার জন্য লুঙ্গি উৎপাদন এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের দিক থেকে অন্যান্য লজিস্টিক্যাল সুবিধাগুলো দেওয়া উচিত,' বলেন হেলাল মিয়া।
লুঙ্গি রপ্তানিতে সাফল্যের জন্য আমানত শাহ গ্রুপ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি প্রেসিডেনসিয়াল অ্যাওয়ার্ড ও দুইটি জাতীয় রপ্তানি ট্রফি। এছাড়া গোষ্ঠীটি সাতবার সিআইপি অ্যাওয়ার্ড ও ১৬ বার ডিআইটিএফ পুরস্কার জিতেছে।
বর্তমানে আমানত শাহ লুঙ্গির চারটি কারখানায় প্রায় ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। এসব কারখানায় শতভাগ তুলা ও মিশ্র-সুতার লুঙ্গি উৎপাদন করা হয়। হেলাল জানান, 'আমাদের একটি করে ডাইয়িং ইউনিট, বয়ন প্রক্রিয়াকরন ইউনিট, স্পিনিং ইউনিট, ও ফ্যাব্রিক ইউনিট রয়েছে। সবমিলিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন স্তরে প্রায় ২৫ হাজারের মতো মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন।'
লুঙ্গির ভবিষ্যৎ
বর্তমানে আমানত শাহ গ্রুপের হাল ধরছে নতুন প্রজন্ম। মোহাম্মদ হেলাল মিয়ার ছেলে রেজাউল করিম নিজের পড়ালেখা শেষ করে কোম্পানিতে গ্রুপ ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেছেন।
"আমার স্বপ্ন হচ্ছে সারাবিশ্বে 'লুঙ্গি' সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া। আমি চাই দেশে ও দেশের বাইরে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এ ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি পৌঁছে দিতে। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে লুঙ্গির ঐতিহ্য নিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করাও আমার লক্ষ্য," বলেন রেজাউল করিম।
বাঙালি ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে সাধারণ ফ্যাশনের আলাদা একটি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড তৈরি করতে চায় আমানত শাহ লুঙ্গি। নিজেদের অনলাইন যাত্রার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন রেজাউল করিম। ২০২১ সালে মিয়া (www.miah.shop) নামের ই-কমার্স প্লাটফর্মটি চালু হয়। এ পরিকল্পনা আগাগোড়া রেজাউলের মস্তিষ্কপ্রসূত।
'এখন আমরা সারা দেশে অনলাইনে লুঙ্গি ডেলিভারি করছি। এছাড়া আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে আমাদের লুঙ্গি।
এ অনলাইন প্লাটফর্ম ও আগ্রাসী মার্কেটিংয়ের জন্য এটির সরবরাহ করা যোগাযোগের সুযোগগুলো থেকে আমরা সর্বোচ্চটুকু নিতে চাই,' আশা প্রকাশ করেন রেজাউল।