মুম্বাই এক্সপ্রেস: এক থালাতেই মিলবে হরেক পদের ভারতীয় খাবার
ভারতীয় খাবারের প্রতি প্রেম সেই শুরু থেকেই। হবেই না বা কেন? দোসা, পোলাউ, কাচ্চি, কাবাব, গ্রিলসহ অন্তত অর্ধশত পদের খাবার মন জয় করেছে বাঙালী, অবাঙালী সকলের। এই তালিকায় কোনো না কোনোভাবে অন্তর্ভুক্ত সবাই-ই। তাই তো ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়ে কালক্ষেপণ না করেই চলে গেলাম ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে। সেখানে রূপায়ণ জেড আর টাওয়ারেই সেই কাঙ্ক্ষিত রেস্তোরাঁ।
শহুরে জীবনের কোলাহলকে বিদায় জানিয়ে উপরে উঠলেই চোখে পড়বে নান্দনিকতার নানা উপসর্গ। করিডোরেই দেখা মিলবে 'হারেম উইনডো'র আদলে সাজানো কাঠের জানালার প্রতিকৃতিগুলো, যেগুলো মনে করিয়ে দেয় ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্য রীতির কথা। সেইসব জানালায় জ্বলন্ত মিটিমিটি আলো, দেওয়ালে লেপ্টে থাকা ফটোগ্রাফ আর সিলিংয়ে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে করিডোরের সৌন্দর্যে। লম্বা করিডোর পার হয়ে সামনে এগুতেই সহাস্য বদনে মাথা ঝাঁকিয়ে অভিবাদন জানাতে হাজির হবেন একজন কর্মী।
ভেতরে প্রবেশ করামাত্রই চোখে পড়বে দুলতে থাকা একসেট দোলনা। পিতলের দুইসেট চেইনে সিলিং থেকে নেমে এসেছে এটি। অন্যপাশে কাঠের বক্সের উপর সযতনে রাখা আছে এক সেট গ্রামোফোন। একে পুরোনো জিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি প্রয়াস হিসেবেই উল্লেখ করলেন রেস্টুরেন্টের অপারেশন ম্যানেজার বিপ্লব শুভ। এর পাশেই ঠাঁই হয়েছে দুই সেট মডার্ন ক্রিস্টাল ক্যামেরা অর্নামেন্ট। দেওয়ালের কারুকার্য আর ঝুলে থাকা অর্ধ-ডজন ঝাড় লণ্ঠন হতে আসা মৃদু আলোর বিচ্ছুরণ মোহগ্রস্ত করে দেবে নিমেষেই।
কোলাহলমুক্ত পিনপতন নীরবতা ভেঙে মৃদু আওয়াজে কানে বাজবে পশ্চিমা মিউজিক। শব্দ তরঙ্গের ওঠানামায় মনে হবে দূরে কেউ মিউজিক শুনছে আর বাতাস সেই শব্দগুলো বয়ে নিয়ে আসছে এখানে। যে কেউই নিজের অজান্তেই সেসব পশ্চিমা মিউজিকের সাথে মনে-প্রাণে আবিষ্ট হয়ে যাবে।
এসব অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা দেখে মনে হবে ভুলে কোনো সুলতানের ভোজনালয়ে প্রবেশ করেছেন। বলছিলাম মুম্বাই এক্সপ্রেস রেস্টুরেন্টের কথা।
স্থান নির্বাচন করে বসতেই স্বাগত জানাতে চলে এলেন আরও একজন। অভিবাদন জানিয়েই চলে গেলেন। ফিরলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই— 'ওয়েলকাম ড্রিংকস' নিয়ে। কাঁচা আমের জুসের সাথে বিশেষ ধরনের মশলার মিশ্রণে তৈরি এই ড্রিংকস মুহূর্তেই সব ক্লান্তি অবসাদ দূর করে দেবে।
তারপরেই এলো মেনু কার্ড। ভারতীয় খাবারপ্রেমীরা এই মেনু হাতে পেয়ে দ্বিধায় পড়তে পারেন অনায়াসেই। কী নেই এখানে! সম্ভবত দেশের সর্ববৃহৎ ইন্ডিয়ান খাবারের সমারোহ এই মেনুতে। পোলাও, বিরিয়ানি, দোসা, কাবাব, ভেজিটেবল আইটেম, রোলসহ অন্তত ৩৬ ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এই রেস্টুরেন্টে। এছাড়াও রয়েছে বিশেষ বিশেষ প্ল্যাটারের ব্যবস্থা। খাবার এবং পরিবেশনের ধরনে রয়েছে নবাবীয়ানা।
শাহেন শাহ ভোজ
ভোজনরসিক মোগলরা প্রায় দুইশ বছর ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে। ইংরেজদের আগমনে তাদের সেই দোর্দণ্ড-প্রতাপ শেষ হলেও তাদের ভোজন রসিকতার ছোঁয়া রয়ে গেছে উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে। সম্ভবত মোগলদের এই অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে রাজা-বাদশাহদের খাবারের বিষয়ে। হবেই না বা কেন?
বিরাট আকারের থালায় হরেক পদের খাবার পরিবেশনের রীতি তাদের আরও অনন্য করে তুলেছে। সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মুম্বাই এক্সপ্রেস তাদের নতুন ধরনের এই প্ল্যাটার সাজিয়েছে। দৈত্যাকার এক পিতলের থালায় করে পরিবেশন করা হয় এটি। পোলাউয়ের চারপাশে সাজানো খাবারের থালা নিয়ে আসতেই এর ঘ্রাণ নাকে লাগে। ঝাল-মিষ্টির সংমিশ্রণে ঘ্রাণও হয়ে উঠেছে অনন্য। তাই তো বলা হয়—'ঘ্রাণং অর্ধনং ভোজনং'। যার সহজ অর্থ গন্ধেই অর্ধেক ভোজনের স্বাদ পাওয়া যায়।
ঢাকা শহরের মধ্যে ভারতীয় খাবারের সর্ববৃহৎ প্ল্যাটার হলো শাহেন শাহ ভোজ। এটি চারজনের জন্য পরিবেশন করা হয়। উপমহাদেশে বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবার সাধারণত একটু বেশিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তাই পরিবার কিংবা বন্ধুদের 'গেট টুগেদার'-এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে এবং পরিবারের সবাইকে একই স্বাদ দিতে মেনুতে যুক্ত করা হয়েছে লম্বা তালিকার এই প্ল্যাটার। মোট ১৭ ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এতে। বাসমতি পোলাউ-এর সাথে রেড স্ন্যাপার তান্দুরি, প্রণ তান্দুরি, চিকেন তান্দুরি, চিকেন টিক্কা কাবাব, চিকেন মালাই কাবাব, চিকেন হারিয়ালি কাবাব, বাটার মাসালা, পালক পনির, মিন্ট সস, গোলাপ জামুনসহ হরেক রকমের আইটেম পরিবেশন করা হয়। ভোজনরসিকরা চারজনের এই প্ল্যটার পাবেন মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকায়।
আরিফ আহমেদ নামের এক ভোজন রসিকের সাথে দেখা রেস্টুরেন্টে। সবান্ধবে এসেছেন শাহেন শাহ ভোজ করতে। তার কন্ঠে এখানকার সেবায় মুগ্ধতার কথাই ধ্বনিত হলো। তিনি বলেন, 'সদ্যই একজনের কাছে এই প্ল্যাটারের কথা শুনতে পেয়েছিলাম। ইন্ডিয়ান খাবারের প্রতি ঝোঁক আগে থেকেই ছিলো বলেই আর দেরি করিনি।'
তিনি বলেন, 'এখানে পরিবেশিত খাবারের প্রতিটা পদই অসাধারণ ছিল। তবে বিশেষভাবে স্ন্যাপার তান্দুরি, পালক পনির, চিকেন হারিয়ালি কাবাব আর গোলাপ জামুন অবশ্যই খেতে বলবো।'
মোগল-ঈ-আজম ভোজ
মোগল-ঈ-আজম প্ল্যাটার ছিল রেস্টুরেন্টটির প্রথম এক্সপেরিমেন্টাল বিগ প্ল্যাটার। এই প্ল্যাটারও চারজনের জন্য পরিবেশন করা হয়। পোলাউ-এর সাথে প্রন তান্দুরি, বিফ বটি কাবাব, শিক কাবাব, চিকেন মালাই কাবাব, হারিয়ালি কাবাব অন্যতম। এই প্ল্যাটারটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর থেকেই ভোজন রসিকদের ব্যাপক সাড়া মিলছে। বিশেষ করে পরিবার কিংবা বন্ধুরা এসে উপভোগ করতে পারছেন। এই প্ল্যাটারটিও চারজনের জন্য, দাম ২ হাজার ৫০০ টাকা।
পরীক্ষামূলক মোগল-ঈ-আজমের জনপ্রিয়তা দেখে পরে আরেকটু বড় পরিসরের শাহেন শাহ ভোজ প্ল্যাটার চালু করা হয়।
ওয়াহিয়া জামান নামের একজন ক্রেতা বলেন, 'রেস্টুরেন্টের সেবা এবং খাবারের স্বাদ দু-ই অসাধারণ ছিল। ভারতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ থাকলে যে-কেউ এখানে আসতে পারে। এখানকার খাবার খেয়ে কেউ নিরাশ হবে না।'
প্ল্যাটার ছাড়াও পাবেন
ভারতীর খাবারের মধ্যে দোসা বেশ জনপ্রিয়। মুম্বাই এক্সপ্রেসে আট থেকে নয় ধরনের দোসা পাওয়া যায়। যারমধ্যে আছে গার্লিক মাসাল দোসা ও চিকেন বাটার মাসালা দোসাসহ হরেক রকমের দোসা। আরও আছে পোলাও, বিরিয়ানি, কাবাব, ভেজিটেবল আইটেম, রোলসহ হরেক রকমের খাবার। এসব খাবারের জন্য গুণতে হবে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা।
শুরুটা ২০২১ সালে
২০২১ সালে যাত্রা শুরু করেছে মুম্বাই এক্সপ্রেস নামের এই রেস্টুরেন্ট। একই পরিবারের চারজন ও বাইরের দুজনসহ মোট ছয়জন মিলে রেস্টুরেন্টটি প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে ২০২১ সালেই প্রথম নয়, এর আগেও তারা ২০১২ সালে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন। সেই থেকে শিক্ষা নিয়েই এবারের পথচলা। এবারে কোনো ভুল করেননি। তাই এক বছরের মধ্যেই অথেনটিক ইন্ডিয়ান খাবার পরিবেশনা করে ভোজন রসিকদের আস্থা কুড়িয়েছে এই রেস্টুরেন্ট।
অপারেশন ম্যানেজার বিপ্লব শুভ বলেন, 'পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্য ছিল প্রথম থেকেই। সেক্ষেত্রে সবাইকে একই টেস্ট দেওয়ার জন্যে এই ধরনের বড় বড় প্ল্যাটারের ব্যবস্থা করেছি। এখন পর্যন্ত মানুষের আশাতীত সাড়া পেয়েছি।'
পাচকরা এসেছেন বিদেশ থেকে
মুম্বাই এক্সপ্রেসের আউটলেট মোট ৩টি—উত্তরায় একটি ও বাকি দুটি ধানমন্ডিতে।
খাবারের স্বাদ ও রান্নার ধরন ঠিক রাখার জন্য ভারতীয় খাবারের এই রেস্তারাঁর সবগুলো আউটলেটের শেফদেরও ভারত থেকে আনার ব্যবস্থা করেছেন স্বত্বাধিকারীরা।
বেঙ্গালুরুর লীলা প্যালেসের মতো ৫ তারকা হোটেলেও কাজ করেছেন তাদের একজন।
দেশ-বিদেশ থেকে সোর্সিং করা হয় মশলা ও কাঁচামাল
খাবারে মশলার ব্যবহার ভারতবর্ষের খাবারকে করে তুলেছে লোভনীয়। মাছ, মাংস, সবজি, পোলাউ, বিরিয়ানি—সবকিছুতেই রয়েছে মশলার ব্যবহার। এই মশলার ব্যবহারের উপরই স্বাদ নির্ভর করে, তাই এর সোর্সিংয়েও তৎপর থাকতে হয়। তাই এই রেস্তোরাঁর মালিকেরা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে সরাসরি ভারত থেকেই মশলা আনান।
এর বাইরে ইরানিয়ান জাফরান আনা হয় দুবাই থেকে। মাছ, মাংস, খাসি, সবজিসহ বাকি সব দেশ থেকেই কেনেন। দোসার খামিরের জন্য চাল কিনে আটা করে নেয় রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় বিক্রেতার কাছ থেকে দুধ কিনে তা থেকে পনির তৈরি করা হয় বলে জানান বিপ্লব শুভ।
রেস্টুরেন্টের অবস্থান
মোম্বাই এক্সপ্রেস ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত রূপায়ণ জেড আর টাওয়ারে অবস্থিত। এই টাওয়ারের লিফটে ১১ চেপে উপরে উঠলেই পাবেন রেস্তোরাঁটি।
চাইলে উত্তরাতেও এই ভারতীয় খাবারগুলো উপভোগ করতে পারেন। উত্তরা চার নাম্বার সেক্টরের ওই শাখায় মূল ডাইনিং হলের পাশাপাশি একটি এক্সক্লুসিভ ডাইনিং জোন, প্রাইভেট ডাইনিং জোন এবং আউটডোর ডাইনিং-এর ব্যবস্থাও রয়েছে।
ভবিষ্যতে চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নতুন শাখা খোলার কথাও জানিয়েছেন অপারেশন ম্যানেজার। তবে আপাতত মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই চলতে চাইছেন তারা। তবে ওয়েস্টার্ন মিউজিক, মোগল আবহে পরিবেশনা আর পুরোনো জিনিসপত্রের সংগ্রহ এই রেস্টুরেন্টকে করে তুলেছে অনন্য।