প্রথম বিশ্বযুদ্ধের 'শেল-শক' থেকে যেভাবে পিটিএসডি চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বীকৃত ডিসঅর্ডারে পরিণত হলো
যুদ্ধের দামামা থামলেও কারও কারও মধ্যে তার রেশ রয়ে যায় দীর্ঘদিন। যুদ্ধশেষে আরেক নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় তাদেরকে। এ যুদ্ধ অস্ত্র-গুলির নয়, বরং এটি দুঃস্বপ্ন, বিষণ্ণতা, আতঙ্ক, আর যুদ্ধক্ষেত্রের বিভৎসতার অনাকাঙ্ক্ষিত স্মৃতিচারণের সঙ্গে। যুদ্ধের ভূত তাড়া করে বেড়ানোর দুঃসহ মুহূর্ত এটি।
কোন যুদ্ধে এমনটা হয়? সিনেমায় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আপনি হয়তো ওই যুদ্ধগুলোর কথা সবার আগে ভাববেন। কিন্তু সৈন্যদের যুদ্ধ নিয়ে এ মানসিক দুরবস্থা ৩০০০ বছর আগেও ছিল। যেমনটা ছিল প্রথম-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে, ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধে। চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কত নিরুপায় সৈনিক যুদ্ধের শারীরিক নৃশংসতার পাশাপাশি মানসিকভাবে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তার কোনো হিসেব এখনো আমাদের কাছে নেই।
যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার এ কন্ডিশনকে বলা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি। পিটিএসডি ঘটলে সৈনিকেরা যুদ্ধের বিভৎসতা নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেন, প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হন, ঘুমাতে পারেন না, বিষণ্নতায় ভোগেন, নিজেদের দোষী ভাবতে শুরু করেন।
প্রাচীনকালে সৈনিকেরা পিটিএসডিতে ভুগলে ভাবা হতো তাদেরকে ভূতে ধরেছে। যদিও এ মানসিক কন্ডিশনটির মূল উৎস সামরিক, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখন স্বীকার করেন, বেসামরিক মানুষও এ কন্ডিশনে আক্রান্ত হতে পারেন। যেকোনো ট্রমাটিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করা বা অভিজ্ঞতার পরে ব্যক্তি পিটিএসডিতে ভুগতে শুরু করতে পারেন। এ ধরনের ট্রমাটিক ঘটনার মধ্যে থাকতে পারে মৃত্যু, মৃত্যুর হুমকি, মারাত্মক আঘাত, যৌন সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।
'ট্রমাটিক হিস্টেরিয়া'
গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস তার এক লেখায় জনৈক অ্যাথেনিয়ান সৈনিকের কথা বর্ণনা করেছিলেন যে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালে ম্যারাথনের যুদ্ধ দেখে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেকসপিয়ারের লেখায়ও এ ধরনের কন্ডিশনের কথা জানা যায়। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় যেসব সৈনিকেরা এ ধরনের মানসিক অবস্থায় ভুগতেন, সেটাকে চিকিৎসকেরা "সোলজার'স হার্ট" হিসেবে বর্ণনা করতেন।
প্রথমদিকে চিকিৎসকেরা পিটিএসডিতে ভোগা সৈনিকদের মধ্যে শারীরিক কারণ খোঁজার চেষ্টা করতেন। এরপর ১৮৮০'র দশকে তারা এটিকে মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযোগ ঘটান। তখন নারীরা এ ধরনের আবেগ দেখালে তাকে 'হিস্টেরিয়া' বলে অভিহিত করতেন চিকিৎসক সমাজ। আর এ পরিস্থিতির উৎস হিসেবে নারীর জরায়ুকে দায়ী করা হতো। পরে ফরাসি স্নায়ুবিদ জ্যঁ-মাঘতি শ্যাকো পুরুষদের মধ্যে একই মানসিক লক্ষণকে ট্রমাটিক ঘটনা হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেন। এভাবে 'ট্রমাটিক হিস্টেরিয়া'র জন্ম হয়।
শেল শক ও কমব্যাট ফ্যাটিগ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নতুন ধরনের কিছু বিধ্বংসীক্ষমতার অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল যা তার আগের যুদ্ধগুলোতে কল্পনাও করা যেত না। এসব অস্ত্র ও প্রযুক্তির মধ্যে ছিল বিমানযুদ্ধ, বিষাক্ত গ্যাস, ট্যাংক ইত্যাদি। হঠাৎ এসব অস্ত্রের ধ্বংসলীলার সামনে পড়ে তীব্র ভয় পেয়ে যেতেন সৈনিকেরা। এ যুদ্ধেই 'শেল শক' নামক নতুন এ শব্দবন্ধটি প্রচলিত হয়। শেল শক তথা পিটিএসডিতে ভুগেছিলেন হাজারো সৈনিক। এদের কেউ কেউ মনস্তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে প্রাথমিক সেবা পেলেও যুদ্ধের পর এ সৈনিকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা শুরু হয়।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মনস্তাত্ত্বিকেরা মেনে নিয়েছিলেন যুদ্ধের কারণে সৈনিকরা মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম মহাযুদ্ধের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সেনা পিটিএসডিতে ভুগেছিলেন। তখন এ কন্ডিশনকে 'সাইকিয়াট্রিক কলাপস', 'কমব্যাট ফ্যাটিগ', এবং 'ওয়ার নিউরোসিস' বলে ডাকা হতো।
সেনাধ্যক্ষরা মনে করতেন সৈনিকদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে আনলে বা সোডিয়াম অ্যামিটালের মতো ঔষধ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দিলে তাদের এ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা সেরে যাবে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক মার্কিন সৈনিক এ কন্ডিশনের কারণে সামরিক বাহিনী থেকে বাদ পড়েছিলেন (ডিসচার্জড)।
পোস্ট-ভিয়েতনাম সিনড্রোম
১৯৪১ সালে দ্য ট্রমাটিক নিউরোসেস অভ ওয়ার নামক একটি বই লিখেছিলেন মনস্তাত্ত্বিক আব্রাম কার্ডিনার। তার এ বইটি আজকের পিটিএসডি নিয়ে মানুষের মনোভাব পাল্টাতে সাহায্য করেছিল।
১৯৫২ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) দ্য ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অভ মেন্টাল ডিসঅর্ডার (ডিএসএম) প্রকাশ করে। মনস্তাত্ত্বিকদের কাছে এটি প্রায় বাইবেলের সমতুল্য একটি গ্রন্থ। এ হ্যান্ডবুকটি মানসিক রোগের চিকিৎসা, গবেষণা, পাবলিক পলিসি তৈরি ইত্যাদি কাজে সংশ্লিষ্ট পেশাদার ব্যক্তিবর্গদের সাহায্য করে৷ কিন্তু বইটিকে সৈনিকদের এ মানসিক কন্ডিশনটিকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি না দিয়ে ডিপ্রেসন, সিজোফ্রেনিয়ার মতো ডিসঅর্ডারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
১৯৭২ সালে সাইকিয়াট্রিস্ট কেইম শ্যাটান 'পোস্ট-ভিয়েতনাম সিনড্রোম' শব্দবন্ধটি চালু করেন। ততদিনে ভিয়েতনাম ফেরত সৈনিকেরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। তারা আবেগ-অনুভূতিহীন, ফ্ল্যাশব্যাক, রাগ ইত্যাদি লক্ষণ দেখাতে শুরু করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের চিকিৎসা পেতে নানা অসুবিধার মুখে পড়তে হয়।
অবশেষে ১৯৮০ সালে ডিএসএম-এর তৃতীয় সংস্করণে (ডিএসএম-থ্রি) পিটিএসডিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হয়। এর ১২ বছর পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)'র ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অভ ডিজিজেস-এ পিটিএসডিকে তালিকাভুক্ত করা হয়।
যে ক্ষত যায় না দেখা
বর্তমানে পিটিএসডি'র সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। যৌন সহিংসতা/নিগ্রহ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অস্ত্রোপচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রিয়জন বিয়োগ, ম্যাস শ্যুটিং, দুর্ঘটনাসহ আরও অনেক দুর্যোগের শিকার ব্যক্তিরা পিটিএসডিতে ভোগেন বলে এখন স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পিটিএসডি'র লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুঃস্বপ্ন, ফ্ল্যাশব্যাক, অতি-সতর্ক মনোভাব, মনোযোগ দেওয়ায় সমস্যা, স্মৃতিভ্রংশ, অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলা, নিজে বা অন্যকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা, দোষী মনোভাব ইত্যাদি।
প্রতি বছর গবেষকেরা পিটিএসডি'র চিকিৎসা, ট্রমা কীভাবে শরীর ও মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে তা নিয়ে গবেষণা করছেন। পিটিএসডিতে ভুগতে পারেন জাতিগত ঘৃণার শিকার হওয়া, কোভিডের সময় আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিও। তবে কোনো ট্রমার অভিজ্ঞতা হলেই যে পরবর্তীসময়ে ব্যক্তি পিটিএসডিতে আক্রান্ত হবেন, তাও কিন্তু নয়। আর পিটিএসডি আক্রান্ত ব্যক্তিও সুস্থ হতে পারেন, জীবনে পুনরায় আনন্দের সন্ধান পেতে পারেন। পিটিএসডি কোনো 'ডিসফাংশন', বরং এটি বেঁচে থাকার আবেগীয় বহিঃপ্রকাশ বলেই জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওল্ড ডমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির দর্শন ও ধর্মের সহকারী অধ্যাপক এবং পিটিএসডি'র ইতিহাসবেত্তা ম্যারিক্যাথেরিন ম্যাকডোনাল্ড।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক