বিলেত থেকে আসা মেমসাহেবদের চোখে ভারতবর্ষ
ভারতবর্ষে বসবাসকারী প্রত্যেক বিলেতি মেমসাহেবের জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তগুলোর একটি ছিল তাদের সন্তানদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য একাকী ইংল্যান্ডে পাঠানো। বাবা-মায়েরা শিশুদের এই যাত্রা যথাসম্ভব বিলম্বিত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ভ্রমণের উপযোগী বয়স হলেই—কখনও কখনও ছয় বছর বয়সেই—তাদের বিলেত পাঠানো আবশ্যকীয় হয়ে উঠত।
ভারতবর্ষের ব্রিটিশ মা-বাবারা নিশ্চিত ছিলেন যে তাদের মাতৃভূমিতে কয়েক বছর স্কুলে পড়াশোনা করালেই এই শিশুদের ব্রিটিশ সত্তা ও পরিচয় গড়ে উঠবে। এই ব্যাপারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই শিশুরা আগে কখনও ব্রিটেন দেখেনি।
তার ওপরে যথাযথ ব্রিটিশ শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শিশুর প্রথম কয়েক বছর কাটত আয়া ও ভারতীয় সেবকদের সঙ্গে। ওই সময়ে শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'ভারতীয়' বৈশিষ্ট্য চলে আসে।
বিলেতি মেমসাহেবদের এই শিশুরা প্রায় সর্বক্ষণই থাকত আয়াদের সঙ্গে। বাবা-মায়ের তাদের যত্নআত্তি করার অত গরজ ছিল না। ফলে রোদে পুড়ে, ধুলায় লুটোপুটি খেয়ে এই শিশুদের দিন গুজরান হতো। মোদ্দা কথা, আদর্শ ব্রিটিশ শিশুর বৈশিষ্ট্যের বালাইও ছিল না এদের মধ্যে। ছিল না ভিক্টোরিয়ান সমাজের বোর্ডিং স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের 'মার্জিত' আচার-আচরণের কিছুই। ফলে ভারতবর্ষে বেড়ে ওঠা ব্রিটিশ শিশুদের মধ্যে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রোথিত করার জন্য ব্রিটিশ শিক্ষা প্রদান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল।
অবশ্য রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের বাইরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়লে, বা আর্থিক অনটন দেখা দিলে, কিংবা সন্তানদের থেকে দূরে থাকতে না চাইলে বাবা-মায়েরা প্রায়ই বাচ্চাদের বিলেত পাঠাতে চাইতেন না। এসব ক্ষেত্রে তারা ইউরোপীয় ন্যানি ও গভর্নেস নিয়োগ করে বাচ্চাদের ব্রিটিশ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়াতেন।
অ্যান রাইটের জন্ম ভারতে। ভারত স্বাধীনতা হওয়ার পরও তিনি ব্রিটেন যাননি। 'দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড অভ দ্য রাজ' বইয়ে তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশ রাজে বেড়ে ওঠার সময় তার কয়েকজন গভর্নেস ছিল। তার শেষ গভর্নেস ছিলেন জোয়ান স্কট। অ্যান লিখেছেন, জোয়ান স্কট ছিলেন 'হাসিখুশি' ও 'সংগীতবাজ' মহিলা।
ওই সময় ব্রিটিশ পরিবারগুলো পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে গভর্নেসদের কাছ থেকে আবেদন চাইত। এরকম এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই রাইট পরিবারে চাকরি পান জোয়ান।
এক সাক্ষাৎকারে জোয়ান বলেছিলেন, প্ল্যান্টেশনে কঠিন সময় পার করছিলেন তিনি। ওই সমই পত্রিকায় রাইট পরিবারের দেয়া বিজ্ঞাপন দেখতে পান। সেটি দেখে জোয়ান আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চটজলদি আবেদন করে চাকরিতে ঢুকে পড়েন। জোয়ান নিয়মিত হাইব্রো মিউজিক বাজিয়ে শোনাতেন। তার বাজনা রাইট পরিবার খুব পছন্দ করত।
কখনও কখনও ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ শিশুদের জন্য ভারতীয় শিক্ষক নিয়োগ করা হতো। তাদের ডাকা হতো মুন্সি নামে। মুন্সিরা এই মেমসাহেবদের বাচ্চাদে ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয় পড়াতেন।
মুন্সি নিয়োগ না দিলে বাচ্চাদের কাছাকাছি পাহাড়ি স্টেশনে অবস্থিত ইংরেজি ভাষার কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হতো। কনভেন্ট স্কুলগুলো চালাতেন মিশনারি নানরা। তাতে শিশুদের মধ্যে সহজেই খ্রিষ্টান মূল্যবোধ তৈরি হতো।
সে কারণে কনভেন্টগুলোকে ভারতীয় স্কুলের চেয়ে ভালো বিকল্প বিবেচনা করা হতো।
এছাড়া কনভেন্ট স্কুলগুলোতে ব্রিটিশ-আদলের শৃঙ্খলাও মেনে চলা হতো। এতে ছাত্ররা 'নেটিভ'-স্টাইলের অপরাধ ও বিপথগামী হওয়া থেকে দূরে থাকত।
এছাড়া কনভেন্ট স্কুলে পশ্চিমা শিক্ষা দেয়া হতো, এমনকি ইউরোপীয় আদলে থিয়েটার, পিয়ানো শেখানো প্রভৃতি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও চালানো হতো।
তবে একটা সময় ছিল যখন পাহাড়ের কনভেন্ট স্কুলগুলোকে ভালো চোখে দেখা হতো না, কারণ এসব স্কুলে যারা পড়াশোনা করত তারা বেশিরভাগই মিশ্র বংশোদ্ভূত ছিল।
এছাড়া ব্রিটিশ পরিবারগুলোর আশঙ্কা ছিল তাদের সন্তানরা তথাকথিত 'চি-চি' উচ্চারণে কথা বলাসহ অন্যান্য ভারতীয় আদবকেতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
ভারতে বসবাসকারী বিলেতি বাবা-মায়েরা জানতেন, দীর্ঘমেয়াদে তাদের সন্তানদের মধ্যে ভারতীয় স্বভাব আসবেই, তবু তারা চাইতেন ছেলেমেয়েরা যেন অন্তত 'ব্রিটিশত্বের' আভায় এটি লুকিয়ে রাখে—যেমনটি তারা নিজেরা করতেন।
স্কুলে পড়ার জন্য সন্তানদের ব্রিটেনে পাঠানোর সময় কখনও কখনও বিলেতি মায়েরাও তাদের সঙ্গে যেতেন। তারা হয় বাচ্চাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতেন, নয়তো বাচ্চারা বড় হওয়ার আগপর্যন্ত তাদের সঙ্গে থাকতেন।
তবে দ্বিতীয়টা খুব কমই ঘটত।
মেমসাহেবদের দাম্পত্য দায়িত্বের বোধই জয়ী হতো শেষতক। তাই তারা ভারতে তাদের স্বামীর কাছে থেকে যেতেন অথবা ব্রিটেনে সন্তানদের সবকিছু গোছগাছ করে দিয়েই ফের ভারতে ফিরে যেতেন।
তবে যেটাই ঘটুক হোক না কেন, বাচ্চাদের একবার ভারতের বাইরে পাঠানো হলে তারা কয়েক বছরের আগে আর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেত না। ততদিনে সব শিশুই বড় হয়ে যেত।
এছাড়া শুধু শিক্ষাপ্রদানের জন্য বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতেন না। সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আরও কিছু কারণ রয়েছে।
সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েই বিলেতি বাবা-মায়েরা প্রায়ই তাদের খুব অল্প বয়সে ভারতের বাইরে পাঠাতেন।
সম্ভব হলে অল্পবয়সী মেমসাহেব মায়েরা ব্রিটেনের বাড়ি ফিরে যেতেন। সেখানে আত্মীয়দের সহযোগিতায় সন্তানদের যত্ন নিতে পারতেন। বাচ্চা অসুস্থ হলেই হাতের কাছে চিকিৎসক পাওয়াটা ছিল বড় স্বস্তির বিষয় ছিল।
কখনও কখনও বাবা-মা সন্তানদের ব্রিটেন পাঠিয়ে দিতেন ওদের একটা স্থায়ী ঘর দেওয়ার জন্য।
ভারতে থাকাকালে এই বিলেতি সাহেব-মেমদের প্রতিনিয়তই আবাসস্থল বদলাতে হতো। বিশেষ করে সেনা পরিবারের শিশুদের জায়গা বদলাতে হতো সবচেয়ে বেশি, কারণ তাদের ঘন ঘন পোস্টিং দেওয়া হতো।
অভিভাবকদের এ ধরনের বিষয়গুলোকে হালকাভাবে না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো, কারণ যারা হালকাভাবে নিত তারাই দীর্ঘমেয়াদে ভুগত।
তাই মাঝেমধ্যে শিশুদের ভারতের অন্য কোনো এলাকায় বসবাসরত দাদা-দাদি বা নানা-নানির আছে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
তবে সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন, সন্তানদের জন্য তাদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা থাকাটা সবসময়ই কঠিন ছিল।
সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কষ্টে থাকতেন মেমসাহেব মায়েরাও।
বহু বছর সন্তানদের থেকে আলাদা থাকতে হতো তাদের। এ সময় মায়েরা সন্তানদের খবর পেতেন শুধু স্কুল থেকে পাঠানো সংক্ষিপ্ত চিঠির মাধ্যমে।
মেমসাহেব মায়েরা যেখানেই যেতেন, সন্তানদের ছবি তাদের সঙ্গে থাকত। সন্তানের স্মৃতি রোমন্থন করে সময় কাটত তাদের।
- ঈপ্সিতা নাথের মেমসাহিবস: ব্রিটিশ উইমেন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া বই থেকে নেওয়া