চীনা পণ্যে সয়লাব বাজার, তবু বহাল তবিয়তে টিকে আছে রাজা মেটাল
১৯৭০ বা ৮০-এর দশকে আমরা যেসব পণ্য ব্যবহার করতাম, বর্তমান দশকে সেগুলো অনেক বিবর্তিত হয়েছে। আর বাজার নিজেও অনেক বিকশিত হয়েছে। ভারত ও বিশেষ করে চীন শিল্পায়নে অনেক এগিয়ে যাওয়ায় আমাদের দেশে উৎপাদিত অনেক পণ্যই বাজার থেকে হারিয়ে গেছে।
তারপরও এই অঞ্চলের সুবিধাপ্রাপ্ত শিল্পগুলোর সস্তা, প্রায়ই নিম্নমানের কিন্তু চাকচিক্যময় পণ্যে সয়লাব হয়ে যাওয়া খোলাবাজারে ব্যবসা করার নিত্যনতুন উপায় বের করে কিছু পণ্য ঠিকই টিকে গেছে। এসব পণ্যের কিছু কিছু গুণগত মান বজায় রাখার নীতিও ধরে রাখতে পেরেছে, যা অন্যান্য স্থানীয় উৎপাদনকারীদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস।
এরকমই একটি স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। ১৯৭০-এর দশক থেকে বাজারে জায়গা করে নেওয়া কোম্পানিটি দেশীয় ভোক্তাদের জন্য রান্নাঘর ও বাথরুমের কল তৈরি ও বিক্রিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে।
দেশের বাজার সয়লাব ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা দামের কলে (প্লাস্টিকের কল ৪০ টাকায়ও পাওয়া যায়)। এই কমদামি কলই যখন গড়পড়তা ক্রেতাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে, সেই মুহূর্তেও রাজা মেটাল ১৪ হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত দামের উচ্চমানের পণ্য বাজারজাত করে ব্যবসা করতে পারছে। প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য কম মূল্যের পণ্যও তৈরি করে।
বর্তমানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কারখানার আয়তন ৫০ হাজার বর্গফুট। তবে রাজা মেটালের যাত্রার শুরুটা ছিল অত্যন্ত সাদামাটা।
রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমার প্রয়াত বাবা তাজিজুল হক মাস্টার তরুণ বয়সে ১৯৭৩ সালে পুরান ঢাকায় একটা ছোট কারখানা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কারখানা দেওয়ার মতো পুঁজিও তার কাছে ছিল না। তার ফুফু নিজের গয়না বন্ধক রেখে তাকে ২ হাজার টাকা ধার দেন।'
তিনি বলেন, 'কারখানার বেড়া ছিল বাঁশের তৈরি। মেশিন যাতে চুরি না হয়ে যায়, সেজন্য আমার বাবা কারখানায় ঘুমাতেন। একজন সহকারীর সাহায্যে তিনি নিজ হাতে সাবান হোল্ডার, তোয়ালে রেইল ইত্যাদির মতো মেটাল পণ্য তৈরি করতেন। তিনি নিজেই ঘুরে ঘুরে সেসব পণ্য বিক্রি করতেন। এভাবেই শুরু।'
প্রথমে কারখানাটির নাম ছিল রানি ইলেকট্রোপ্লেটিং (তাজিজুলের প্রথম সন্তানের নামানুসারে)। কিন্তু পরে ১৯৭৮ সালে প্রথম ছেলের জন্মের পর এর নাম রাখা হয় রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। ওই বছর থেকেই কারখানাটি কল তৈরি করতে শুরু করে।
নজরুল বলেন, ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে ঢাকাইয়া ব্যবসায়ীরা বাকিতে ব্যবসা শুরু করেন। এতে তাদের কোম্পানি ধাক্কা খায়। তবে ওই সময়ই সিলেটের ব্যবসায়ীরা রাজা মেটালের পণ্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। রাজা এখনও দেশের ওই অঞ্চলে ভালো বিক্রি করছে বলে জানান নজরুল।
গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি), সশস্ত্র বাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বিজিবির মতো বিভিন্ন সরকারি সংস্থা রাজার নিয়মিত গ্রাহক বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ১৯৯০ সালে জাতীয় শিল্প মেলা পুরস্কার জেতে রাজা। ২০০৫ সালে তাজিজুল হক মারা যান। এরপর রাজার দায়িত্ব নেন তার বড় ছেলে, অর্থাৎ বর্তমান এমডি।
স্থানীয় পণ্যকে অবজ্ঞার চোখে দেখা
বিক্রেতাদের তথ্যমতে, বাজারে বিক্রি হওয়া কলের ৪০ শতাংশেরও বেশি আমদানি করা। বাংলাদেশ বাথরুম ফিটিং ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বলেন, এই হার অচিরেই ৫০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যাবে।
দেশের প্রথম কয়েকটি কল প্রস্তুতকারকদের একটি রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। আমদানি করা পণ্যে সয়লাব হয়ে যাওয়া একটি শিল্পে রাজার জন্য টিকে থাকাটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
নজরুল হতাশার সুরে বলেন, 'বাংলাদেশি ভোক্তাদের বিদেশি পণ্য পছন্দ। দেশি পণ্য কিনতে এলেই তারা ডিসকাউন্ট, ওয়ারেন্টি/গ্যারান্টিসহ সব ধরনের সুবিধা চান। কারণ তারা মনে করেন দেশি পণ্যের মান ভালো না। কিন্তু তারা একই বিদেশি পণ্যের জন্য ওয়ারেন্টি চান না। এসব বিদেশি পণ্য কেনার সময়ও তারা খুব বেশি দরাদরি করেন না।'
আবার কিছু কিছু স্থানীয় ব্র্যান্ড বিদেশি পণ্য রিব্র্যান্ডিং করে বিক্রি করছে। রিব্র্যান্ডিং করার কারণ, বিদেশি পণ্যগুলো সস্তা। বিদেশি পণ্যে প্রায়ই পিতলের বদলে দস্তা ব্যবহার করা হয়। দস্তা দ্রুত ক্ষয় হয়।
নজরুল বলেন, 'গ্রোহে, রোকা, টোটো, কোলার-এর মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর কেউই প্লাস্টিক বা জিঙ্কের কল তৈরি করে না। কিন্তু আমাদের সস্তা পণ্যপ্রীতির কারণে বাজার থেকে গুণগত মান প্রায় উঠেই গেছে। রাজা জার্মানি থেকে স্পেকট্রোমিটার আমদানি করেছে এবং এটি ব্যবহার করে আমরা আমাদের পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করি।'
রাজা মেটাল পণ্যের গুণমান বজায় রেখে এবং সঠিক অনুপাতে ধাতু ব্যবহারে আপসহীন অবস্থান নিয়ে গ্রাহক ধরে রাখতে পেরেছে। এছাড়া সঠিকভাবে ইলেকট্রোপ্লেটিং করা হলে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত পরিবেশেও পণ্যের বাইরের স্তরের ক্ষয়রোধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন কোম্পানিটির এমডি। বাজারে নিম্নমানের ও সস্তা পণ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এটাই রাজার লড়াইয়ের কৌশল। সস্তা ও নিম্নমানের পণ্যের আধিপত্য সত্ত্বেও কোম্পানিটি উচ্চমানের পণ্য উত্পাদন বন্ধ করেনি।
কিন্তু ক্রেতারা কীভাবে ভালো পণ্য চিনবেন? পণ্যটি কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, তা তারা জানবেন কীভাবে? পিতলের কল তৈরি করার পর তার ওপর ইলেকট্রোপ্লেটিং প্রক্রিয়ায় ক্রোমিয়ামের প্রলেপ দেওয়া হয়। সে কারণে বাইরে থেকে সব কলই দেখতে একরকম লাগে।
এ প্রশ্নের জবাবে নজরুল জানালেন—ভেতরদিকে দস্তা সাদা দেখাবে, কিন্তু পিতল দেখাবে হলুদ। এছাড়া পিতল ওজনেও ভারী।
এসব পণ্যের মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব কোনো সরকারি সংস্থার আছে কি না জানতে চাইলে নজরুল বলেন, এই দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন)। কিন্তু বিএসটিআই শুধু কলে কোনো ফুটো আছে কি না তা পরীক্ষা করে, ব্যবহৃত পিতলের গ্রেড পরীক্ষা করে না।
বাজার বড় হচ্ছেই
অন্যান্য অনেক খাতের মতো করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে স্যানিটারিওয়্যার শিল্পেও। তার উত্তাপ লেগেছে রাজা মেটালের গায়েও।
প্রতিষ্ঠানটির এমডি বলেন, 'বিক্রি না থাকলেও আমরা আমাদের শ্রমিকদের পুরো বেতন দিয়েছি, তাদের কষ্ট পেতে দিইনি। সব ভোগান্তি আমিই সহ্য করেছি। আমরা ৪ শতাংশ সুদে সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছি, সেজন্য সরকারকে ধন্যবাদ।'
চলতি বছর তাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এবার প্রতিযোগিতা আরও তীব্র মনে হচ্ছে বলে জানান নজরুল। ১৫০ জন কর্মী নিয়ে কোম্পানিটির প্রতিদিন ৫ হাজার পিস পণ্য উত্পাদনের সক্ষমতা থাকলেও প্রকৃত উত্পাদন ২ হাজারের আশপাশেই রয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
তবে সারা দেশে ক্রমবর্ধমান ভবন নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে কলের চাহিদাও আকাশচুম্বী হচ্ছে।
তবু নজরুলের মতে, এ শিল্পে আমদানির বিরুদ্ধে একধরনের সুরক্ষা প্রয়োজন—যেমন উচ্চ শুল্ক আরোপ করা।
ধাতব কল আমদানিকারকরা বর্তমানে ৬৯ শতাংশ টিটিআই (টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স) দিলেও চীনামাটির তৈরি সিরামিকের সিঙ্ক ও অন্যান্য স্যানিটারি ফিক্সচারের জন্য টিটিআই ১৫০.৭৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ বাথরুম ফিটিং ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন এই এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সক্রিয় নয় বলেও মনে করেন নজরুল।
তবে রাজাকে শুধু চীনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে না, ইদানীং এই শিল্পে আসা বৃহৎ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এই বাজারে নতুন আসা দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আরএফএল, আকিজ গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ ও এ ওয়ান পলিমার লিমিটেড (আনোয়ার গ্রুপ)। এই কোম্পানিগুলো নিম্ন ও উচ্চ মানের, উভয় পণ্যের বাজারেই প্রবেশ করছে।
তবে এরপরও ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত ছোট কোম্পানিটি হুমকিতে আছে বলে মনে করে না। নজরুল বলেন, 'চাহিদা এত বেশি যে একটি একক কোম্পানি পুরো বাজার দখল করতে পারে না।'
'কিন্তু অকারণে আমাদের গ্রাহকদের বিদেশি পণ্যপ্রীতির যে মানসিকতা, তা বদলাতে হবে,' যোগ করেন তিনি।'নইলে আমাদের দেশীয় শিল্প বিকশিত হবে কীভাবে?'
নজরুল ইসলাম মনে করেন, তারা যাতে নানা প্রতিবন্ধকতা এড়াতে এবং রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদন করতে পারেন, সেজন্য সরকার এই শিল্পের জন্য একটি শিল্প পার্ক তৈরি করতে পারে। (প্রতিহিংসার স্বীকার হতে পারেন—এ ভয়ে তিনি প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে বিশদভাবে বলেননি)।
রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সহায়তা এই শিল্পকে রপ্তানিকারক হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।