বাবার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান যেভাবে বাঁচালেন ২০২২-এর সেরা মাঝারি উদ্যোক্তা নজরুল ইসলাম
২০০৪ সালে বাবার মৃত্যুর পরপরই পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন নজরুল ইসলাম। ওই সময় বড় ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল না তার। শুধু বাবার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতেই মরিয়া সংগ্রাম করছিলেন তিনি।
১৯৭৩ সালে মাত্র ১৫ জন কর্মচারী নিয়ে নজরুলের প্রয়াত বাবা তাজিজুল হক মাস্টার পুরান ঢাকার ধোলাইখালে রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি তখন কিচেন ও বাথরুম ফিটিংস তৈরি করত।
বাবার মতো ব্যবসায়ী হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না নজরুলের। এইচএসসি পাস করার পর ইউনিভার্সিটি অভ গ্রিনউইচ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার জন্য তিনি লন্ডনে যান।
তার বাবা যখন মারা যান তখন তিনি বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্র। বাবার মৃত্যুর পর ধোলাইখালের বাড়িতে ফিরে আসেন নজরুল। প্রয়াত বাবা তখনও তার ছোট কোম্পানিটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর জন্যই সংগ্রাম করছিলেন।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে নজরুল সবার বড়। তিনি জানতেন, কোম্পানিটির তার বাবার কতটা প্রিয় ছিল। তাই নজরুল বাবার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। সেজন্য বাবার রেখে যাওয়া রাজা মেটালের হাল ধরলেন।
কিন্তু নজরুল যতটা ভেবেছিলেন, কাজটা তারচেয়েও দুরূহ ছিল। কারণ রাজা মেটাল তখন ব্যাংকে বড় দেনায় ডুবে ছিল। প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি মালিকানাধীন, তাই মালিকের মৃত্যুতে ব্যাংক জমিসহ কোম্পানিটি বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়,
এই বৈরী সময়েই নজরুল একটি সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। তিনি রাজা মেটালের মালিকানা পরিবর্তন করে নিজের নামে নিলেন এবং নিজে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বিশাল দায় নিলেন।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাথরুম ও কিচেন সামগ্রী নির্মাণে নান্দনিকতা ও আধুনিকতার মাত্রা যোগ করলেন নজরুল। এবং মাত্র ২ বছরেই নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাবার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে ঘুরে দাঁড়ালেন।
তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নজরুলকে।
বর্তমানে রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজে সব মিলিয়ে ২০০ জনের মত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মিত কাজ করেন। গ্রাহকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ৬টি আউটলেট গড়ে উঠেছে।
রাজা মেটাল আজ বাংলাদেশের স্যানিটারি জগতের অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ড। বর্তমানে কোম্পানিটির বার্ষিক টার্নওভার ৮-১০ কোটি টাকা।
রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ আজ নান্দনিকতা ও আধুনিকতার সাথে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইস্যুতেও। প্রতিষ্ঠানটির সমস্ত পণ্য নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষিত এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) অনুমোদিত।
দেশের কিচেনওয়্যার শিল্পকে সমৃদ্ধ করার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি নজরুল ইসলাম পেয়েছেন মাঝারি উদ্যোক্তা ২০২২ পুরস্কার।
নজরুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একটা সময়ে নিত্যদিন ব্যবহারের জন্য পানি সংগ্রহ করা হতো নদী, পুকুর কিংবা টিউবওয়েল থেকে। আর এখন আমরা ঘরে বসে কল টিপলেই পানি পেয়ে যাই। আর সেই কল এখন প্রযুক্তি ও নান্দনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের রান্নাঘর কিংবা স্নানের ঘরে শিল্পরূপ পেয়েছে। এমন শিল্পরূপ আমাদের রান্নাঘর কিংবা স্নানের ঘর পর্যন্ত যে প্রতিষ্ঠান পৌঁছে দিয়েছে তার মধ্যে রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ অন্যতম।'
তিনি বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই দেখেছি ফ্যাক্টরিতে কীভাবে অ্যাকসেসরিজ তৈরি হয়। ১৯৮০-র দশকে বাবা পানির কল তৈরি শুরু করেন, কিন্তু তখনও দেশে এসবের চাহিদা খুব একটি তৈরি হয়নি। কারন আবাসন শিল্প তখনও এতটা বিকাশ লাভ করেনি।'
'বাবা ছিলেন স্মার্ট। শুরুতেই তিনি গুরুত্ব দিলেন গ্রাহকের বর্তমান চাহিদাকে। তিনি লক্ষ করলেন উপকূলীয় এলাকায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ পণ্য অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পানিতে বিদ্যমান অতিরিক্ত আয়রন ও উপকূলীয় এলাকার অতিরিক্ত লবণ ফসেটের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
'তাই এই সমস্যা সমাধানে বাবা জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আধুনিক মেশিন আমদানি করলেন। তার নির্দেশনায় মানুষ ও মেশিনের যুগপৎ প্রচেষ্টায় পণ্যের গুণগত মানে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। তিনি একইসাথে ফসেট তৈরিতে পিতলের সাথে থাকা অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান দূর করে নিরাপদ ফসেট উৎপাদনে দারুণভাবে সফল হন যা ছিল দেশে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।'
ভবিষ্যতে নজরুল ইসলামের ইচ্ছা রাজা মেটালকে মাঝারি শিল্প থেকে ভারী শিল্পে উন্নীত করা।
'আগামী ১০ বছরে আমার কোম্পানিতে ২ হাজারে বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে। বিদেশে এই পণ্য রপ্তানি করে আমরা দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আনতে পারব,' এই পুরস্কারজয়ী উদ্যোক্তা বলেন।