ঘরের ভেতরেই যখন পাহাড় আর অরণ্য
একটি ছোট্ট গ্লাসের বা জারের ভেতর পাথুরে পাহাড়, গাছপালা, মাটি, বালি, শেকড়…বলতে পারেন ছোটখাটো একটা জঙ্গল। গ্লাসের ভেতর জঙ্গল! তবে বলছি শুনুন, যেকোনো জার, গ্লাস থেকে শুরু করে ফেলে দেওয়া বাতিতেও তৈরি করা যায় জঙ্গলের ক্ষুদ্র সংস্করণ। যদিও এ জঙ্গল কিংবা পাহাড়ের বিশালতায় হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, তবে ঘরে বসেই পাহাড় বা সবুজের মেলবন্ধন উপভোগের সুযোগ রয়েছে ষোলআনাই। মজার বিষয় হচ্ছে, জঙ্গল বা পাহাড়ের এ ক্ষুদ্র সংস্করণে নেই কোনো সত্যিকারের প্রাণীর অস্তিত্ব।
ক্ষুদে এ কিম্ভুতকিমাকার জঙ্গলের কথা শুনে চক্ষু চড়ক গাছ? প্রাণী ছাড়া ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থানের এ সংস্করণকে বলে 'টেরারিয়াম'। পাহাড় বা ঘন অরণ্যকে হাতের মুঠোয় এনে দিতে টেরারিয়াম নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক আগেই কাজ শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশে যে মানুষগুলো দিনরাত এক করে এ নিয়ে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তার মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মো. মনিরুজ্জামান। 'টেরারিয়াম ঢাকা' নামে একটি ফেসবুক পেজও রয়েছে তার।
গাছপালার প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকে ছাদে টুকটাক গাছ আগে থেকেই লাগাতেন মনিরুজ্জামান। প্রায় আট মাস আগে অনেকটা হঠাৎ করেই তার চোখ পড়ে টেরারিয়ামের একটি ভিডিওর ওপর। একনাগাড়ে ইউটিউবে বেশকিছু টিউটোরিয়াল দেখে ফেলেন এ নিয়ে। এরপর থেকেই টেরারিয়াম বা স্বর্গোদ্যান বানানোর চেষ্টা করেন তিনি। তবে শুরুর পথটা কিন্তু মোটেও খুব একটা সহজ ছিল না বলেই দাবি টেরারিয়াম ঢাকার এ কর্ণধারের।
প্রথম অনুভূতি
মনির জানালেন, প্রথমদিকে টেরারিয়াম সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না তার। কয়েকটি ভিডিও দেখার পর মনে হলো এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করা যায়। পাহাড়, গভীর অরণ্যকে যদি একই ফ্রেমে আনা যায় তবে মন্দ কী! যেই কথা সেই কাজ। লেগে পড়লেন স্ত্রীর ভাইকে সঙ্গে নিয়ে টেরারিয়াম বানাতে।
ইউটিউবে দেখা ভিডিওগুলো হাতে-কলমে বানাতে গিয়েই বাধে যত বিপত্তি। প্রথম ৩ মাস যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয় তাকে। তার ভাষ্যমতে, ওইসময়ে বানানো টেরারিয়ামগুলোর জারের ভেতর থাকা একটা গাছও বাঁচাতে পারেননি তিনি, প্রত্যেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। দেশে এ নিয়ে তেমন কেউ কাজ না করায় ভরসা বলতে ছিল কেবল ইউটিউব টিউটোরিয়াল। ধীরে ধীরে আয়ত্তে আসে প্রক্রিয়াটি। এরপর থেকেই এ কাজ নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা ভাবতে শুরু করেন তিনি।
তবে প্রথমবারের মতো যখন টেরারিয়াম তৈরিতে সফল হন, সেসময়কার অনুভূতি ছিল একেবারেই অন্যরকম। অদ্ভুত একধরনের ভালোলাগায় মন ভরে গিয়েছিল বলে জানালেন তিনি। মনিরের ভাষ্যমতে, সবুজের সান্নিধ্য তার এতোটাই ভালো লাগে যে, অফিসের কাজ কোনোমতে শেষ করে ঘরে ফিরেই বসে পড়েন টেরারিয়াম নিয়ে।
একটি টেরারিয়াম তৈরিতে লাগে একমাস!
গাছ-গাছালি পাহাড় পর্বতের ক্ষুদ্র সংস্করণ বা মিনিয়েচার- যাই বলুন না কেন, এটি তৈরি করা কিন্তু মোটেও দু-একদিনের বিষয় নয়। কখনও কখনও দুই-তিন সপ্তাহ কিংবা মাসও পার হয়ে যায় একেকটি টেরারিয়াম তৈরিতে। এমনটিই জানালেন মনির। তবে এ সময়ের পরই যে টেরারিয়াম বিক্রির যোগ্য হয়ে যাবে, এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। শুধু জারের ভেতর নিখুঁতভাবে গাছপালা বা পাহাড় বসাতেই এতোটা সময়ের প্রয়োজন হয়। আসল কাজ তো এখনও বাকি। কেননা, ভেতরে লাগানো গাছগুলো বড় হতেও তো দিতে হবে সময়।
মনিরুজ্জামানের মতে, টেরারিয়াম বানাতে একমাসের মতো সময় লেগে গেলেও, তা বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে সময় প্রয়োজন হয় প্রায় তিন মাস। জারের ভেতর লাগানো গাছগুলো ঠিকভাবে বেড়ে উঠছে কিনা এটি নিশ্চিত না হয়ে বিক্রি করা যায় না টেরারিয়াম।
কীভাবে তৈরি হয় টেরারিয়াম?
ল্যাটিন শব্দ 'ভিভারিয়াম' থেকে আসে টেরারিয়াম শব্দটি। ভিভারিয়াম হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক বাস্তুতন্ত্র, আর টেরা মানে হলো স্থলভাগ। অর্থাৎ বদ্ধ কোনো জায়গায় স্থলভাগের বাস্তুতন্ত্র। টেরারিয়াম সাধারণত মুখ বন্ধ ও খোলা, দুই অবস্থায় থাকে। দুই ধরনের টেরারিয়ামেই মাটি, কয়লা, বিভিন্ন ধরনের পাথর, বালি, নুড়ি এছাড়া ক্যাকটাস জাতীয় গাছ, বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা, গুল্ম, ফার্ন, মস (শৈবাল) ব্যবহার করা হয়। আর প্রয়োজন যেকোনো ধরনের জার বা পাত্র। টেরারিয়াম বানানোর জন্য প্রথমেই ডিজাইন করে নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মূলত বন্ধ টেরারিয়াম নিয়ে কাজ করেন মনির। একে আকর্ষণীয় করে তুলতে মস বা শৈবাল থেকে শুরু করে বেশকিছু উপাদান দেশের বাইরে থেকে আনান প্রয়োজন অনুযায়ী। দেশীয় উপাদানের সাহায্যেও টেরারিয়াম তৈরি করা যায়। তবে একে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে ড্রাগনরক, নার্ভ প্ল্যান্ট, রিস্টুটসহ আরও বেশকিছু জিনিস প্রয়োজন হয়, এসব জিনিস দেশে পাওয়া যায় না বললেই চলে।
এছাড়া টেরারিয়াম বানাতে প্রয়োজন হয় বিশেষ ধরনের কিছু জার, সেগুলোও দেশে পাওয়া যায় না বলে জানালেন মনির। এক্ষেত্রে তার বেশ কয়েকজন বন্ধু আছেন মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে থাকেন তারা প্রথম থেকেই তাকে সহায়তা করছেন। এছাড়া অ্যাকুরিয়াম আমদানিকারকদের মাধ্যমেও বেশকিছু প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করেন তিনি।
কী ধরনের গাছ থাকে টেরারিয়ামে?
কয়েকধরনের ক্যাকটাসের মিশেলে সাধারণ যেকোনো টেরারিয়াম হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয়। অ্যাঞ্জেল উইং, লেডিফিঙ্গার, চাদ, প্যারোডিয়া ক্যাকটাসসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাস হতে পারে এর অন্যতম উপকরণ।
তবে মুখ বন্ধ টেরারিয়ামের ক্ষেত্রে ফার্ন বা মস ছাড়া সাধারণ কোনো উদ্ভিদ ব্যবহার হয় না। ফার্নের ভেতর অস্ট্রেলীয় সোর্ড, মেইডেন হেয়ার, বার্ড নেস্ট, অ্যাসপারাগাস ফার্ন, বোস্টন ফার্ন টেরারিয়ামের জন্য উপযুক্ত। মসের ভেতর ওক ক্যাম্প, মাউন্টেইন ফর্ক, ব্রুম ফর্ক মসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় টেরারিয়ামে। এছাড়া, কার্নিভারাস, এয়ারপ্ল্যান্ট ও সাকুলেন্ট ধরনের উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয় টেরারিয়াম সাজাতে।
এবার যত্নআত্তির পালা
একটা টেরারিয়াম তৈরির সময় থেকে শুরু করে ক্রেতার কাছে বিক্রির আগপর্যন্ত বিশেষ যত্নআত্তি তো রয়েছেই। কোনো গাছ বা উপাদান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিনা, এগুলোর বিষয়ে যথেষ্ট সাবধান থাকা প্রয়োজন। তবে বিক্রির পর মানতে হবে কিছু নিয়ম, এমনটি জানাচ্ছিলেন মনির। তার মতে, টেরারিয়াম বিক্রির পরও পানি দিতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী। তবে এরপর আর তেমন কোনো দায়িত্ব নেই টেরারিয়ামপ্রেমীদের।
অতিরিক্ত রোদ টেরারিয়ামের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। তাই ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে, এটি এমন এক স্থানে রাখতে হবে, যাতে অতিরিক্ত রোদ না লাগে। এসব নিয়ম মানা হলেই বছরের পর বছর টিকে থাকে একটা টেরারিয়াম।
কতদিন বাঁচে একেকটি টেরারিয়াম?
একেকটি টেরারিয়াম বিশেষ করে কত বছর বাঁচে এ নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না, তবে এ পদ্ধতিটিতে ডেভিড ল্যাটিমার নামে এক ব্যক্তির যুগান্তকারী উদ্ভাবনের কথা জানালেন মনির। ১৯৬০ সালে প্রথম একটি জারের ভেতর গাছ লাগান ল্যাটিমার। ৪৭ বছরে একবারের জন্যও জারটি খোলেননি তিনি। এতবছর পরেও জারের ভেতরের সেই গাছটি এখনও বেঁচে রয়েছে বহাল তবিয়তে। এই পুরো সময়ে ভেতরে স্পাইডার অর্টের ৪টি গাছ লাগান তিনি। তবে তার মধ্যে প্রথম তিনটি গাছই মারা যায়।
মনির আরও জানালেন, মূলত টেরারিয়ামের উৎপত্তি ১৮২৭ সালের দিকে। ডা. নেতানিয়েল ওয়ার্ড মথ ও ক্যাটারফিলার নামে দুজন উদ্ভিদবিদ এ নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণায় জারের তলানিতে ছোট ছোট ফার্ন বেড়ে উঠতে দেখেন তারা। অর্থাৎ বাতাস ছাড়াই কাঁচের ভেতর নতুন করে গাছ জন্মাতে দেখেন তারা। পরে এ পদ্ধতিটি টেরারিয়াম হিসেবে পরিচিতি পায় বিশ্বব্যাপী।
দামেও বেশ সাশ্রয়ী
টেরারিয়ামগুলোর দাম নির্ভর করে গাছ বা অন্যান্য উপকরণের ওপর। গাছ ও উপকরণ যতবেশি হবে, স্বাভাবিকভাবেই এর দাম বেশি হবে। ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩-৪ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে টেরারিয়ামগুলোর দাম।
মনির জানালেন, টেরারিয়ামের চল এখনও পর্যন্ত খুব একটা না থাকায়, এটি কেনার চেয়ে সাধারণ গাছ কিনে ফেলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বেশিরভাগ মানুষ।
পাহাড়, বাগান বা জঙ্গলের ক্ষুদ্র এ সংস্করণের নিজের ঘরে দেখতে যারা যান বা ভালোবাসেন তারা অবশ্য অর্থের বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না বললেই চলে। মনির শুধু টেরারিয়াম নয়, বিক্রি করেন কাঁচের বিভিন্ন আকৃতির জারও।
এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন
বাংলাদেশে বর্তমানে বেশকিছু অনলাইনভিত্তিক টেরারিয়াম গ্রুপ রয়েছে। তবে এখনও এ পদ্ধতিটি খুব একটা পরিচিতি না পাওয়ায়, অল্প যে ক্রেতা আছে তাদের ধরে রাখাটা বেশ কষ্টসাধ্য বলেই জানালেন গ্রুপটির কর্ণধার। তার মতে, যেহেতু টেরারিয়ামের খুব একটা ক্রেতা নেই, তাই একবার যদি কোনো কারণে টেরারিয়ামটি নষ্ট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে এ বাজারও আর থাকবে না।
মনিরের টেরারিয়াম ঢাকা'র বয়স খুব বেশি না হলেও ক্রেতার সংখ্যা যে নেহায়েত কম, তা নয়। আকর্ষণীয় ডিজাইন ও সৌন্দর্যের কারণে খুব দ্রুতই যে মন কেড়ে নিয়েছেন ক্রেতাদের তা কিন্তু বোঝা যায় তার ফেসবুক গ্রুপের রিভিউগুলো দেখলেই।
তবে মনির স্বপ্ন দেখেন, তিনি আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবেন তার টেরারিয়াম নিয়ে। বর্তমানে তার উত্তরা বাউনিয়ার বাড়িতে ছোট্ট পরিসরে যে টেরারিয়ামের তৈরির যে শোরুমটি রয়েছে, সেটিকে আরও এগিয়ে নিতে চান তিনি। উত্তরার দিকে টেরারিয়ামের ওপর একদিন বড় কোনো দোকান দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।