প্রতিদিন পানির নিচে হারিয়ে যায়, আবার জেগে ওঠে যে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ!
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত স্থাপনাটি কোনো পড়ো পড়ো প্রাসাদ নয় বা বহিঃশত্রু প্রতিরোধের উদ্দেশ্যেও নির্মিত নয়; আবার সমুদ্রপথে যাত্রা করা নাবিকদের হুঁশিয়ারি দেওয়ার জন্য নির্মিত কোনো লাইটহাউজও নয়। বরং নিঃসঙ্গ এই দ্বীপে মাথা উঁচু করে যা দাঁড়িয়ে আছে তা হলো একটি পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগার!
টয়লেটের গায়ে পরিপাটি অক্ষরে লেখা-"ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সর্বদক্ষিণের স্থাপনা হচ্ছে এই টয়লেটটি। যত্ন সহকারে ব্যবহার করুন! পরবর্তী বিকল্প ব্যবস্থা ১১ মাইল পরে জার্সিতে, ১০ মাইল পরে চৌজেতে।"
মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র দ্বীপ যেখানে মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছে, সেই মেত্রেস দ্বীপে একগুচ্ছ পাথরের গায়ে লাগোয়া অবস্থায় বসানো এই টয়লেট। জার্সি থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে কিছু দ্বীপ ও প্রাচীর মিলিয়ে সংগঠিত এই ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জোয়ার-ভাঁটা পরিসীমায় অবস্থিত।
ভাঁটার সময় এই দ্বীপপুঞ্জের স্থলভাগের আকার দাঁড়ায় দৈর্ঘ্যে ১০ মাইল এবং প্রস্থে ৭ মাইল- যা সমগ্র জার্সি অঞ্চল বা ম্যানচেস্টার শহরের চাইতেও বড়। অন্যদিকে, মাত্র ৬ ঘন্টা পরেই জোয়ারের সময় পুরো এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়! ফলে এ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের (যারা 'মিংকিস' নামে পরিচিত) এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে হয়- খানিকটা পাথুরে দ্বীপ, খানিকটা পানির নিচে, যেন স্থল ও সমুদ্রের দুদিকে দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে এর সীমানা!
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মাঝামাঝি জেগে ওঠা মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জ শুধু যে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আলাদা তা নয়, এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকার ও ডিউকদের মধ্যে ঝগড়ার বিষয়বস্তু ছিল এই অঞ্চল। নর্ম্যান, ব্রিটন ও ফরাসিদের আন্তঃকলহে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এই দ্বীপপুঞ্জ। বর্তমানে এটি জার্সি প্রশাসনের অধীনে এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হলেও, এটি যুক্তরাজ্যের অংশ নয়।
জার্সি সিফেয়ারিস নৌকার নাবিক জশ ডিয়ারিং জানান, "এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে লড়াই চলছে। কিন্তু ১৮০০ শতক থেকেই ভবনগুলো এই দ্বীপে আছে।"
জশ ডিয়ারিংস শুধু একজন নাবিকই নন, তিনি ট্যুর গাইড হিসেবেও কাজ করেন। মেত্রেসের ভূতূড়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে দেখা যাবে এর পাথুরে দালানগুলো- যেগুলোর এখন বেহাল অবস্থা এবং ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। ডিয়ারিংস জানান, লা রোকা বন্দরের জেলেরা এবং খনিশ্রমিকেরা এসব দালান তৈরি করেছিল। দ্বীপের উত্তর তীরে রয়েছে একটি হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ, উনিশ শতকে খননকাজ চলার সময় আহত খনিশ্রমিকদের চিকিৎসা দেওয়া হতো এখানে। বলে রাখা ভালো, দ্বীপের যে অংশ জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় না, ভবনগুলো সেখানেই নির্মাণ করা হয়েছিল। একই কারণে দ্বীপের এই অংশটুকুতেই শুধু সবুজের উপস্থিতি দেখা যায়- জেলেদের রোপিত এক ধরনের গন্ধযুক্ত বনজ লতা, যেগুলো তারা টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করে।
ক্ষয়ে পড়া হাসপাতালের এক জায়গায় খোদাই করা নামের আদ্যক্ষর- 'সি বিএস', তার নিচে তারিখ দেওয়া ১৮৬৫ সাল। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ ভবনই সেই সময়ে নির্মিত। বর্তমানে কিছু কটেজ এখনো জেলেরা ব্যবহার করে; বেশিরভাগই চলে গেছে জার্সির গুটিকয়েক পরিবারের ব্যক্তিগত মালিকানায়। যখন আবহাওয়া ভালো থাকে, তখন তারা মেত্রেস দ্বীপে এসে কটেজে দুয়েক রাত থাকেন। তবে এই দ্বীপটিতে কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই, নেই কোনো হোটেল বা পর্যটকদের থাকার কোনো ব্যবস্থা। হাতেগোনা যে কয়েকটি কটেজ রয়েছে, সেগুলোও বিক্রির কথা কখনো শোনা যায়নি, কটেজ মালিকেরা বরং এগুলো নিজেদের অধিকারে রাখতেই পছন্দ করেন।
একসময় বহিরাগত দখলদারদের কাছে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কারণে মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জ ছিল একটি আকর্ষণীয় জায়গা। ইতিহাসবিদ ডগ ফোর্ড বলেন, "মিংকিয়ার্সের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকবে, মাছ ধরার এলাকাও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর গত ২০০ বছর ধরে এর দ্বারা জলসীমানাও বোঝায়। উপকূলীয় প্রাচীরগুলো একটি বড় বাধা তৈরি করে, ফলে এখান থেকে জাহাজগুলোকে ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করা যায়।"
মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জকে ১৩৬০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়, এরপর এটি ফরাসি মঠের মালিকানায় চলে যায় এবং ১৪১৩ সালে রাজা পঞ্চম হেনরি পুনরায় এটিকে দখল করেন। এরপর এটি হয়ে ওঠে জলদস্যু ও চোরাচালানকারীদের প্রিয় জায়গা; এই দ্বীপপুঞ্জের নির্জনতা ও দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে তারা এখানে গুপ্ত আস্তানা গাড়ে।
১৯২৯ সালে প্যারিসের একজন ব্যাঙ্কার এখানে বাড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলে এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে একটি কূটনৈতিক সংকটের সূচনা হয়। এরপর ১৯৩৯ সালে ফরাসি শিল্পী এবং ইয়টসম্যান মারিন-মারি মেত্রেসে একটি পূর্বনির্মিত কুঁড়েঘর নিয়ে বসালে এবং দ্বীপের উপর ফরাসি পতাকা উত্তোলন করলে আবারও বিবাদ আরম্ভ হয়। ১৯৪৫ সালের ৯ মে জার্সি থেকে নাৎসি বাহিনীকে উৎখাত করার পরেও একদল জার্মান সৈন্য কয়েক সপ্তাহ এই দুর্গম দ্বীপে থেকে গিয়েছিল, কারণ তারা জানতোই না যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে!
১৯৫৩ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জের উপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব ঘোষণার আগপর্যন্ত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘ বিবাদের উৎস হয়ে ছিল এটি। কিন্তু আদালতের নিষ্পত্তি সত্ত্বেও এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে দুই পক্ষের প্রহসন শেষ হয়নি।
গত ৪০ বছরে চারবার পাতাগোনিয়া রাজ্যের প্রতিনিধি দাবিকারী কয়েকটি গোষ্ঠী এই দ্বীপপুঞ্জ 'আক্রমণ' করেছে। উল্লেখ্য যে, উনিশ শতকে চিলি ও আর্জেন্টিনায় একজন ক্ষ্যাপাটে ফরাসি আইনজীবী ওরেলি-আতোয়ান দে তুনের ঘোষিত একটি অস্বীকৃত রাষ্ট্র ছিল পাতাগোনিয়া। এক শতাব্দী পরে তার আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তারই দেশের নাগরিক, ফরাসি ডানপন্থী লেখক জঁ রাসপাইল, যিনি তার বিতর্কিত উপন্যাস 'লেকম দে ফঁসে'র জন্য বিখ্যাত। এ উপন্যাসে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে গণ-অভিবাসন প্রক্রিয়া পশ্চিমা সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করবে।
রাসপাইল ১৯৮৪ সালে মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করেছিলেন। ছোট একটি দল (যাদেরকে তৎকালীন ফরাসি গণমাধ্যম 'একদল মাতাল ফরাসি শিক্ষার্থী' বলে উল্লেখ করেছিল) নিয়ে তিনি মেত্রেসে দ্বীপে পাতাগোনিয়ার নীল-সাদা-সবুজ ত্রিরঙা পতাকা উত্তোলন করেন। এই দখলকে তিনি ব্রিটিশদের ফকল্যান্ড দ্বীপ দখলের বদলা হিসেবে অভিহিত করেন।
এরপর ১৯৯৮ সালে তিনি আবার এ দ্বীপে ফিরে আসেন এবং দ্বীপে অবস্থিত টয়লেটটিকে পাতাগোনিয়ার পতাকার রঙে রাঙিয়ে দেন। পরেরবার ২০১৯ সালে ব্রেক্সিট ইস্যুর প্রতিক্রিয়ায় তিনি একই কাজ করেন; তবে এবার টয়লেটের দরজার গায়ে এটিকে 'পাতাগোনিয়া রাজ্যের সবচেয়ে উত্তরের স্থাপনা' হিসেবে চিহ্ন এঁকে দেন। এর মধ্যবর্তী সময়ে ২০১২ সালেও একবার তিনি দ্বীপে পাতাগোনিয়া রাজ্যের পতাকা উত্তোলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেবার দ্বীপে এসে তার বাহিনী দেখতে পায়, পতাকার খুঁটির নিচে জার্সি থেকে আগত কোনো পরিবারের একটি শিশু খেলা করছে। তাই তারা টয়লেটের গায়ে পাতাগোনিয়ার ছোট্ট একটি পতাকা সেঁটে দিয়েই ক্ষান্ত হয়।
কিন্তু গ্রীষ্মের ঝলমলে বিকেলে মেত্রেস দ্বীপের বালুকাময় তীরের সৌন্দর্য্য বা সুনীল জলরাশির দিকে তাকালে কারোই মনে হবে না যে একসময় এই দ্বীপই ছিল এক রণক্ষেত্র! মাঝেমাঝে জার্সির কিছু পরিবার এখানে বার্বিকিউর আয়োজন করে, সব মিলিয়ে চমৎকার একটা আড্ডা দেওয়া যায় চাইলেই।
মেত্রেস দ্বীপে বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়বে কাঠের মধ্যে লেখা বিভিন্ন সতর্কবাণী বা দিকনির্দেশনা। কোনো জায়গায় হয়তো লেখা- "এখানে পাখিরা বাসা বাঁধছে, এই জায়গা পেরিয়ে যাওয়া নিষেধ।" আবার কোথাওবা লেখা 'এখানে শঙ্খচিল বাসা বাঁধছে, দূরত্ব বজায় রাখুন!" জশ ডিয়ারিং জানান, এই দ্বীপের শঙ্খচিলরা সাধারণ শঙ্খচিলের চেয়ে আকারে তিনগুণ বড় এবং দশগুণ রাগী! তাই দৈবাৎ এগুলো যদি কাউকে ধাওয়া করে বসে তাহলে আর রক্ষে নেই!
প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক স্যাম ব্লামপিড বলেন, "জোয়ার সীমার উপরে এবং নিচে, উভয় ক্ষেত্রেই মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জ এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের স্থান। জোয়ারের পরিসীমা বড় হওয়া মানে অনেক সময় স্রোত অনেক শক্তিশালী হয় এবং আন্তঃজোয়ার এলাকাটিও বিশাল। এর ফলে এখানে প্রাণীর আবাসের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা দেখা যায়।" তিনি গায়ের রং-পরিবর্তনে সক্ষম কাটলফিশ এবং বিরল প্রজাতির পীকক ওর্ম এর কথা জানান, যা শুধুমাত্র মিংকিয়ার্স অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
জার্সি ও এর আশেপাশের অঞ্চলের ইউনেস্কো জিওপার্ক পরিচয় নিশ্চিত করতে যে 'অ্যাসপায়ারিং জার্সি আইল্যান্ড জিওপার্ক প্রজেক্ট' হাতে নেওয়া হয়েছে, তার একটি প্রধান কারণ হলো মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ করা। প্রকল্পের প্রধান নেতৃত্বে থাকা মিলি বুটেলের ভাষ্যে, "মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জের বৈচিত্র্যতাই এটিকে অদ্বিতীয় করে তুলেছে।" আজও এই দ্বীপে শুধুমাত্র পরিদর্শক হিসেবেই আসার অনুমতি রয়েছে। হাজার বছরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত পেরিয়ে মিংকিয়ার্স দ্বীপপুঞ্জ টিকে আছে তার আপন সৌন্দর্য্য নিয়ে।
সূত্র: বিবিসি