ভালো কাজের টোপ ফেলে কম্বোডিয়ায় যেভাবে দাস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে বাংলাদেশিদের
নির্বাচন কমিশনের জন্য রাজবাড়িতে ডেটা-এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেছিলেন মাসুম বেল্লাহ। চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেকার হয়ে পড়েন তিনি।
হন্যে হয়ে চাকরির সন্ধান করার সময় তিনি এক দালালের কাছ থেকে জানতে পারলেন, কম্বোডিয়াতে একই কাজ করে মাসে ১০০০ ডলার আয় করা সম্ভব।
মহাখালীতে দালাল নাসিরুদ্দিনের 'বি ব্রাদার' নামক অফিসে বসে মাসুম শুনলেন, ওয়ার্ক ভিসা না থাকার কারণে তাকে কম্বোডিয়াতে বিজনেস ভিসাতে পাঠানো হবে।
মাসুমকে আরও জানানো হলো, তাকে ওয়ার্ক ভিসা দেওয়া হবে চাকরি শুরু করার পর থেকে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে একটি সাক্ষাৎকারের ওপর। সেই সাক্ষাৎকারটিতে নেবে কম্বোডিয়ায় থাকা নাসিরের 'প্রতিনিধি' সাজ্জাদ আল ফয়সাল।
'হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ফয়সাল একটা ছোট ইন্টারভিউ নিল। যেহেতু আগে নির্বাচন কমিশনে কাজ করেছি, তাই আমার অভিজ্ঞতা ছিল। সে আমাকে নির্বাচন করল', মাসুম বলেন।
নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে ৪০০,০০০ টাকায় চুক্তি করলেন মাসুম। ২৩ মে কম্বোডিয়াতে পৌঁছান তিনি। নম পেনের একটি গেস্ট হাউজে কয়েকদিন থাকার পর ফয়সাল তাকে উপকূলীয় শহর সিহানুকভিলে নিয়ে গেল।
'সে বলেছিল সিহানুকভিলে অনেক ক্যাসিনো আছে, আমার কাজ হবে সাধারণ অফিসের কাজের মতো। একটা ছোট ইন্টারভিউর পর আমাকে নির্বাচন করা হবে। শুনে খুশি হলাম, ভাবলাম নিশ্চিন্ত হওয়া গেল,' মাসুম বলেন।
ইন্টারভিউর দিন সকালে সিহানুকভিলের একটি ক্যাসিনোতে একজন 'চীনা' ব্যক্তি মাসুমের কাছে তার টাইপিং স্পিডসহ আরও কিছু মৌলিক তথ্য জানতে চাইলেন। সহজেই নির্বাচিত হয়ে গেলেন মাসুম।
কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কোম্পানির অফিসকক্ষে কয়েকদিন থেকেছিলেন মাসুম। এ বাংলাদেশিদের সবাই ভিন্নভিন্ন দালালের মাধ্যমে একই প্রক্রিয়ায় কম্বোডিয়া এসেছেন।
এরপর একদিন কোম্পানির একজন বড়কর্তা তাদেরকে কী কাজ করতে হবে সেটা খোলাসা করে বললেন।
'কাজটা ছিল নারীদের ভুয়া ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে রসের আলাপ করা, এবং তাদেরকে বোঝানো যে ওই নারীরা ধনী। এসবের লক্ষ্য ছিল ওই ব্যক্তিদের দিয়ে আবাবা নামক একটি প্ল্যাটফর্মে ১০০ ডলার বিনিয়োগ করানো। চুক্তিটি ছিল, কেউ যদি ১০০ ডলার বিনিয়োগ করেন, তাহলে তিনি ২০০ ডলার ফেরত পাবেন,' ব্যাখ্যা করেন মাসুম। 'আমাদের কাজ ছিল এক মাসের মধ্যে ডলার ডাবল হয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ফাঁদে ফেলা,' যোগ করেন মাসুম।
যে কাজটা তারা আশা নিয়ে শুরু করেছিলেন, ক্রমেই তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। খুব দ্রুতই মাসুম ও তার বাংলাদেশি সহকর্মীরা বুঝতে পারলেন কোম্পানিটি সাইবার প্রতারণা (স্ক্যাম) চালাচ্ছে।
কয়েকদিন পার হলো। কিন্তু তারা কোনো কাস্টমারকে ফাঁদে ফেলতে পারলেন না। কোম্পানির বড়কর্তা রেগে গিয়ে আদেশ দিলেন তারা যেন বাংলাদেশে তাদের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারকে বিনিয়োগ করতে বলে। কিন্তু দেশেও তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করল না।
কোম্পানি থেকে একটা কথা সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো- কোনো কাস্টমার আকৃষ্ট করতে না পারলে তাদেরকে বেতন দেওয়া হবে না।
মাসুম বুঝতে পারলেন তিনি যা করছেন তা-তে স্রেফ তার সময় নষ্ট হচ্ছে। তিনি ক্যাসিনোর লোকদের জানিয়ে দিলেন, চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু এতে তারা আরও রেগে গেল।
তারা মাসুমকে তার দালালের কাছে ফোন করে ৩,৬০০ ডলার পরিশোধ করে তাকে ফেরত নিয়ে যেতে বলল।
'আর তখনই আমি জানতে পারলাম ফয়সাল আমাকে এখানে বিক্রি করে দিয়েছে,' মাসুম বলেন। তিনি ফয়সালকে ফোন করে তাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে আরেকটা কাজ দেওয়ার অনুরোধ করেন। এ চাকরি ভালোমতো না চললে নতুন চাকরির সন্ধান দেওয়ারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ফয়সাল।
কিন্তু তার পরিবর্তে মাসুমের কথা শুনে ফয়সাল রেগে গেলেন।
'আপনাকে এত বেশি চালাকি করতে কে বলেছে? যখন ওরা আপনাকে নির্বাচিত করেছিল তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি এ কাজটা করতে চান কিনা,' মাসুমকে তড়পান ফয়সাল।
'আমি ফয়সালকে বললাম, চাকরিটা কিসের ছিল বা এখানে যে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন, এসব কিছুই তো আপনি আমাকে জানাননি। ফয়সাল আমাকে বলল, এখনতো জানেন, তা-তে কী হয়েছে? যান কাজ শুরু করেন!' বলেন মাসুম।
অন্য বাংলাদেশিরাও তাদের দালালদের কাছে যোগাযোগ করে একই উত্তর পেলেন। 'অনেককে বলা হলো, যদি কোম্পানির কথা না শুনে তাহলে তাদেরকে পেটানো হবে, এমনকি খুনও করে ফেলা হতে পারে,' জানান মাসুম।
মাসুম বলেন, 'দালালেরা আমাদের পাসপোর্টগুলো কোম্পানির কাছে দিয়ে প্রতিজনের জন্য ৩,৬০০ ডলার করে নিয়েছিল। তাই দালাল না আসলে কোম্পানিও আমাদের ছাড়বে না। কিন্তু এরপর ফয়সাল আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দিলো। যদিওবা কখনো ফোন ধরত, সে আমাকে গালিগালাজ করত ও হুমকি দিত।'
কোম্পানি জানাল তারা মাসুমকে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেবে। বিপদ বুঝতে পেরে বাড়িতে যোগাযোগ করে ৩,৬০০ ডলার ফয়সালকে পাঠাতে বলেন তিনি। অবশেষে মাসুমের পরিবারের কাছ থেকে ওই অর্থ পেয়ে ফয়সাল এসে তাকে কোম্পানির কাছ থেকে মুক্ত করেন।
'যেদিন কোম্পানি থেকে চলে আসছিলাম, সেদিন কোম্পানির লোকজন আমার ফোনের সব তথ্য মুছে ফেলে (ফরম্যাটেড), ফোনে থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবগুলো অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেয়। এরপর পাসপোর্টটি আমার দিকে ছুঁড়ে মারে। কিন্তু ওদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফয়সাল সেটা নিজের কাছে রেখে দেয়,' মাসুম বলেন।
২৭ জুন বাংলাদেশে ফিরে আসেন মাসুম। কিন্তু এর আগে ফয়সাল তার কাছ থেকে জোর করে একটি ভিডিও রেকর্ড করে নেন। ওই ভিডিওতে মাসুমকে হাসিমুখে জানাতে হয় তিনি স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে ফিরে আসছেন। কেবল ভিডিওটি বানাতে রাজি হওয়ার শর্তেই ফয়সাল মাসুমকে তার পাসপোর্ট ফেরত দেয়।
বাংলাদেশে ফিরে মাসুমের কাঁধে সাত লাখ টাকার মতো দেনার ভার জমল। কিন্তু দালালদের বিরুদ্ধে তিনি এখনো কোনো মামলা করেননি। কারণ ফয়সালের কাছে তার স্বীকৃতির ওই ভিডিওটি আছে বলে মামলা করলেও মাসুমের কোনো লাভ হবে বলে তিনি নিশ্চিত নন।
তবে মাসুমের ভাগ্য ভালো। কারণ তিনি খুব দ্রত ও নিরাপদে দেশে ফিরতে পেরেছেন।
প্রতারণার একই ধাঁচ
মাসুমের মতো আরও কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর। এদের অনেকেই এখনো কম্বোডিয়ায় আটকা পড়ে আছেন। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা'র (এনজিও) তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে ১,০০০-এর বেশি বাংলাদেশি কম্বোডিয়ায় গিয়েছেন।
এদের একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শামিম রেজা। তাকেও কম্বোডিয়ায় একই ধাঁচের স্ক্যাম পরিচালনা করা আরেক কোম্পানির কাছে একই দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
'আমাকে বলা হয়েছিল আমার কাজ হবে সাধারণ অফিসের কাজের মতো, আর আমাকে মাইক্রোসফট এক্সেলের কাজ জানতে হবে। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল তারা আমাকে প্রতারণা করতে বলছে,' শামীম জানান।
'আমি সেটা করতে রাজি না হলে কম্বোডিয়ায় আমার দালাল শোভন আহমেদ আমার নামে রাজ্যের গুজব ছড়াতে লাগল। তারা আমার ওপর অত্যাচার শুরু করল, শারীরিক অত্যাচারের চেয়ে মানসিক অত্যাচার বেশি। তারা আমাকে হুমকি দিলো বিদ্যুৎপৃষ্ট করে মারার। বলল বাংলাদেশে কেবল আমার লাশ ফেরত যাবে,' শামীম বলেন।
দালাল শোভন আরও ১ লাখ টাকা বেশি পাওয়ার পর শামীমকে মুক্ত করেছিল। শামীমের জায়গায় ওই ক্যাসিনোতে আরেক বাংলাদেশিকে দিয়ে এসেছিল শোভন।
গত মাসে দেশে ফিরে এসেছেন শামিম।
আরেকজন বাংলাদেশি স্কুলশিক্ষক এখন দালালের কাছ থেকে পাসপোর্ট না পেয়ে নম পেনের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে দেশে তার পরিবারও খেয়ে-না-খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
এ শিক্ষকও একই ধরনের স্ক্যামের শিকার হয়েছেন। কয়েক মাস কাজ করার পর কোনো কাস্টমারকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিন তিনি। কোম্পানির কাছ থেকে কোনো বেতনও পাননি।
টিবিএস-এর সঙ্গে কথা বলার সময় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার এ ব্যক্তি কেঁদে ফেলেন। বাড়িভাড়া দিতে না পারায় তার পরিবারকে শীঘ্রই বাসা থেকে বের করে দেবেন মালিক। এদিকে তিনি কবে দেশে ফিরতে পারবেন, সেটাও জানেন না তিনি।
'আমি দালালের কাছে পাসপোর্টটা ভিক্ষা চেয়েছি দেশে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সে দিচ্ছে না,' বলেন তিনি।
তার ও তার দালালের নাম এখানে প্রকাশ করা হলো না। কারণ তিনি মনে করেন, এমনটা হলে দালাল তাকে আরও বেশি বিপদে ফেলবে।
কম্বোডিয়ায় আটকে থাকা এরকম আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে টিবিএস। তারা সবাই নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজেদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
আইনের ঊর্ধ্বে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কম্বোডিয়ার এক প্রখ্যাত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী টিবিএসকে জানান, 'এখানকার পরিস্থিতি ভয়ংকর। তারা এক হাজার ডলার ও কম্পিউটারভিত্তিক চাকরির টোপ ফেলে বাংলাদেশিদের এখানে নিয়ে আসে। কম্বোডিয়ায় আনার জন্য তারা কয়েক হাজার ডলার নেয়। এরপর এ লোকগুলোকে তারা দুই থেকে তিন হাজার ডলারে বিভিন্ন ক্যাসিনোতে বিক্রি করে দেয়। এসব ক্যাসিনোতে এ লোকগুলো কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য আটকা পড়েন। তাদের ওপর নৃশংসা অত্যাচারও চালানো হয়।' তিনি আরও জানান কর্তৃপক্ষ যে বিষয়টি নিয়ে একেবারে অন্ধকারে তাও কিন্তু নয়।
যদি আপনি ভেবে অবাক হচ্ছেন এ বাংলাদেশিরা কেন কম্বোডিয়ার পুলিশের কাছে যাচ্ছে না, তাহলে আপনার উচিত আল জাজিরা'র সাম্প্রতিক ডকুমেন্টারি 'ফোর্সড টু স্ক্যাম: কম্বোডিয়া'স সাইবার স্লেভস' দেখা। তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, কেন পুলিশের কাছে গেলে এ ব্যক্তিদের পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণ দেশটির পুলিশদের এ স্ক্যামারদের সঙ্গে হাত রয়েছে।
কম্বোডিয়া থেকে ফেরত আসা প্রায় এক ডজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে টিবিএস। এদের কেউই এখনো কোনো মামলা করেনি। কেউ মনে করছেন, অপরাধীরা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে, আবার কেউ আদালতে যাওয়ার আগে তাদের দালালদের সঙ্গে কথা বলে টাকা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
যেমন, পাবনার মহরম আলী ও তার চাচাতো ভাইয়েরা তাদের এক আত্মীয়কে ১০ লাখের বেশি টাকা দিয়েছেন। দৈনিক বাংলা মোড়ে অবস্থিত মাশাল্লাহ ওভারসিস নামক একটি এজেন্সির মাধ্যমে তারা কম্বোডিয়া গিয়েছিলেন।
কম্বোডিয়া হতে ফেরত আসার পর থেকেই তারা ওই আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু সেই নারী এখন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদেরকে চুপ করানোর চেষ্টা করছেন।
টিবিএস-এর পক্ষ থেকে মাসুম বেল্লাহ'র দালাল নাসিরুদ্দিন ও তার কম্বোডিয়ান প্রতিনিধি ফয়সালের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। নাসিরকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অন্যদিকে ফয়সাল ফোন কেটে দিলেও বার্তার উত্তর দেন। সেখানে তিনি লিখেন, 'আপনারা কোনো প্রতিবেদন করতে চাইলে সত্যটা লিখুন, কোনো মিথ্যা তথ্য নয়। অন্যথায় আমি যথাযথ ব্যবস্থা নেব।'
শামিম রেজা'র দালার শোভন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস মন্ত্রীর
কম্বোডিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতোই। তাহলে কেন এত বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক দেশটিতে গিয়ে সাইবার স্ক্যামের শিকার হচ্ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে টিবিএস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), এবং বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (শ্রম) ফরহাদ পারভেজ বলেন, 'এ শ্রমিকেরা দূতাবাসের প্রত্যয়ন ছাড়া কম্বোডিয়া যাচ্ছেন। তারা অবৈধ অভিবাসী।'
'তারা যদি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো'র স্মার্ট কার্ড বা দূতাবাসের প্রত্যয়ন সংগ্রহ করতেন, তাহলে আমরা তাদের কর্মক্ষেত্র ওই কোম্পানিগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নিতে পারতাম। তারা ওই কার্ড সংগ্রহ করছেন বলে আমার মনে হয় না। দূতাবাস কেবল তখনই পদক্ষেপ নিতে পারে যখন তারা আমদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন বা আমাদের নজরে আসেন,' জানান তিনি।
ফরহাদ জানান, 'কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ জানালে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করি। যখন কোনো ব্যক্তিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তখন তাকে উদ্ধার করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। চীনের বিভিন্ন কোম্পানি এ শ্রমিকদের কিনে নেয় আর তাদের ফ্যাসিলিটিগুলো কারাগারের মতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবিশিষ্ট।'
যেসব বাংলাদেশি দালালেরা চীনা কোম্পানিগুলোর কাছে এ মানুষগুলোকে বিক্রি করছে তাদের সম্পর্কে জানা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তারা দৃশ্যপটের বাইরে। মাঝেমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা আমাদেরকে কিছু নাম পাঠান। কিন্তু কেবল নামের ওপর ভিত্তি করে কাউকে খোঁজা ভীষণ কঠিন। কারণ এ দালালদের কম্বোডিয়ায় কোনো জনবল কোম্পানি বা অন্যকিছু নেই। যেসব জনবল কোম্পানি দূতাবাস থেকে প্রত্যয়ন নেয় তাদের বিষয়ে আমি কখনো কোনো অভিযোগ শুনিনি।'
ক্ষতিগ্রস্থ পাঁচজন ব্যক্তির কাছে তারা বিএমইটি'র কোনো স্মার্ট কার্ড পেয়েছে কিনা তা জানতে চাইলে তারা সবাই হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেন।
এরপর বিএমইটি'র ডিজি শহিদুল আলম এনডিসি এবং জাকির হোসেনের (ডিরেক্টর অভ অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইনান্স, অনেকগুলো সূত্রের মতে বিএমইটি'র কম্বোডিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ইনি দেখেন) কাছে বিএমইটি দূতাবাসের প্রত্যয়ন ছাড়া কোনো স্মার্ট কার্ড ইস্যু করেছেন কিনা জানার জন্য টিবিএস-এর পক্ষ থেকে ফোন, ইমেইল, ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার মনে আছে প্রায় চার বছর আগে কিছু লোক কম্বোডিয়া গিয়েছিল। শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম, কারণ দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও বাংলাদেশের মতো। পরে জানতে পারি সেখানে কিছু গার্মেন্ট কারখানা আছে আর কিছু শ্রমিক সেগুলোতেই কাজ করতে গিয়েছিলেন। শুনে আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল।'
'কিন্তু এরপর আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। কেউ এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমার কাছে করেনি বা আমার নজরে আসেনি,' বলেন প্রতিমন্ত্রী।
তবে তিনি আরও জানান, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
'আমরা সবসময় বলি বিএমইটি বা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-এর পরামর্শ ছাড়া কারও বিদেশে যাওয়া উচিত নয়। কম্বোডিয়ার সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু আপানাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে আমাদেরকে জানান, আমরা পদক্ষেপ নেব,' বলেন শাহরিয়ার আলম।
ব্র্যাক মাইগ্রেশনের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, 'বিগত কয়েক বছরে, বিশেষত করোনা মহামারির আগে ও পরে, আমরা দেখেছি, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে চাকরি দেওয়ার নাম করে মানুষকে প্রতারণা করার নতুন একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।'
তিনি বলেন, (কম্বোডিয়ায় যাওয়া) অনেকে এটা জানেনও যে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও একজন অভিবাসী শ্রমিকের উচিত তিনি কোথায় যাচ্ছেন, তার বেতন, কোম্পানি আসল কিনা, ভিসা পরীক্ষা ইত্যাদি ভালো করে জেনে নেওয়া।
'এ তথ্যগুলো পাওয়া কঠিন নয়। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ চক্রগুলোকে ধরতে একত্রে কাজ করতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতারণার সংখ্যা কমবে। আমার মনে হয়, এটা এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। কিন্তু আমরা যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করি, তাহলে আরও অনেক লোক প্রতারণার শিকার হবেন,' তিনি মত প্রকাশ করেন।
যেহেতু এ শ্রমিকেরা কোনো নথিপত্র ছাড়াই কম্বোডিয়া যাচ্ছেন, তাই মোট কতজন এ পথে দেশটিতে যাচ্ছেন তার কোনো সঠিক সংখ্যা জানা নেই। 'কিন্তু আমাদের মনে হয়, যেহেতু এ ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটছে, সেক্ষেত্রে সংখ্যাটা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে,' বলেন শরিফুল।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত