বাংলাদেশের বারোমাসি আমের উদ্ভাবন ও তার পেছনের মানুষগুলোর গল্প
বাংলাদেশের বাজারে সাধারণত আম পাওয়া যায় জুলাই মাস পর্যন্ত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর সুমিষ্ট আম শেষ হয়ে গেলে হয়তো আগস্ট পর্যন্ত আশ্বিনা আমের দেখা মেলে।
আকৃতিতে বড়সড় হলেও খেতে কিন্তু বেশ টকটক এই আশ্বিনা আম। একদিক থেকে দেখতে গেলে, এ টক স্বাদ দিয়েই আশ্বিনা জানান দেয়, আমের মৌসুম বছরের মতো শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বাজারগুলোতে আমের দেখা মিলছে। আসলে, ভালোমতো খুঁজলে এখন সারাবছর জুড়েই আম পাওয়া যায়।
গ্রীষ্মের আমকে এভাবে বারোমাসি ফলে পরিণত করার পেছনে অবদান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)-এর বিজ্ঞানীদের।
এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের জন্মানো বারি-৪ জাতের হাইব্রিড আম এখন তাদের সিগনেচার ফলে পরিণত হয়েছে। নওগাঁর কৃষকেরা এ জাতটিকে দেশের আবহাওয়ায় চাষ শুরু করার পর থেকে এখন দেশের বাজারে এ আমটির জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে নওগাঁর আমচাষিরা তাদের বারি-৪ জাতের মাধ্যমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
এছাড়া কিছু কিছু চাষি ইতোমধ্যে বারি-১১ ও কাটিমন জাতের পরীক্ষামূলক উৎপাদনও শুরু করেছেন। এ আমগুলোর বারোমাস জুড়েই ফলন হয়।
আমের নতুন প্রজন্ম
কেবল এ বছরই নওগাঁর ১,৪৪৮ হেক্টর জমিতে ১৭,৩৮০ মেট্রিক টন বারি-৪ জাতের আম চাষ করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম হাইব্রিড জাতের আম।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ও নওগাঁর সর্বমোট ২,০৩১ হেক্টর জমিতে ২১,৫৬৩ মেট্রিক টন বারি-৪ চাষ করেছেন আমচাষিরা।
এখন বাজারে বারি-৪-এর জয়জয়কার হলেও, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবন করা আরও কিছু জাত আগে থেকেই ছিল।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে বারি-৩ হিসেবে বাজারে আম্রপালি ছাড়া হয়। নওগাঁর কৃষকেরা এ আমটি চাষ ও উৎপাদনে বৈপ্লবিক সাফল্য দেখিয়েছেন।
বর্তমানে আমচাষিরা বারি'র ১২টি জাত চাষ করছেন। তবে বারি-৩, বারি-৪-এর মতো অন্য জাতগুলো এত জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এসব আমের চাষ ও উৎপাদন দ্রুতই দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, এমনকি পার্বত্য জেলাগুলোতেও কৃষকেরা এ জাতগুলো বর্তমানে চাষ করতে শুরু করেছেন।
বারি'র বিজ্ঞানী ডক্টর সরফ উদ্দিন বলেন, 'পার্বত্য জেলাগুলোর ১৬,০০০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়। এসবের ৯০ শতাংশ হচ্ছে বারি-৪, আম্রপালি, ও বারি-৮ যেটি রাংগুই নামেও পরিচিত।'
রাংগুই সবচেয়ে বেশি ফলন হওয়া আমগুলোর একটি। প্রতি হেক্টরে ২৫ টন পর্যন্ত রাংগুই'র ফলন হয়। কেবল পাহাড়ি জমিতেই এ আমের চাষ হয়।
সারাবছরব্যাপী চাষ হওয়া বারি-১১ আমও এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। ফেনী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ইত্যাদি জেলায় চাষ হচ্ছে এ জাতটির।
করোনা মহামারির পর থেকে বারি আমের ছয়টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এ বছরের শুরুতে সর্বশেষ জাত বারি-১৮ ছাড়া হয়।
এগুলোর মধ্যে সংকরায়ন করা হয় বারি-১২, ১৭, ও ১৮-এর। এ ছয়টি জাত বাজারে আসার পর দেশের আমের বাজার হয়ে উঠবে আরও মিষ্টি, আরও রঙিন।
এ জাতগুলোর উৎস কী?
নির্বাচন (সিলেকশন) ও সংকরায়নের (হাইব্রিডাইজেশন) মাধ্যমে আমের নতুন জাত তৈরি করে বারি।
বারি-১, ২, ও ৩ আমের জাত নির্বাচন করা হয়েছিল। বারি-৩ তথা আম্রপালির নির্বাচন করা হয়েছিল ভারতীয় একটি জাত থেকে। বারি-১১ও একটি নির্বাচিত জাত।
বারি'র ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র সরকার জানন, 'নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা বিদেশ (দেশ থেকেও) থেকে বিভিন্ন জাত নিয়ে আসি। এরপর সেগুলোর স্বাস্থ্য, গ্রহণযোগ্যতা ও অন্যান্য দিক পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল সন্তোষজনক হলে আমরা একটি বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন দল তৈরি করি যারা সিদ্ধান্ত নেন আমটি নতুন জাত হিসেবে বাজারে অবমুক্ত করা হবে কিনা। তারা সম্মতি দিলে এটি মন্ত্রণালয়ের বীজ বিভাগে যায়। সেখান থেকে তারা ছাড়পত্র দিয়ে এটিকে অবমুক্ত করেন।'
১৯৯০-এর দশকে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম বড়সড় সাফল্য বারি-৪ জাতের উদ্ভাবন। পুরুষ ফ্লোরিডা এম-৩৮৯৬ জাত ও স্থানীয় আশ্বিনা স্ত্রী জাতের মধ্যে সংকরায়ন (ক্রসিং) করে বারি-৪ তৈরি করেন বারি'র বিজ্ঞানীরা।
'আমের মুকুলের মধ্যে এ ক্রসিং হয়ে থাকে। ফুল থেকে পুরুষ গর্ভমুণ্ড নিয়ে তা সূক্ষ্ম ব্রাশিংয়ের মাধ্যমে স্ত্রীফুলে স্থাপন করা হয়। একটি আমের জন্য কয়েক হাজার ফুলে এটি করতে হয়। আমের স্বাদ ভালো হলে আমরা পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যাই,' বাবুল চন্দ্র বলেন।
ধান বা গমের ক্রসিংয়ে বছরখানেকের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। কিন্তু আমের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন পড়ে।
বাবুল চন্দ্র জানান, ক্রসিংয়ের পর পাঁচ-ছয়বছর লেগে যায় আমের ফলন পেতে। একটি জাত তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় ১০-১২ বছর।
'আম নির্বাচনের কাজটা অনেক ভেবেচিন্তে করতে হয়। যেমন, বারি-৪-এর ক্ষেত্রে আমরা আশ্বিনাকে বেছে নিয়েছিলাম কারণ এটির ফলন দেরিতে হয়, স্বাদে একটু টক, এবং রংহীন (কেবল সবুজ)। তাই আশ্বিনার দেরিতে ফলনকে পুষিয়ে নিতে আমরা একটি রঙিন ও মিষ্টি জাত এম-৩৮৯৬ নির্বাচন করলাম,' বলেন বাবুল চন্দ্র।
বারি-৪ জাতের উদ্ভাবক বিতর্ক
আমের সংকরায়নের ওপর দেশের একমাত্র পিএইচডি গবেষক ডক্টর জমির উদ্দিনকেই দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বারি-৪ সহ বারি'র অন্যান্য জাতগুলোর উদ্ভাবক হিসেবে মানা হতো।
বারি-১৩, ১৭, ১৮ ইত্যাদিসহ অন্যান্য জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিসংবাদিত। তবে সম্প্রতি কিছু বিজ্ঞানী বারি-৪-এর আবিষ্কারকের কৃতিত্ব জমির উদ্দিনকে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
১৯৯০-এর দশতে যখন আম গবেষণাগারে বারি-৪-এর সংকরায়ন করা হয়েছিল, সে সময় বারি'র বর্তমান মহাপরিচালক ডক্টর দেবাশীষ সরকার চাঁপাইনবাবগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
'ওই সময় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও)-এর পরামর্শক ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অভ হর্টিকালচার রিসার্চের সাবেক পরিচালক ডক্টর সিপিএ আইয়ারকে আনা হয়েছিল সংকরায়নের ওই প্রকল্পটির জন্য। আরও ছিলেন সদ্য ফিলিপাইনফেরত হর্টিকালচারিস্ট ও ফলবিজ্ঞানী ডক্টর এমএ জলিল ভুঁইয়া। জলিল ভুঁইয়া ও সিপিএ আইয়ার একত্রে কাজ করে বারি-৪ জাতটি তৈরি করেন,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন দেবাশীষ সরকার।
তিনি আরও জানান, বারি-৪ তৈরি করার সময় তিনি জলিল ভুঁইয়ার দলের সঙ্গে ফলের পোকা নিয়ে কাজ করেছিলেন। 'আমি নিজের চোখে তাদেরকে বারি-৪ তৈরি করতে দেখেছি,' বলেন দেবাশীষ।
সে সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক হর্টিকালচার গবেষণা কেন্দ্রটি আম গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এটির বর্তমান প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর মোখলেসুর রহমান দেবাশীষ সরকারের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
'আম গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন ডক্টর জলিল ভুঁইয়া। তাকে দিয়েই ওই কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। তার সঙ্গে আরও ছিলেন ডক্টর দেবদাস গুহ, ডক্টর হামিম রেজা, ও ডক্টর সিপিএ আইয়ার নামক একজন ভারতীয় সংকরায়ন বিশেষজ্ঞ। এদের হাত ধরেই বারি-৪-এর সংকরায়ন শুরু হয়েছিল,' বলেন মোখলেসুর।
'আইয়ারের ভারতে ফিরে যাওয়া, এবং জলিল ভুঁইয়া সদরদপ্তরে বদলির পর সংকরায়নের দায়িত্ব পড়ে ডক্টর জমির উদ্দিনের কাঁধে,' মোখলেসুর রহমান বলেন। তিনি আরও জানান, জমির উদ্দিন যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন আমগাছগুলো ছোট ছিল। তিনি সেগুলোকে কেবল বড় করে তুলেছেন। ওই গাছগুলোতেই বারি-৪ জাতের আম ধরে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় মারা যান জলিল ভুঁইয়া। তাই তার কাজ সম্পর্কে আরও জানতে আমরা তার সহকর্মী ডক্টর হামিম রেজা'র সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি। মোখলেসুরের উল্লেখ করা অন্য সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ বা বিদেশে বাস করছেন।
ডক্টর জমির উদ্দিন এখন অবসরপরবর্তী ছুটিতে আছেন (পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ)। তিনি দাবি করেন, তার কয়েকজন সহকর্মী তার মানহানি করছেন।
'আমাকে এ নিয়ে কথা না বলতে বলা হয়েছে... আমাকে নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে (বারি'র সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ছড়াচ্ছেন)। তাই আমি আর এর মধ্যে নেই। আপনি যদি আমার কাছ থেকে বারি-৪-এর ইতিহাস শুনতে চান, তাহলে আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসতে হবে (সাংবাদিক ও বারি কর্মকর্তাদের নিয়ে),' ডক্টর জমির বলেন।
তবে আরেকটু নাছোড়বান্দা হয়ে ধরলে জমির উদ্দিন বলেন, 'এখন যেহেতু বারি-৪ ভালো করছে, এমনকি ঢাকার বারি অফিস থেকেও বলা হচ্ছে আমি এ জাত উদ্ভাবন করিনি, এটা অন্যদের কাজ। সেক্ষেত্রে তাদের উচিত অন্য কাউকে পুরস্কার দেওয়া, তা-ই না? কিন্তু তারা সেটাও করছে না।'
তিনি জানান, ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সালে বাজারে অবমুক্ত করার আগ পর্যন্ত তিনি বারি-৪-এর দেখাশোনা করেছেন।
বারি-৪-এর সংকরায়নে ডক্টর জলিল ভুঁইয়ার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে জমির উদ্দিন বলেন, 'ডক্টর জলিল যখন বেঁচে ছিলেন, তিনি নিজে এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। আম গবেষণায় আমি তার সঙ্গে কয়েক বছর কাজ করেছিলাম। তিনি এত বছর বেঁচেছিলেন, কই কখনো তো কিছু বলেননি। যদি সত্যিই তিনি বারি-৪ উদ্ভাবন করতেন, তাহলে তো তার কাছে নথিপত্র থাকত, তা-ই না?' মানুষ কী বলে সেটাতে পাত্তা দেন না জানিয়ে জমির উদ্দিন বলেন, 'আমার কাছে কাগজপত্র আছে, আর আমার আল্লাহ জানেন।'
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত