জেসন বোর্ন আর বাস্তব সিআইএ-তে বিস্তর ফারাক, কার্যক্রমের আসল খবর জানা অসাধ্য
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে পর্দায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেমাজগৎ তথা হলিউডের বদনাম রয়েছে। প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যকে অরিয়েন্টাল দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে ধরতে না পারা, লাতিন আমেরিকার জন্য একটি ধরাবাঁধা কালার গ্রেডিং- এসব সমালোচনা হলিউডের জন্য নতুন কিছু নয়।
তবে খোদ আমেরিকার প্রতিফলন হলিউডে কতটুকু হয়, তা আরেকটি বিতর্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমাগুলো নিয়ে একপেশে ন্যারেটিভ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের অনেক অনুষঙ্গ সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া, মার্কিন সামরিকবাহিনীকে অপরাজেয় হিসেবে তুলে ধরা; হলিউডের এ দিকগুলোও সমালোচকদের দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায়নি।
হলিউডের এ ধরনের প্রতিনিধিত্বের কারণে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতায়নকে অনেক ক্ষেত্রে সহজ করেছে, তেমনিভাবে দেশটির অনেক বিষয়ই বৈশ্বিক ও ঘরোয়া দর্শকের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তার একটি হচ্ছে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা- সিআইএ।
সিনেমায় আমরা সিআইএ-কে দেখি তড়িৎগতিতে ও ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করে যাওয়া একটি সংস্থা হিসেবে। কী করে না সিআইএ! মোটরগাড়ি নিয়ে অপরাধীকে তাড়া করে বেড়ানো, প্লেন বা ভবন থেকে লাফ দেওয়া, বন্দুকযুদ্ধ, ভবন উড়িয়ে দেওয়া সবই দেখা যায় সিআইএ নিয়ে সিনেমাগুলোতে।
কিন্তু এগুলোর কতটুকু সত্য? সংস্থাটির সাবেক একজন কর্মকর্তা অ্যালেক্স ফিনলে জানাচ্ছেন, 'সাধারণ নিয়মটা হলো: যদি বন্দুকের দেখা মেলে বা কোনো কিছু বিস্ফোরিত হয়, তার মানে হচ্ছে আপনার অপারেশনে বড় কোনো গন্ডগোল হয়েছে।'
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখে চলেছে সিআইএ। বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সমস্যা ও সংঘাত সমাধানে সিআইএ সম্মুখভাগে থেকে কলকাঠি নেড়েছিল। সেই ১৯৪৮ সালের বার্লিন ব্লকেড থেকে শুরু করে হালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; সর্বত্রই বিরাজমান সিআইএ।
কিন্তু সিআইএ'র এ ধরনের ইতিহাস ও কার্যক্রম, বিশেষত সাফল্যগুলো খোদ আমেরিকার সাধারণ মানুষই খুব কম জানেন বা বোঝেন। এর জন্য কিছুটা দায়ী সংস্থাটির ব্যর্থতা আর কিছুটা এটির কাজের ধরন।
১৯৪৭ সালে সিআইএ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছর ৭৫ বছর পূর্তি তথা প্লাটিনাম জয়ন্তী পালন করছে সংস্থাটি। এ উপলক্ষে সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সিআইএ পরিচালক, স্টেশন প্রধান, কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সাংবাদিক প্রভৃতি ব্যক্তিরা কেমব্রিজে একত্রিত হয়ে সংস্থাটি নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
'সিআইএ'র লক্ষ্য হলো সত্যকে জানা। এ সত্য কোনো ছোট সত্য নয়, কারও সত্য নয়, বরং আদত সত্য, কারও পছন্দের সত্য নয়। সংস্থাটির কাজ দিগন্ত পেরিয়ে তারও বাইরে অনুসন্ধান করা… এবং কোনো কিছু ঘটে যাওয়ার আগে দেশের নেতাদের তা প্রতিহত করতে সহায়তা করা,' বলেন দীর্ঘ ২৭ বছর গোয়েন্দা সংস্থাটিতে কাজ করা স্যু গর্ডন।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ বিষয়ে গর্ডন বলেন, 'আমার মনে হয় তথ্যের বিকৃতিই এখন আমাদের (সিআইএ) জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।' বর্তমানে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় তথ্য ও অপতথ্য দ্রুততার সাথে ছড়াচ্ছে। 'সিআইএকে, বিশেষত এর শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে, দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হওয়া প্রযুক্তিগত দৃশ্যপটে সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমি মনে করি, আমাদেরকে আরও ভালো হতে হবে' বলেন গর্ডন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনে। সে সময়ই প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুমানের স্বাক্ষর করা জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতির ওপর প্রভাব ফেলে এমন জাতীয় নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো দেখাশোনা করার ভার পড়ে সিআইএ'র ওপর।
এর পরের বছরগুলো সংস্থাটি নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ধ্যান-ধারণা তৈরি হয় কার বেশিরভাগ তৈরি করেছিল বিভিন্ন স্পাই উপন্যাস ও হলিউডি ব্লকবাস্টার সিনেমা। জেসন বোর্ন বা মিশন ইম্পসিবল-এর মতো জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর দৌলতে সিআইএ'র মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়ে মানুষ প্রায় অবাস্তব ধারণা লাভ করে।
হলিউডের সিনেমাগুলোতে প্রায়ই সিআইএ-কে দেখা যায় গুপ্তঘাতক, অসৎ এজেন্টের চরিত্র, বা গাড়ি নিয়ে ইঁদুরদৌড়ের দৃশ্যপটে। এটাকে সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জন সাইফার। এগুলো দেখতে ভালো লাগলেও, সিনেমার থ্রিল বাড়িয়ে দিলেও বাস্তব আলাদা বলে জানান তিনি। বাস্তব জীবনে, 'কোনো এজেন্ট বা অপারেটর তার কাজটি ঠিকঠাক সম্পাদন করার পর সেটা নিয়ে কেউ কখনো জানতে পারে না,' বলেন অ্যালেক্স ফিনলে।
ফিনলে বলেন, পপ কালচারে সিআইএকে নানভাবে উপস্থাপন করা হয়। কখনো সংস্থাটি অজেয়, আবার কখনো দুর্বৃত্তের চূড়ান্ত। আবার ক্ষেত্রবিশেষে এ দুই গুণের সমন্বিতরূপও দেখা যায়।
এ ধরনের উপস্থাপন পুরোদস্তুর অবাস্তব। সিআইএ কীভাবে কাজ করে, তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্দায় উপস্থাপন করার জন্য যে স্বচ্ছতা দরকার, সেটা ঐতিহাসিকভাবে সিআইএ কখনো দিতে চায়নি, অথবা দিতে পারেনি বলে জানিয়েছেন প্যানেলে অংশ নেওয়া আলোচনাকারীরা।
সাইফার বলেন, সিআইএ-কে রুপালি পর্দায় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কেউ হয়তো অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভালো করেন, কিন্তু এর বাস্তকতাকে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করতে এখনো কেউ পারেননি।
২০১২ সালে সেরা সিনেমা হিসেবে অস্কার জেতা 'আর্গো' ও ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া "চার্লি উইলসন'স ওয়ার" ইত্যাদি সিনেমায় সিআইএ-এর কার্যক্রমকে তুলনামূলক সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ তালিকায় আরও আসতে পারে 'থ্রি ডেজ অভ দ্য কন্ডর' (১৯৭৫), 'দ্য ব্যুরো' (২০১৫, ফরাসি সিরিজ), ও 'দ্য আমেরিকনাস' (২০১৩, মার্কিন সিরিজ) ইত্যাদির নাম।
সিআইএ'র মিশন, অপারেশনগুলো সংবেদনশীল হয়। এছাড়া সংস্থাটির নিজেদর সোর্স ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াগুলোও গোপন রাখতে হয়। এর পাশাপাশি তথ্য গোপন রাখার জন্য বিভিন্ন আইনও রয়েছে। তাই, প্যানেল আলোচকরা বলেছেন, সিআইএ'র সফল ও উল্লেখযোগ্য মিশনগুলো নিয়ে হয়তো জনগণের কখনোই জানার সুযোগ হবে না।
সূত্র: দ্য হার্ভার্ড গেজেট