স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেভাবে পশুপাখি ব্যবহার করে গোয়েন্দা মিশনের চেষ্টা করেছিল সিআইএ
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল তুঙ্গে। তখন উভয় দেশই একে অপরের ওপর নানা গোপন মিশন পরিচালনা করেছিল।
নিজেদের স্পাইদের ব্যবহারের পাশাপাশি গোপন মিশন পরিচালনার জন্য অন্যান্য পদ্ধতির অবলম্বন করত দুই দেশই। এ ধরনের বিভিন্ন মিশন অনেক বছর ধরে গোপন রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা- সিআইএ স্নায়ুযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা কবুতর ব্যবহার করে এসপিওনাজ কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষার কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপানার ছবি তোলার জন্য কবুতরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল মার্কিনীরা।
এছাড়া কাক আর ডলফিনও ব্যবহার করেছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষ। প্রশিক্ষিত কাক জানালার সিলিংয়ের ওপর আড়িপাতা'র যন্ত্র ফেলে আসতে পারত। পানির নিচে মিশন পরিচালনা করার জন্য ডলফিনকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সিআইএ।
বিবিসি'র নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদ প্রতিনিধি গর্ডন কোরেরা একবার ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে সিআইএ'র হেডকোয়ার্টারে এক জাদুঘরে গিয়ে গায়ে ক্যামেরা বাঁধা একটি কবুতর দেখতে পান। প্রসঙ্গত, জাদুঘরটি সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত নয়।
কোরেরা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দা কবুতর নিয়ে একটি বই লিখছিলেন। কিন্তু সিআইএ'র কবুতর মিশন তখনো ক্লাসিফায়েড (গোপনীয়) থাকায় তিনি বেশি কিছু জানতে পারেননি।
১৯৭০-এর দশকের মার্কিন এ অপারেশনটির কোডনেম ছিল টাকানা। কবুতরকে নতুন কোনো জায়গায় ছেড়ে দিলেও এটি ঠিকই নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে পারে। আর পাখিটির এ অবিশ্বাস্য ক্ষমতাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল সিআইএ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা প্রশিক্ষিত কবুতর ব্যবহার করে জার্মানির ভি১ রকেট লঞ্চ সাইট ও রেডার স্টেশনের খবর সংগ্রহ করেছিল।
সিআইএ'র প্রশিক্ষিত কাকগুলো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থার ভবনের জানালা থেকে ৪০ গ্রাম ওজনের বস্তু পর্যন্ত আনা-নেওয়া করতে পারত।
সংস্থাটি আরও নানাভাবে পশুপাখির ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছে কিনা তা জানার জন্য পরিযায়ী পাখিদের গায়ে সেন্সর বসিয়েও পরখ করে দেখেছিল সিআইএ। এছাড়া কুকুরকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ইলেকট্রিক ব্রেইন স্টিমুলেশনেরও পরীক্ষা চালিয়েছিল মার্কিন এ গোয়েন্দাসংস্থা। তবে এসবের বিস্তারিত তথ্য এখনো গোপন রাখা হয়েছে।
অ্যাকুস্টিক কিটি নামক একটি অপারেশনে বিড়ালের ভেতর শ্রবণযন্ত্র জুড়ে দিয়েছিল সিআইএ।
১৯৬০-এর দশকে শত্রুর জাহাজের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য বটলনোজ জাতের ডলফিনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সিআইএ। এছাড়া সোভিয়েত নিউক্লিয়ার সাবমেরিন থেকে শব্দ সংগ্রহের জন্য ডলফিন ব্যবহার করা যায় কিনা তার পরীক্ষাও চালিয়েছিল সংস্থাটি।
১৯৬৭ সালের মধ্যে পশুপাখি নিয়ে তিনটি গোপন প্রোগ্রামের পেছনে ছয় লাখ ডলার খরচ করেছিল সিআইএ। এ প্রোগ্রামগুলো ছিল ডলফিনের জন্য অক্সিগ্যাস, পাখির জন্য অ্যাক্সিওলাইট, ও কুকুর-বিড়ালের জন্য কেচেল।
এসবের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী ছিল কবুতর। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝির পর সিআইএ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা কবুতর দিয়ে কয়েকটি পরীক্ষামূলক মিশন পরিচালনা করতে শুরু করেছিল।
কবুতরের গায়ে যে ক্যামেরাটি বসানো থাকত সেটির ওজন ছিল কেবল ৩৫ গ্রাম। একটি বানাতে খরচ পড়তো তখনকার হিসেবে ২০০০ ডলার।
ক্যামেরাটি দিয়ে ১৪০টির মতো ছবি তোলা যেত। তার মধ্যে অর্ধেকের মতো ছবি ভালো মানের হতো। ছবিগুলো ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তুলত।
কবুতরের তোলা ছবিগুলো তখনকার স্যাটেলাইটের তোলা ছবির চেয়েও স্পষ্ট হতো।
সিআইএ'র পরিকল্পনা ছিল কবুতরগুলোকে মস্কো নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েত স্থাপনার আশপাশে এগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি মেমো থেকে জানা যায়, গোয়েন্দা কবুতর মিশনের জন্য লেনিনগ্রাদের একটি শিপইয়ার্ড নির্বাচন করা হয়েছিল। তখন সবচেয়ে আধুনিক সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো ওই ইয়ার্ডে তৈরি করা হতো।
প্রকাশিত নথিতে ঘটনা এখানেই শেষ। সিআইএ কখনো সোভিয়েতের ভেতরে কবুতর ব্যবহার করে মিশন পরিচালনা করেছিল কিনা তা এখনো অপ্রকাশিতই রেখেছে সংস্থাটি।
সূত্র: বিবিসি