তিমি, মরা ইঁদুর, বিড়াল নাকি কবুতর: গুপ্তচর হিসেবে সেরা কোন প্রাণী?
গত সপ্তাহে নরওয়ের উপকূলে সন্দেহভাজন রুশ গুপ্তচর হিসেবে প্রশিক্ষিত হলদিমির নামে একটি বেলুগা তিমিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রাণী অধিকার সংস্থাগুলির দাবি অনুযায়ী, এই মৃত্যু সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে ঘটেছে।
'হল' একটি নরওয়েজিয়ান শব্দ, যেটি মূলত 'হোয়েল' বা তিমি শব্দটিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। একইসাথে রুশ প্রেসিডেন্টের নামও যেহেতু ভ্লাদিমির পুতিন, তাই তার নামের সাথে মিলিয়ে তিমিটিকে ঐ নামে ডাকা হত। তিমিটিকে একটি ক্রেন ব্যবহার করে জল থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং বিশেষজ্ঞরা সেটিকে পরীক্ষা করবেন বলে একটি নিকটবর্তী বন্দরে স্থানান্তরিত করা হয়।
২০১৯ সালের নরওয়ের জল সীমান্তের কাছাকাছি প্রথম তিমিটিকে দেখতে পান জেলেরা। সে সময় এটির সাথে একটি গোপ্রো ক্যামেরা লাগানো ছিল, যেটির গায়ে 'সেন্ট পিটার্সবার্গের যন্ত্র' লেখা ছিল।
এর ফলে পশ্চিমা বিশ্বে সন্দেহ তৈরি হয়, তিমিটি হয়ত রুশ নৌবাহিনীর একটি প্রোগ্রামের অংশ ছিল, যা জলজ প্রাণীদের গুপ্তচর হিসেবে প্রশিক্ষণ দিত। তবে অন্যদের মতামত ছিল, হলদিমির হয়ত শিশুদের থেরাপি দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত ছিল।
নরওয়েজিয়ান অলাভজনক মেরিন মাইন্ডের [মহাসাগর এবং সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন রক্ষায় কাজ করে] প্রতিষ্ঠাতা সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী সেবাস্টিয়ান স্ট্র্যান্ড তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে হলদিমিরকে ট্র্যাক করছেন।
"দুর্ভাগ্যবশত, আমরা হলদিমিরকে সমুদ্রে ভাসতে থাকা অবস্থায় পেয়েছি। সে মারা গেছে, কিন্তু মৃত্যুর কারণ তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট নয়," নরওয়ের পাবলিক সম্প্রচারক এনএরকে-কে বলেছিলেন স্ট্র্যান্ড।
যদিও তিমিটির মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয় এবং সেরা গুপ্তচরদের মতো– হলদিমির কখনোই নিজের গুপ্তচর হওয়ার প্রমাণ ছেড়ে যায়নি, তার গল্প বিভিন্ন দেশের গোপনীয়তার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছে, যেখানে প্রাণীদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
হলদিমির আসলে কী ছিল?
হলদিমিরের আনুমানিক বয়স ১৫ বছর হতে পারে। যদিও একটি বেলুগা তিমির জন্য এটা তেমন কোন বয়স নয় কারণ এ ধরনের তিমি ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে ইনগয়া দ্বীপের কাছাকাছি প্রথম তিমিটিকে দেখা যায়। যা রাশিয়ার উত্তর নৌ বহর মুরমানস্ক থেকে ৪১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এ ঘটনা সে সময় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কারণ নর্দার্ন আইল্যান্ডের এতো দক্ষিণে এ ধরনের বেলুগা তিমি খুব কমই দেখা যায়। নরওয়ের গোয়েন্দা সংস্থা ঐ সময় এ ঘটনা তদন্ত করেছিল।
মৃত্যুর আগে হলদিমিরকে নরওয়ের বিভিন্ন উপকূলীয় শহরে দেখা যেত। বছরের পর বছর ধরে এটি জেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। কথিত আছে, একবার কায়াকারে পড়ে যাওয়া একটি গোপ্রো ক্যামেরাও উদ্ধার করেছিল সে। এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে তিমিটির পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এবং সেটির উত্স ও উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।
হলদিমিরের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক
ম্যারিন মাইন্ড একমাত্র সংস্থা নয়, যেটি সম্প্রতি বিখ্যাত এই বেলুগা তিমি হলদিমিরের ওপর নজর রাখছিল। ২০১৯ সাল থেকে ওয়ানহোয়েল নামে অপর একটি অলাভজনক সংগঠন নরওয়েতে উপস্থিত থেকে হলদিমিরের কার্যক্রম, আচরণ এবং জনসাধারণের সাথে যোগাযোগের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে আসছিল।
ওয়ানহোয়েলের প্রতিষ্ঠাতা রেজিনা হগ সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, হলদিমিরের মৃত্যু "প্রাকৃতিক মৃত্যু" ছিল না। ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও বার্তায় রেজিনা বলেন, "যে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে তা হলো, হলদিমিরের শরীরে কোনো ক্ষতি বা দৃশ্যমান আঘাত ছিল না মৃত্যুর সময়। বলা হয়েছে, হলদিমির হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে।"
তবে তিনি উল্লেখ করেন, হলদিমিরের শরীরে "খুব স্পষ্টভাবে রক্তপাত হয়েছে, এমন গর্ত" ছিল।
অন্য কোনো প্রাণী গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?
অতীতে এরকম বিভিন্ন প্রাণীকে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করার রেকর্ড রয়েছে। উন্নত শ্রবণ ডিভাইস এবং মিনি স্পাই ক্যামেরা আবিষ্কারের আগেই, দীর্ঘ দূরত্বে গোপন তথ্য পাঠানো একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। শতাব্দী ধরে বার্তা এবং নোট পাঠানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কবুতর (ক্যারিয়ার পিজিয়ন)।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সামরিক বাহিনী বিশেষভাবে ডিজাইন করা ক্যামেরাসহ কবুতর ব্যবহার করে নজরদারি করেছিল। পরবর্তীতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র শক্তিরা কবুতর ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি করে। ১৯৭০-এর দশকে সিআইএ-এর অপারেশন টাকানায় কবুতরদের মিনি ক্যামেরা লাগিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠানো হয়েছিল সংবেদনশীল স্থানগুলোর ছবি তোলার জন্য।
কবুতরের পাশাপাশি, বিড়াল, তিমি, ডলফিন, বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং মৃত প্রাণীও গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিআইএ একবার দাঁড়কাকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যাতে সেগুলো জানালার সিলে বাগিং ডিভাইস [গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র] লাগাতে পারে।
গোপন মিশনে ডলফিন ব্যবহার
স্নায়ুযুদ্ধের সময় (কোল্ড ওয়ার) সোভিয়েত নৌবাহিনী বিভিন্ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত করেছিল, এর মধ্যে একটি ছিল সেভাস্তোপলের আশেপাশে ডলফিনদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। মার্কিন নৌবাহিনীও মারিন ম্যামাল প্রোগ্রাম (এমএমপি) এর আওতায় ডলফিন ব্যবহার করেছিল, যেগুলো পানির নিচে নজরদারি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে ব্যবহার করা হয়।
১৯৬০-এর দশকে সিআইএ অক্সিগ্যাস (ওএক্সওয়াইজিএএস) নামে একটি প্রকল্প চালু করে, যেটির আওতায় ডলফিনদের শত্রু জাহাজে বিস্ফোরক ডিভাইস সংযুক্ত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এই প্রোগ্রামের জন্য দুটি বন্য বোতলনোজ ডলফিন ব্যবহার করা হয়েছিল।
গত বছরের একটি ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়া সেভাস্তোপলের কৃষ্ণসাগর নৌবাহিনী ঘাঁটিতে একটি স্তন্যপায়ী প্রোগ্রাম তৈরি করেছে যেটিতে ডলফিনদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শত্রু ডাইভারদের শনাক্ত ও "প্রতিরোধ" করতে।
সিআইএ'র গুপ্তচরবৃত্তি এবং মরা ইঁদুর
সিআইএ'র পরীক্ষামূলক প্রকল্প কেবল বিড়ালদের নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না।
গুপ্তচরবৃত্তির একটি সাধারণ কৌশল হল "ডেড ড্রপ", যেখানে একজন এজেন্ট একটি নির্ধারিত স্থানে একটি বার্তা বা নথি রেখে দেন, যা অন্য কেউ তুলে নেন।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়, সিআইএ'র অফিস অব টেকনিক্যাল সার্ভিসেস মরা ইঁদুর ব্যবহার করে গোপন বার্তা লুকানোর প্রস্তাব দেয়। মরা ইঁদুরের দেহ সংরক্ষণকারী এজেন্ট দিয়ে চিকিৎসা করা হত এবং সেটির ভেতরের অংশ খালি করে বার্তা, গোপন ছবি বা ফিল্ম লুকানো হত। ধারণা ছিল, বেশিরভাগ মানুষ মরা ইঁদুরের দেহ এতটাই নিকৃষ্ট মনে করবেন যে, তারা সেগুলোর কাছেই আসবেন না।
কিন্তু মাঠে পরীক্ষা করে দেখা গেল, এই কৌশলটি কিছু সমস্যা তৈরি করেছে কারণ মরা ইঁদুর মানুষের কাছে বিরক্তিকর হলেও, এটি বিড়ালদের জন্য একটি আকর্ষণীয় খাবার। গুপ্তচরদের কাছে গোপন বার্তা পৌঁছানোর আগেই বিড়ালরা মৃত ইঁদুরগুলো তুলে নিতে শুরু করেছিল।
ফলে সিআইএ এটি ঠেকাতে একাধিক চেষ্টা করে, যেমন মরা ইঁদুরের দেহে গরম সস কিংবা কায়েন মরিচ লাগিয়ে দিত যাতে বিড়ালদের জন্য মরা ইঁদুরগুলো কম মুখরোচক হয়। এই কৌশলের ফলাফল মিশ্র ছিল। অবশেষে তারা ওয়ার্মউড তেল ব্যবহার করতে শুরু করে, যেটি বিড়ালদের কার্যকরীভাবে বাধা দিতে সফল হয়।
সেরা গুপ্তচর: বিজয়ী কে?
যদিও বিড়াল ও মরা ইঁদুর ব্যবহারে কিছু সুবিধা ছিল, গুপ্তচর সংস্থাগুলো ঘুরেফিরে সেই পুরোনো গুপ্তচরের কাছেই ফিরে এসেছে, সেটি হলো কবুতর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পরিচালিত একটি অত্যন্ত সফল গুপ্তচর প্রোগ্রাম ছিল একটি কবুতরের বার্তাবাহক স্কিম, যা অপারেশন কলাম্বা নামে পরিচিত ছিল। এই কবুতরগুলো জার্মান সামরিক কার্যক্রম এবং সংবেদনশীল সামরিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করত।
অতি সূক্ষ্ম রাইস পেপারে লেখা বার্তাগুলো ছোট ক্যানিস্টারে গুঁজে কবুতরের পায়ের সাথে বেঁধে দেওয়া হত। এই গোপন বার্তাগুলোতে সাধারণত নাজি বাহিনীর চলাফেরা, নতুন নাজি অস্ত্র সম্পর্কে প্রতিবেদন এবং পরিকল্পিত রকেট আক্রমণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকত।
"অপারেশন কলম্বা: দ্য সিক্রেট পিজেন সার্ভিস" বইয়ের লেখক গর্ডন কোরেরা জানান, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে নাজি দখলকৃত ইউরোপের বোর্দো, ফ্রান্স থেকে শুরু করে কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক পর্যন্ত ১৬ হাজার কবুতর নামিয়েছিল।
এই কবুতরগুলো লন্ডনে প্রায় ১ হাজার বার্তা পাঠিয়েছিল, যে কোনও স্থান থেকে বাড়ি ফিরে আসার অদ্ভুত ও অসাধারণ ক্ষমতা ব্যবহার করে।
পাখিরা এমনিতেও গুপ্তচর প্রযুক্তিকে অনুপ্রাণিত করেছে। আগস্টে চীন একটি সামরিক গুপ্তচর ড্রোন উন্মোচন করেছে, যেটি পাখির মত দেখতে।
তবে গুপ্তচর হিসেবে সাফল্যের জন্য কবুতরকে ভুক্তভোগীও হতে হয়েছে।
ভারতের গুপ্তচর কবুতরের প্রতি আগ্রহ
২০২০ সালের মে মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের গ্রামবাসীরা একটি কবুতর ধরেছিল, যেটিকে তারা পাকিস্তানের গুপ্তচর মনে করেছিল। ধরা পড়া কবুতরটির পায়ে একটি সংখ্যা সহ রিং দেখা লাগানো ছিল।
গ্রামবাসীরা কবুতরটি স্থানীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর সেটির পায়ে থাকা সংখ্যা বিশ্লেষণের জন্য তদন্ত শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে সেটিকে একটি কোড বলে সন্দেহ করা হয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, কবুতরটি গুপ্তচর নয় এবং সেটিকে মুক্তি দেয়া হয়।
২০১৬ সালের অক্টোবরে ভারতে একটি কবুতর পাওয়া গিয়েছিল, যেটি দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে লেখা একটি হুমকির নোট বহন করছিল। কবুতরটি পাঞ্জাব রাজ্যের পাঠানকোটে ধরা হয় এবং আটক করা হয়।
২০২৩ সালের মে মাসে মুম্বাইতে একটি কবুতরকে আট মাস ধরে আটক করা হয় চীনা গুপ্তচর হওয়ার সন্দেহে। সন্দেহভাজন গুপ্তচর কবুতরের পায়ে রিং এবং পাখার তলার অংশে চীনা লেখার মতো কিছু ছিল। কর্তৃপক্ষ শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, এটি তাইওয়ানের একটি রেসিং পাখি এবং সেটিকে ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি দেওয়া হয়।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়