রাজদরবারের প্রভাবশালী নর্তকীরা যেভাবে পরিণত হয় সাধারণ গণিকায়
১৬০৫ থেকে ১৬২৭ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ভারত শাসন করেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭)। দরবারের নর্তকী নারীদের জন্য জাহাঙ্গীরের দরবার বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
রাজপরিবারের বিনোদনের অংশ হিসেবে এই সুদক্ষ নৃত্যশিল্পীরা সম্রাট ও তার অতিথিদের জন্য নাচতেন। প্রাসাদের বাইরেও যাতায়াত ছিল তাদের। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পার্বণ ও মেলায় নাচার জন্য তাদের আমন্ত্রণ করা হতো।
বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি নাচের দক্ষতার জন্য এই নারীদের খুব গুরুত্ব ছিল। তারা কিছুদূর পড়াশোনাও করতেন। পাশাপাশি বাড়তি রোজগারের জন্য যৌনসেবাও দিতেন এই নারীরা। আর নিজেদের ধন-সম্পদ জাহির করার জন্য সোনার গয়নায় পুরো শরীর মুড়িয়ে রাখতেন।
ইতিহাসে প্রথম নর্তকী মেয়েদের উল্লেখ পাওয়া যায় সপ্তম শতাব্দীতে। চীনা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জুয়ানজাং মুলতানের সান টেম্পলের নর্তকীদের দেখেন। সেখানকার নর্তকীদের নাচের প্রশংসা করেন তিনি।
নাচ শব্দটি প্রাকৃত 'নাচা'—অর্থাৎ নৃত্য শব্দ থেকে এসেছে। তবে সংগীত ও নাচের সঙ্গে যৌনতাকে যুক্ত করার জন্য এই নর্তকীদের খ্যাতি ছিল। তাদের বেশিরভাগই ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রশিক্ষণ পেত। কেউ কেউ ছিল ক্রীতদাস, বাকিদেরকে বাবা-মায়েরা বিক্রি করে দিত।
কোনো নর্তকী মেয়ে কুমারীত্ব হারালে মিসি বা নথ উতারওয়াই (নাক খোলা) নামক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু মন্দিরেই নাচিয়ে মেয়েদের দল থাকত। এই নারীদের কেউ কেউ পুরোহিত হিসেবে কাজ করত। শৈশবেই মূর্তিদের সঙ্গে এদের বিয়ে দেওয়া হতো। আর পেশার কারণে গণিকা হিসেবে সব বর্ণের পুরুষের যৌনচাহিদা মেটাতে বাধ্য হতো তারা। বাকিদের রাখা হতো মন্দিরের পুরোহিতদের উপপত্নী হিসেবে।
এ ধরনের গণিকাবৃত্তিকে প্রাক-ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো না। এমনকি অভিজাত পরিবারগুলোও মন্দিরের সেবার জন্য কন্যা উৎসর্গ করে গর্ববোধ করত। একসময় ধারণা করা হতো, কেবল মাদ্রাজেই এরকম বারো হাজার মন্দিরের পতিতা ছিল।
পশ্চিমা ভ্রমণকারীদের কাছে নাচিয়ে মেয়েরা ছিল যৌনতার মূর্ত প্রতীক ও অত্যন্ত কামোত্তেজক, সব পুরুষকে মোহিত করার ক্ষমতা আছে যাদের। সতেরো শতকের সব ভ্রমণকারীই সিংহভাগ সময় ভারতকে অপরাধের কেন্দ্রস্থল ও পতিতায় পরিপূর্ণ স্থান হিসেবে তুলে ধরেন।
কিছু বিদেশি পর্যটক অবশ্য নর্তকীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাদের একজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাজক জন ওভিংটন। তিনি প্রশংসার সুরে মন্তব্য করেছিলেন, এই নর্তকী নারীরা তাদের গতিশীল নৃত্য ও কমনীয়তা দিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে।
বিদেশি নারী ভ্রমণকারীরা অবশ্য নর্তকীদের কথা উল্লেখ করার সময় অত সহানুভূতিশীল ছিলেন না। আঙুলে আংটি, পায়ে ঘুঙুর পরে নানা 'ছলাকলায়' পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য এই নর্তকীদের তিরস্কার করেছেন তারা।
নারী পর্যটকদের কাছে নর্তকীরা ছিল অশালীন। তাদের সুর্মা দেওয়া চোখ, লাল রং করা নখ আর মেহেদি লাগানো হাত ও পা—সবকিছুকেই উত্তেজক মনে করতেন নারী ভ্রমণকারীরা।
ভারত সফরে এসে শিশুসাহিত্যিক মেরি মার্থা শেরউডও এরকম অনুভূতিই প্রকাশ করেন। তার মতে, এই ভারতীয় নারীরা ইংরেজ পুরুষদের কামুক করে তুলেছিল, গভীর প্রভাব ফেলেছিল ইউরোপীয় পুরুষদের ওপর।
মেরি মার্থা শেরউড তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বিপরীত লিঙ্গের ওপর, এমনকি ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া মানী পুরুষদের ওপরও এই নর্তকী নারীদের প্রভাব ছিল সীমাহীন। তার মনে হয়েছিল, পুরুষদের ওপর এই নারীদের অতিপ্রাকৃত কোনো প্রভাব আছে। মেরি মার্থা শেরউডের মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, ভারতবর্ষের নর্তকীরা ইউরোপের পুরুষদের জাদুটোনা করেছিল।
মেরি মার্থা শেরউডের মতে, নর্তকী মেয়েরা পুরুষদের প্রলুব্ধ করত। তাদের আহ্বান পুরুষদের পক্ষে ফেরানো সম্ভব ছিল না। নেচে-গেয়ে তারা পুরুষদের মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলত।
নর্তকী মেয়েরা যে ঔপনিবেশিক নারীদের জন্য যৌন হুমকি হয়ে উঠেছে সে ব্যাপারে মেরি মার্থা শেরউডের কোনো সন্দেহ ছিল না।
উনিশ শতকের শেষের দিকে নর্তকী মেয়েদের নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে ওঠে। যৌন অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ধর্মীয় পুস্তিকা তাদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালাতে থাকে।
বোম্বে থেকে ছাপা 'সুবোধ পত্রিকা' পত্রিকায় লেখা হয়, 'সোজাসাপটা ভাষায়, এই নারীরা এক শ্রেণির বেশ্যা। তাদের পেশা অনৈতিক এবং তারা অসৎ জীবনযাপন করে।'
'ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার' নামক পত্রিকা তো অভিযোগ তোলার বেলায় আরেক কাঠি সরস ছিল। পত্রিকাটিতে লেখা হয়:
'আমরা স্বচক্ষে দেখেছি, এই নারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে নামীদামি মানুষদের বলয়ে প্রবেশ করেছে এবং পুরুষরা তাদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করছে। আর বাড়ির নারীরা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছে। এই সামাজিক রঙ্গলীলায় তারা অংশ নিচ্ছে না। সেখানে নর্তকীরাই ছিল একমাত্র নারী অংশগ্রহণকারী।'
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে নর্তকী মেয়েদের সঙ্গে রাজকন্যাদের মতো সম্ভ্রমপূর্ণ আচরণ করা হয় বলে আপত্তি তুলেছিলেন একজন লেখক। তিনি অভিযোগ তোলেন, নর্তকীদের কিছু গান আপত্তিকর ও অশ্লীল। আর তাদের যেসব মূল্যবান রত্ন বা গয়ান উপহার দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল বিপুল অর্থ অপচয়ের নামান্তর।
মাদ্রাজের গভর্নরের গার্ডেন পার্টিতেও চারটি নর্তকী দল থাকত। শহরের গৃহিণীরা অভিযোগ তোলেন, তাদের স্বামীরা প্রায়ই তাদের ফেলে নর্তকীদের কাছে চলে যাচ্ছেন আমোদফুর্তির জন্য।
এদিকে কিছু মানুষ ধীরে ধীরে নর্তকীদের ওপর থেকে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। ১৮৮২ সালে স্বাস্থ্য ফেরানোর জন্য প্রাচ্য সফরে বেরোন ওয়াল্টার রাইল্যান্ড। দিল্লিতে পৌঁছার পর তিনি নর্তকীর নাচ দেখার আমন্ত্রণ পান। ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি দেখেন ছয়-সাতশো পুরুষের মাঝে একটি মাত্র মেয়ে নাচছে। ওই নাচের অনুষ্ঠানকে তার কাছে একেবারেই সাদামাটা লাগে। রাইল্যান্ড বলেন, ওই নাচ দেখার অভিজ্ঞতা তার কাছে রীতিমতো একঘেয়ে আর জবরদস্তিমূলক লেগেছে।
উপনিবেশপূর্ব ভারতে নানা রকমের দক্ষতা ও গুণের জন্য যে নর্তকীরা প্রশংসা ও মূল্য পেত সময়ের পরিক্রমায় তাদের মর্যাদা কমে আসে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে ভারতে নর্তকী মেয়েরা সম্মানিত শিল্পী থেকে সাধারণ পতিতায় পরিণত হয়। একসময় তাদের নাচকে দেখা হতো উচ্চ গুণমানসম্পন্ন কলা হিসেবে, ব্রিটিশ আমলে তা বিবেচিত হতে থাকে যৌন উত্তেজক হিসেবে।
নর্তকীদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাবের এই পরিবর্তনের দায় খানিকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ সৈন্যদের ওপরও বর্তানো হয়। কারণ ব্রিটিশ সৈন্যরা নর্তকীদের উপপত্নী হিসাবে গ্রহণ করে, কিন্তু বিনিময়ে সম্মানী দিত খুব সামান্য।
- সূত্র: লাফামস কোয়ার্টারলি