এশিয়ার যে ৪ দেশে সবচেয়ে সস্তায় পড়াশোনার সুযোগ পান আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা, সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল শহর এবং সবচেয়ে উঁচু ভবনের খ্যাতিও এশিয়া মহাদেশের দখলে। সম্প্রতি কয়েক দশকে এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনীতি ও জনসংখ্যা, দুটোরই প্রসার ঘটায় বহু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এখানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এশিয়ার সবচেয়ে সাশ্রয়ী দেশগুলোতে বছরে সর্বনিম্নে ২,৯০০ ডলার ব্যয় করেই উন্নত শিক্ষালাভ করা সম্ভব।
শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে যে পারদর্শীতা দেখাচ্ছে এবং সেই সাথে এশিয়া মহাদেশে বিভিন্ন সুযোগ তৈরি হচ্ছে বিধায় এ দেশগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিভাদের স্বাগত জানাতে উন্মুখ হয়ে আছে।
এশিয়ার দেশগুলো এক্ষেত্রে যতটা লাভবান হচ্ছে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও এই দেশগুলো থেকে সমপরিমাণই লাভবান হচ্ছে। পাশ্চাত্যের বা এশিয়ারই প্রতিবেশী কোনো দেশের শিক্ষার্থী যদি নতুন অভিজ্ঞতা লাভের জন্য এ দেশগুলোতে আসতে চান, তাহলে একবার ভাবুন, সিমেস্টারের মাঝামাঝি সময়ের ছুটিতে হিমালয়ে ট্রেকিংয়ে যাওয়া, দক্ষিণ চীন সাগরের স্বচ্ছ জলে ডুব দেওয়া এবং জনপ্রিয় কে-পপ সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ এশিয়া ছাড়া আর কোথায়ই বা মিলবে!
তবে শুনতে যতই উত্তেজনাকর লাগুক না কেন, বিদেশে বিনাপয়সায় পড়ালেখা করা সম্ভব না (যদি না আপনি বৃত্তি লাভ করেন)। এছাড়া সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরই টিউশন ফি, বাসা ভাড়া, খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ থাকে। তবে চিন্তার কিছু নেই, আপনার বাজেট যদি খুব কমও হয়, তবুও এশিয়ার কয়েকটি দেশে সেই স্বল্প খরচেই পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবেন। টিউশন ফি এবং জীবনযাপনের ব্যয়ের উপর ভিত্তি করে এশিয়ার সবচেয়ে সাশ্রয়ী ৪টি দেশ সম্পর্কে জানাবো আজ।
১. তাইওয়ান
তালিকার প্রথম অবস্থানেই রয়েছে তাইওয়ান যারা 'এশিয়ার বাঘ' নামেও পরিচিত! বার্ষিক মাত্র ৪,০৫০ ডলার টিউশন ফি'তেই পড়া সম্ভব বলে তাইওয়ান আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
কিন্তু পড়াশোনার ব্যয় কম মানেই যে এখানে হযবরল অবস্থা, তা কিন্তু নয়! কিউএস হাইয়ার এডুকেশন সিস্টেম স্ট্রেংথ র্যাংকিংয়ে তাইওয়ানের অবস্থান ১৯তম। সর্বশেষ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে তাইওয়ানের ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষ ৫০-এর মধ্যে রয়েছে ৫টি। র্যাংকিংয়ে সবচেয়ে এগিয়ে, ১৯তম অবস্থানে রয়েছে ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি (এনটিইউ)। প্রযুক্তি শিল্প খাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্যও এনটিইউর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।
এছাড়া, তাইওয়ানে আবাসন খরচও খুব বেশি নয়। বসবাসের জন্য বছরে গড়ে ২,৯০০ ডলারেই হয়ে যায়। একক রাইড খরচ শুরু হয় ২০ এনটি ডলার (নিউ তাইওয়ান ডলার) থেকে ৬৫ এনটি ডলার পর্যন্ত। লোকাল রাইস, নুডলস, স্যুপ বা ডাম্পলিংস ডিশগুলোও ১০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
২. মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত যদি নিয়ে থাকেন, তাহলে এখনই ক্যাম্পাসের বাইরে অসংখ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান! পেনাং এর মতো ঔপনিবেশিক শহর থেকে শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন রেইনফরেস্ট এবং অদ্ভুত সুন্দর সমুদ্রসৈকত... সবকিছুই আপনাকে এক নতুন জগতে নিয়ে যাবে!
বিশ্বের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মালয়েশিয়ার অংশীদারিত্ব রয়েছে, যেমন- যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়, যারা কিনা শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যে বসবাসের অত্যাধিক খরচ বহন করা ছাড়াই যুক্তরাজ্যের ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
কিন্তু মালয়েশিয়াকে উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নেওয়ার পেছনে আরও যুক্তি রয়েছে। মালয়েশিয়ার থাকা-খাওয়ার খরচ অনেক কম। ২০১৬ সালে ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে 'কিউএস বেস্ট স্টুডেন্ট সিটিস'র তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর। মালয়েশিয়ায় মোটামুটি স্বচ্ছন্দ্যে থাকতে একজন শিক্ষার্থীর বছরে মাত্র ৩,৫৫০ মার্কিন ডলার প্রয়োজন হয়। প্রতি শিক্ষাবছরে টিউশন ফি লাগে গড়ে ৪,০০০ মার্কিন ডলার, এমনকি কিছু কিছু কোর্সের ব্যয় আরো কম।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী শহর হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে কুয়ালালামপুর। ২০২১ সালের কিউএস বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংসকিংয়ে মালয়েশিয়ার ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, যার মধ্যে শীর্ষ একশোর মধ্যে ছিল সাতটি। এগুলোর মধ্যে ইউনিভার্সিটি মালয়া বিশ্বে ৭০তম স্থান অধিকার করে।
৩. ভারত
তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা ভারতে জীবনযাপনের ব্যয় বাড়তে থাকলেও, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ারসহ এশিয়ার আরও অনেক দেশের চেয়ে তা এখনো কম। বিশ্বের অন্যসব দেশের মতোই ভারতেও রাজধানীতে থাকার খরচ তুলনামূলক বেশি, কিন্তু ছোট শহরগুলোতে তা হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে।
কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং অনুযায়ী, ভারতে একজন শিক্ষার্থীর জীবনযাপনের ব্যয় বছরে গড়ে ৪,৬০০ মার্কিন ডলার, যাতায়াত ব্যয়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয়দের মতো স্ট্রিট ফুড বা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে হরেক রকম খাবার কিনে খেলে খাওয়ার খরচ বাঁচানোও সম্ভব।
আবার যদি গণপরিবহনে যাতায়াত করেন তাহলে একবারে মাত্র ০.২৯ ডলার খরচ হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার মানের উপর ভিত্তি করে টিউশন ফি'র পার্থক্য হয়। সাধারণত, এক বছরে গড়ে ৭,৮৮০ মার্কিন ডলার টিউশন ফি দিতে হয় শিক্ষার্থীদের।
ভারত যে শুধুমাত্র বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যাবহুল দেশ তা ই নয়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিক্ষাব্যবস্থাও রয়েছে এই দেশটির। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্যারিয়ারে উন্নতির পথ সুগম করবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত কয়েকজন উদ্যোক্তাও ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই উঠে এসেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন অ্যালফাবেট এর সিইও সুন্দর পিচাই এবং ফ্লিপকার্টের প্রতিষ্ঠাতাদ্বয় শচীন বানশাল ও বিনি বানশাল।
যদিও ভারতের প্রধান ভাষা ইংরেজি নয়, কিন্তু ভারতের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে পড়ালেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে।
৪. ইন্দোনেশিয়া
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার ৮০ শতাংশ মুসলিম ইন্দোনেশিয়ায় বাস করেন এবং এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ায় বৈচিত্র্যের অভাব নেই, দেশটিতে রয়েছে কয়েকশো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-সম্প্রদায় এবং বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে ইন্দোনেশিয়া হয়ে উঠেছে একটি বন্ধুবৎসল ও সুখী দেশ। পর্যটকদের কাছে ইন্দোনেশিয়ার আবেদন বরাবরই চোখে পড়ার মতো। দেশটিতে রয়েছে প্রায় ১৭,০০০ দ্বীপ, পর্বতমালা, রেইনফরেস্ট এবং শান্ত-সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও মন্দির।
১৯৪৫ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ইন্দোনেশিয়ায় উচ্চশিক্ষার ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ায় এখন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০০০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৫০ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সর্বশেষ এশিয়ান র্যাং কিংয়ের শীর্ষ ৩৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এর মধ্যে গাজাহ মাদা বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭তম অবস্থানে রয়েছে।
বর্তমানে দেশটিতে ৬০০০ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। এদের অনেকেই এসেছে প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে। ইন্দোনেশিয়া শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দ হয়ে ওঠার কারণ রয়েছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার ভাষা শেখাও খুব কঠিন নয়। কিন্তু দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের টানে সৌন্দর্য্যপিপাসুরা এখানে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হন।
ইন্দোনেশিয়ায় পড়ালেখার খরচও সস্তা। দেশটিতে এক বছর থাকার জন্য গড়ে ৮,৫০০ মার্কিন ডলার ব্যয় হয়। টিউশন ফিও সর্বনিম্ন ২,৪০০ থেকে ধরা হয়।
সূত্র: ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ