পুলিৎজারজয়ী ইলাস্ট্রেটর, ও স্টোরিটেলার ফাহমিদা আজিমের গল্প
২০০১ সালে ছয় বছর বয়সী ফাহমিদা আজিম বসবাসের উদ্দেশ্যে পরিবারের সঙ্গে পাড়ি দেন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে।
নতুন দেশের নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল ফাহমিদার। তখন তার মনে হতো, আমেরিকার সবকিছুই যেন সাময়িক ব্যবহারের জন্য বানানো। আর বাংলাদেশে ঠিক এর বিপরীত; এখানে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার জন্যেই যেন সবকিছু তৈরি করা হয়।
ফাহমিদা আজিম একজন ইলাস্ট্রেটর, লেখক এবং স্টোরিটেলার। এ বছর ইলাস্ট্রেটেড রিপোর্টিং অ্যান্ড কমেন্টারি বিভাগে তার দলের আরও তিনজনের সঙ্গে পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এ তিনজন হলেন অ্যান্থনি ডেল কোল, জশ অ্যাডামস এবং ওয়াল্ট হিকি। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত 'হাউ আই স্কেইপড আ চাইনিজ ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প' শীর্ষক ইলাস্ট্রেটেড প্রতিবেদনের জন্য এ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জেতেন তারা।
একজন উইঘুর মুসলিম নারীর নির্যাতনের শিকার হওয়া নিয়ে তৈরি এ প্রতিবেদনটি গতবছর ডিসেম্বর মাসে যুক্ত্ররাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ইনসাইডার-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, দ্য ইন্টারসেপ্ট, গ্ল্যামার এবং ভাইসসহ আরও অনেক পশ্চিমা ম্যাগাজিনে ফাহমিদা আজিমের আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
ফাহমিদা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পুলিৎজারজয়ী দ্বিতীয় ব্যক্তি। তার আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ছবি এঁকে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে পুলিৎজার জেতেন মোহাম্মদ পনির হোসাইন।
ফাহমিদার জন্ম ফেনী জেলার মহিপালে। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার পর তিনি কিছুদিন থাকেন দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে, তারপর ভার্জিনিয়া রাজ্যে হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন।
এরপর ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটি স্কুল অভ দ্য আর্টস থেকে তিনি চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ফাহমিদা বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির সিয়াটল শহরে বাস করছেন।
ফাহমিদা মনে করেন, জীবনের শুরুর দিক থেকেই তার মাঝে আছে ইলাস্ট্রেটরের এক সত্তা। ছোট থাকতে নিজের বানানো গল্পের জন্য আঁকতেন নানা চরিত্র।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে ফাহমিদা উল্লেখ করেছেন, তিনি বাস্তব জগতের অসাধারণ জীবনযাপন করা মানুষ আঁকতে যেমন উপভোগ করেন, তেমনি ভালোবাসেন সুন্দর ও সাধারণ জীবনযাপন করা কাল্পনিক মানুষ আঁকতে। এছাড়া খাবারের ছবি আঁকতেও তিনি বেশ পছন্দ করেন। ওয়েবসাইটটিতে প্রকাশিত বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন দেখলে আঁকার ক্ষেত্রে তার এ পছন্দনীয় বিষয়গুলোর প্রমাণ মেলে।
শুরু থেকেই কেবল এ বিষয়গুলোতেই তার অনুপ্রেরণা ছিল নাকি কখনো বদলেছে- এ প্রশ্নের উত্তরে ফাহমিদা জানান, মানবীয় সম্পর্ক নিয়ে তার সবসময় আগ্রহ ছিল। তিনি বলেন, 'দেখা যেত, যে বইগুলো পছন্দ করতাম, সবই মানুষের সম্পর্ককে ঘিরে লেখা। চরিত্রগুলো এমন ছিল যে প্রেমে না পড়ে থাকতে পারতাম না।'
'ছোটবেলায় সায়েন্স ফিকশন এবং ভ্যাম্পায়ার দ্বারা অণুপ্রাণিত ছিলাম। আমার ভালো লাগত ডার্ক, ভুতুরে গল্পগুলো। তারপর কমিক বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। একসময় অনুধাবন করলাম মানবতার সাথে সম্পৃক্ত বলেই এই জঁরাগুলো আমাকে বেশি টানত।'
'আমার আঁকা ছবিগুলোতে থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রের সাজাপ্রাপ্ত অ্যাক্টিভিস্ট। অথবা থাকে নাটকীয় এবং ভয়ংকর পরিস্থিতির বর্ণনা। এ ধরনের ছবিগুলো আমাকে সুসংহত ও সচেতন থাকতে সাহায্য করে।'
ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ শুরু
ইলাস্ট্রেশন তথা অলংকরণের কাজ শুরু করার প্রাথমিক দিকে ফাহমিদা ছোটখাটো অনেক কাজ করছিলেন। তবে এসবের ভিড়ে ভুলে যাননি নিজের স্বপ্নকে; পাশাপাশি প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন তার স্বপ্নের কাজ 'সম্পাদকীয় ইলাস্ট্রেশন' করার জন্য।
ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আপনি যখন কাজ শুরু করবেন, সব ধরনের কাজ করতে হবে। ইলাস্ট্রেশন একটি খুব 'নির্মম' কাজের ক্ষেত্র, রহস্যময়ও বটে। এখানে কোন ধরনের পোর্টফোলিও বানানো উচিত তা বুঝে ওঠা দায় এবং অধিকাংশ কাজ ফ্রিল্যান্স বলে এই পেশাটি চালিয়ে যাওয়াও বেশ কষ্টের।'
এই লাইনের কাজে নিজের জায়গা করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, 'যাদের সাথে কাজ করেছেন তাদের সঙ্গে যদি ভালো সম্পর্ক বজায় থাকে এবং একটি অসাধারণ পোর্টফোলিও থাকে, আপনি যে ধরনের কাজ পছন্দ করেন, তা-ই করতে পারবেন।
বই প্রকাশনায় যুক্ত হওয়ার জন্য আমি সম্পাদকীয় ইলাস্ট্রেশনকে কাজে লাগিয়েছি, আর এ প্রকাশনা থেকে যে পরিমাণ অর্থ আসে তার সুবাদে আমি সম্পাদকীয় ইলাস্ট্রেশনে মনযোগ দিতে পারি।'
ফাহমিদার প্রথম উপার্জন আসে মার্কিন লেখক লেনি ডানহ্যামের প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ফেমিনিস্ট লিউজলেটার লেনি লেটার-এর জন্য করে দেওয়া একটি কাজের মাধ্যমে। কাজটি ছিল একজন নাইজেরিয়ান আমেরিকান নারীকে নিয়ে যার নাইজেরিয়াতে নিজের একটি টিভি শো ছিল।
প্রথম কাজটির কথা স্মরণ করে ফাহমিদা বলেন, 'এটি আমার সবচেয়ে ভালো কাজ ছিল না কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টা ছিল।' এরপর তিনি দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ান নামক একটি স্বাধীন, অলাভজনক সংবাদ সংস্থার জন্য আরেকটি প্রজেক্টে কাজ করেন।
২০২১ সালে ফাহমিদা শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে ভিজ্যুয়াল যোগাযোগ নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভত্তিক কমিউনিকেশন গ্রুপ পজিটিভনেগেটিভস-এর সাথে কাজ করেন।
পজিটিভনেগেটিভস-এর সাথে করা তার কাজ নিয়ে তিনি সাগ্রহে বলেন, 'তারা আমাকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর একটি মাল্টিমিডিয়া কমিক তৈরি করতে দেয়। আমার সাথে প্রজেক্টটিতে ছিলেন কয়েকজন ডেটা সায়েন্টিস্ট। আমরা ইনফোগ্রাফিক্সস বানাই। ইলাস্ট্রেশনগুলোর নড়াচড়া দেখাতে আমরা ভিডিও ফুটেজ এবং ওয়েব ডিজাইনের সাহায্য নিয়েছিলাম। সবার দক্ষতার সমন্বয়ে এটি ছিল অনন্য এক অভিজ্ঞতা।'
ফাহমিদা সিয়াটলে একজন সম্পাদকের জন্য কাজ করতেন। সেই সম্পাদকই তাকে একজন লিটারারি এজেন্ট নেওয়ার পরামর্শ দেন এবং পরে ফাহমিদা লিলি গাহরেমানিকে নিজের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন।
'মুসলিম উইমেন আর এভ্রিথিং' এবং পুলিৎজার জেতার গল্প
প্রথমবারের মতো ফাহমিদার বইয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয় ২০২০ সালে। ড. সীমা ইয়াসমিনের লেখা 'মুসলিম উইমেন আর এভ্রিথিং' বইয়ে ফাহমিদা প্রথম কাজ করেন। এ বইটি 'কী করতে পারবে, কী পারবে না' এই ধরাবাঁধাতে বন্দী ৪০ জন মুসলিম নারীর গল্পকে ঘিরে, যারা তাদের চারপাশের স্টেরিওটাইপ ভাঙতে চান।
বইটি ২০২১ সালে ইন্টারন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড-এ জয়ী হয়।
ফাহমিদা বলেন, 'সাংবাদিকতায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি গণমাধ্যমে মুসলিম নারীদের অমানবিকভাবে তুলে ধরা হয়। তাই, সীমা এবং আমি এমন একটি বই নিয়ে কাজ করেছি যেখানে দেখা যাবে মুসলিম নারীরা সব ধরনের কাজ করছেন। আমরা দেখাতে চেয়েছি আমরা মনোলিথ নই।'
ফাহমিদার ছোট বোন নাচ শিখতে চাইলে তার মা-বাবা প্রথমে রাজি হননি। তা দেখে ফাহমিদা 'মুসলিম উইমেন আর এভ্রিথিং' বইটি বাবা-মায়ের সামনে তুলে ধরে বলেন, সে চাইলে অবশ্যই নাচ শিখতে পারবে।
গণমাধ্যম ও বইসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্রাউন ও মুসলিম নারীদের ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ফাহমিদা বলেন, 'যখন আপনি একটি বই পড়ছেন বা কোনো শো দেখছেন, তখন আপনি নিজেকে অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ যাতে করে আমরা আমাদের নিজস্ব ন্যারেটিভকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি ও আমাদের নিজস্ব সম্ভাবনাগুলো দেখতে পারি।'
ফাহমিদার কাছে যখন 'হাউ আই এস্কেপড আ চাইনিজ ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প'-এর লেখক যোগাযোগ করলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন অন্য কাজের চাপে তিনি এ কাজটা করতে পারবেন না।
কিন্তু যখন ওই লেখক জানান তিনি এর আগে আরও দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু তারা চাকরি বা জীবনে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কায় তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তখন ফাহমিদা প্রজেক্টটি শেষ করার জন্য মুখিয়ে উঠলেন।
'আমার মাথা গরম হয়ে গেল। এটা ঠিক নয়, আপনি মানুষের জীবন বা চাকরি নিয়ে হুমকি দিতে পারেন না। উইঘুরদের ওপর অত্যাচার আর অন্যান্য ইলুস্ট্রেটরদের এভাবে চুপ করিয়ে দেওয়া আমাকে শক্তভাবে আঘাত করে। আমি আর তখন অন্য কিছু ভাবিনি। ঠিক করে ফেললাম, আমার সবটুকু এ প্রজেক্টে উজাড় করে দেব,' তিনি বলেন।
মৃদু হেসে যোগ করলেন, 'আমার হাতের বারোটা বেজেছিল বটে, কিন্তু কাজটা তো করতে পেরেছি! আমি খুবই খুশি যে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয়েছে।'
পুলিৎজারের জন্য নমিনেশনের কথা জানতে পারার পর এত বড় খবরটা অন্যদের জানাতে ফাহমিদার একটু লজ্জা লাগছিল। অন্যদের বললে যদি কারও 'মুখ লেগে' যেত।
জেতার মুহূর্তটির কথা জানতে চাইলে উল্লাসের সঙ্গে তিনি বলেন, 'সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পরে শুধু পুরস্কার অনুষ্ঠানের রেকর্ড করা শোটি দেখব। কিন্তু আমার বন্ধুরা সরাসরি সম্প্রচারটাই দেখিয়েছিল। জিতেছি জানতে পারার পর তো আমার বাকরুদ্ধ অবস্থা! একের পর এক ফোন আসতে থাকল।'
তার ভাষায় জেতার পরের অভিজ্ঞতা, 'একটু অদ্ভুত কিন্তু ভালো। সবাই যখন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করার কথা জানাচ্ছিল, খুব ভালো লাগছিল। আমাকে নিয়ে কারও উল্লাসে আমি সাধারণত অভ্যস্ত নই।'
একটু ব্যঙ্গ করে বলেন, 'মা-বাবা আমার ডাক্তার খালাতো ভাই-বোনদের চেয়ে আমাকে নিয়ে রাতারাতি অনেক বেশি গর্বিত হয়ে গেলেন।'
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'নিজের সম্ভাবনার সীমানা জানার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি খুবই খুশি যে বাংলাদেশে অনেক তরুণ পরিশ্রমী আর্টিস্ট আছেন।'