চারদিকে ডটকম: কোরিয়ান সংস্কৃতিতে মজে থাকা এক বাংলাদেশির কোরিয়ান পণ্যের অনলাইন বাজার
শুরুটা হয়েছিল নতুন একটি ভাষা শেখার আগ্রহ থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সারোয়ার কামাল বিশ্ববিদ্যালয়টির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট-এ (আইএমএল) কোরিয়ান ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হন। ভাষাটি শেখার তিন বছরের মাথায় তিনি একটি স্কলারশিপ পেয়ে কোরিয়ার সিউলের কিয়াং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমেস্টার পড়তে চলে যান।
ওই প্রোগ্রামটিতে শিক্ষার্থীদের কোরিয়ান ভাষা শেখার ব্যবস্থা ছিল সকালবেলায়। আর দিনের বাকি অংশে তাদেরকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হতো। সপ্তাহান্তে এ শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা সফরে যেতেন। আর এসব কিছুর খরচ বহন করত কোরিয়ান সরকার।
'আমি সব সময় কোরিয়ান সংস্কৃতি, ভাষা, ও খাবারের বিষয়ে মুগ্ধ ছিলাম। আর ওই তিন মাস আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ম্যাজিক্যাল সময় কাটিয়েছি,' ১০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করেন সারোয়ার।
কোরিয়ায় পড়ালেখার ওই তিন মাস সারোয়ার কামালের কোরিয়ান সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই বাড়েনি কেবল, বরঞ্চ এনিয়ে তার নিজের কিছু করার সাহস যুগিয়েছিল সফরটি। সেই সাহস থেকেই তিনি তৈরি করলেন কোরিয়ান প্রসাধনী পণ্যের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চারদিকে ডটকম (Chardike.com)।
তবে সারোয়ারের জন্য এই পথটা সোজাসাপটা ছিলনা। তিনি কখনো কাজ করেছেন কোরিয়ার প্রথম সারির ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড শিনসিগি'র সঙ্গে, আবার কখনো পোশাক রপ্তানির আদেশের জন্য ঘুরেছেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়।
এরপর বাংলাদেশে ফিরে এসে পিডিএস মাল্টিন্যাশনাল গ্রুপের হয়ে কাজ করার সময় সারোয়ার তার প্রাক্তন কোম্পানির শিনসিগি থেকে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ব্যবসায়িক চুক্তি লাভ করেন।
এর মাঝের বছরগুলোতে তিনি গুগলে চাকরি ছেড়েছিলেন, ঢাকায় এসে নতুন করে বসবাস শুরু করেছিলেন। শেষমেষ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশে বিশুদ্ধ প্রসাধনী পণ্যের বাজারে ব্যবসা শুরু করবেন তিনি।
কোরিয়ায় জীবন (দ্বিতীয়বার)
২০১০ সালে স্নাতক পড়ালেখা শেষ করে সারোয়ার ঢাকায় অবস্থিত হ্যানবিক কোম্পানি নামক একটি কোরিয়ান ফার্মে চাকরি শুরু করেন। এই ফার্মটি বিদ্যুৎ পরিবহনের লাইন স্থাপন করত। সেখানে কয়েক মাস কাজ করেন সারোয়ার।
তবে ওই ফার্মে মানবসম্পদ ও ফাইন্যান্স টিমে যোগদান করলেও নিজের দক্ষতায় তিনি প্রশাসনিক দায়িত্বগুলোও সামলাতে শুরু করেন। এ দায়িত্বের মধ্যে ছিল কোরিয়ান প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এরপর তিনি কোরিয়ার ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য সম্পূর্ণ বৃত্তি পান।
মাস্টার্স পড়ার সময় তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করেন। এরপর সারোয়ার শিনসিগি ইন্টারন্যাশনাল-এর গ্লোবাল ফ্যাশন ডিপার্টমেন্টের পোশাকসংক্রান্ত দলে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষস্থানীয় এ রিটেইল কোম্পানি দুই ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করে। একটি ই-মার্ট ডিসকাউন্ট স্টোর এবং অন্যটি একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোর। ই-মার্ট ডিসকাউন্ট স্টোর মূলত খাবার, পানীয়, গৃহস্থালি জিনিসপত্র বিক্রি করলেও ডিপার্টমেন্ট স্টোরটি ব্র্যান্ডের জামাকাপড় সরবরাহ করে। পুরো কোরিয়াজুড়ে এ ডিপার্টমেন্ট স্টোরের সাতটি আউটলেট রয়েছে।
নিজের কাজের সুবাদে শিনসিগি'র ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ও বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক অন্যান্য অফিসগুলোতে ঘোরার সুযোগ পান সারোয়ার।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিজের কোম্পানির জন্য প্রায় ১২টি দেশ থেকে অর্ডার গ্রহণ করেন সারোয়ার। এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের কোরিয়ান কমিউনিটিতেও দারুণ সক্রিয় ছিলেন তিনি। কোরিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটি'র জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন সারোয়ার।
বাংলাদেশি কোনো প্রবাসী কখনো কোনো আইনি বা অর্থনৈতিক সমস্যা অথবা পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতায় পড়লে তাদেরকে সহায়তা করতেন সারোয়ার কামাল। এছাড়া পহেলা বৈশাখ ও অন্যান্য উৎসবে কোরিয়া প্রবাসী বাঙালিদের জন্য সারোয়ার ও তার দল কনসার্ট এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।
সিউল শহরের ফরেইনার্স রেপ্রেজেন্টেটিভ কমিটির একজন প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন সারোয়ার কামাল। সিউল শহরে বসবাসকারী বিদেশিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য শহরটির মেয়র পার্ক ওন সুনের সঙ্গেও কাজ করেছেন সারোয়ার।
২০১৩ সালে কোরিয়ায় বসবাসের অনুমতি পান সারোয়ার। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও তার প্রকৃত আগ্রহের বিষয়টি ভুলে যাননি তিনি।
২০১৫ সালে সারোয়ার কিছু রেস্তোরাঁ ও অনলাইন ব্যবসা পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করতে শুরু করেন। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বছরের শেষ নাগাদ তিনি বুঝতে পারেন, তাকে নিজে থেকে কিছু করতে হবে এবং সেজন্য চাকরি ছাড়ার প্রস্তুতি নেন। শিনসিগি ছাড়তে তার পাক্কা দুই বছর লেগেছিল।
ইতোমধ্যে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়া তার স্ত্রী, প্রথম বাঙালি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএমএল'র কোরিয়ান ভাষা বিভাকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান।
এরপর সারোয়ার পরিবারের সঙ্গে বাস করার জন্য ঢাকা ফিরে আসেন। তবে ২০১৭ সালে ঢাকা ফেরার আগে তিনি কোরিয়ায় গুগলের একজন ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন।
কিন্তু গুগলের মত একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও তার উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশে ফেরা
২০১৯ সালে ঢাকায় ফিরে সারোয়ার আবার তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। তখন তার পলক শেঠের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বৃটিশ-ভারতীয় এ ব্যক্তি পিডিএস মাল্টিন্যাশনাল ফ্যাশনের ভাইস চেয়ারম্যান। লন্ডনে হেডকোয়ার্টার থাকা পিডিএস কোম্পানির বিশ্বের ১৪টি দেশে অফিস রয়েছে।
ঢাকায় পলক শেঠের সঙ্গে কাজ শুরু করেন সারোয়ার। প্রথম প্রজেক্টেই তিনি পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি রপ্তানি আদেশ পেয়ে যান। আর সেটি এসেছিল তার প্রাক্তন প্রতিষ্ঠান শিনসিগি থেকে।
পিডিএস-এ কাজ করার সময় যুক্তরাজ্য, কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পোশাক রপ্তানি করেন সারোয়ার।
ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো হলেও সারোয়ার তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। কেবল মনে হচ্ছিল তার নতুন কিছু একটা করা দরকার। পোশাক খাত থেকে সরে এসে কম ঝুঁকিপূর্ণ কোনো খাতে কাজ শুরু করতে চাইছিলেন তিনি।
অবশেষে ২০২০ সালে নিজের দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন সারোয়ার কামাল। ঢাকার পান্থপথে ছোট একটি অফিসকক্ষ ভাড়া নিয়ে কোরিয়ান প্রসাধনী পণ্য বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
প্রায় এক বছর ব্যবসা পরিচালনা করেন সারোয়ার। এ সময় তার ক্ষতির অভিজ্ঞতাও হয়। তিনি বুঝতে পারলেন, আমদানি করা খাঁটি কোরিয়ান প্রসাধনী পণ্যের লুকানো একটি বাজার রয়েছে বাংলাদেশে।
এরপর যখন নিজের ব্যবসায় পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়ার চিন্তা করলেন তখন পিডিএস গ্রুপ সারোয়ারকে ধরে রাখার প্রচুর চেষ্টাচরিত্র করল। তারা এমনকি একটি কারখানা তৈরি করে তাকে পার্টনারশিপ এবং মেন্টরশিপ সরবরাহের প্রস্তাব দিল। কিন্তু পুরোদস্তুর স্বাধীন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সারোয়ার এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে পিডিএস গ্রুপ থেকে পুরোপুরি বিদায় নেন সারোয়ার। বর্তমানে ঢাকা'র এলিফ্যান্ট রোডে ২৬ জন কর্মী নিয়ে 'চারদিকে' সামলাচ্ছেন সারোয়ার।
কে-পপ এবং কোরিয়ান রান্নাবান্নার মতো কোরিয়ান প্রসাধনীর বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে। কর্ক্স, মিসাহ, ইনিসফ্রি ইত্যাদি খুবই পরিচিত কোরিয়ান প্রসাধনী পণ্য। সারোয়রের চারদিকে ডটকম থেকে যে কেউ ৪০টির বেশি কোরিয়ান ব্র্যান্ডের বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্য কিনতে পারেন।
ক্রেতাদেরকে তাদের ত্বকের সমস্যার জন্য যথোপযুক্ত পণ্যটি খুঁজে দেওয়ার জন্য সারোয়ারের হয়েছে একটি ব্লগ ও উৎসর্গীকৃত একদল কর্মী। এছাড়া চারিদিকে ডটকমে শরীর ও চুলের যত্নে ব্যবহৃত প্রসাধন এবং মেকআপও পাওয়া যায়।
কোরিয়ার প্রখ্যাত ব্র্যান্ড স্কিনফুডের একমাত্র স্বীকৃত বাংলাদেশি বিক্রেতা চারদিকে। এছাড়া, বর্তমানে সারোয়ার নিজের স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড জিফর্স প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন।
সকল ধরনের ত্বকের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এ পণ্যগুলো ইতোমধ্যে কোরিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে। তবে সারোয়ারের পরিকল্পনা হলো- সেগুলো ভিয়েতনাম, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও রপ্তানি করা।
বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং এখানকার মানুষের ত্বকের জন্য উপযুক্ত এমন সব স্কিনকেয়ার ও প্রসাধনী তৈরির জন্য শীঘ্রই ঢাকায় নিজস্ব একটি কারখানা স্থাপন করতে চান সারোয়ার কামালের।