আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ যেভাবে উর্দু সাহিত্যের সযতন চর্চা করেছিল
বহু ভাষার দেশ ভারত। তাই এখানে অনেকই একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন। ভাষার এ আধিক্যের কারণে দেখা যায়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকেরা অন্যান্য ভারতীয় ভাষাতেও উঁচুমানের বেশকিছু সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক কাজ করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এসব দারুণ কাজ করেও এ বিদগ্ধজনেরা কোনো ভাষা থেকেই বিশেষ স্বীকৃতি পাননি।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে উর্দু সাহিত্য
ভারতের বিখ্যাত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (এএমইউ) ইংরেজি বিভাগের অনেক শিক্ষক ও পণ্ডিত উর্দু ভাষা, সাহিত্য, ও সমালোচনায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এ পণ্ডিতেরা একইসঙ্গে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে যেমন জ্ঞানী ছিলেন তেমনি ফার্সি-উর্দু ভাষা ও সাহিত্যেও তাদের বিস্ময়কর দখল ছিল।
দুটো ভাষায় কাজ করলেও এ শিক্ষাবিদেরা কোনো ক্ষেত্র থেকেই আশানুরূপ স্বীকৃতি পাননি। পশ্চিমা সমালোচক ও বিদ্বানেরা তাদেরকে অনুকম্পার চোখে দেখতেন। অন্যদিকে ভারতবর্ষে যারা কেবল উর্দুর চর্চা করতেন, তাদের কাছে এ শিক্ষকেরা উর্দুর দুনিয়ায় নিতান্তই বহিরাগত ছিলেন।
এএমইউ'র ইংরেজি বিভাগের কোনো কোনো শিক্ষক উর্দু ও ইংরেজি; দু'ভাষাতেই তাদের জ্ঞানের চর্চা করতেন। আবার আরেকদল ছিলেন, যারা পড়তেন উর্দুতে কিন্তু লিখতেন ইংরেজি ভাষায়। এরা সচরাচর উর্দু থেকে ইংরেজিতে বিভিন্ন সাহিত্য অনুবাদ করতেন অথবা উর্দু তথ্যসূত্রের বরাতে পাঠ্যবই ও নিবন্ধ লিখতেন।
আরেকদল ছিলেন যারা এখানকার ইংরেজি বিভাগে পড়ে পরে বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। এরা মূলত সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, সাহিত্য সমালোচনা ও ইংরেজি থেকে উর্দুতে অনুবাদ করতেন।
দেশভাগের আগে ভারতে উর্দু বেশ প্রচলিত একটি ভাষা ছিল। ব্রিটিশ-ভারতে জন্ম যাদের, তারা ফারসিও পড়ার সুযোগ পেতেন। ফলে তাদের উর্দু হয়ে উঠত অনবদ্য। আর যারা স্বাধীন ভারতে জন্মেছিলেন, তারা লেখার চেয়ে উর্দু পড়তে পারতেন ভালো। তাদের লেখালেখির বেশিরভাগটাই ছিল ইংরেজিতে।
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন খাজা মানজুর হুসেইন (১৯০৪-১৯৮৬)। ইংরেজি, উর্দু, ও ফার্সি ভাষায় তার জ্ঞান ছিল অসামান্য। উর্দু সমালোচক আসলুব আহমদ আনসারি তার 'আইনা খানে মেঁ' গ্রন্থে জানিয়েছেন, সমসাময়িক বিখ্যাত উর্দু লেখক ও কবিরা খাজা মানজুরের উর্দু সাহিত্যের ওপর দখলের কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন।
আনসারির লেখা থেকে আরও জানা যাচ্ছে, প্রকাশের আগে উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ তার বিখ্যাত 'ইয়ে দাগ দাগ উজালা ইয়ে সব গুজিদা সাহার' খাজা মানজুরকে পাঠিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সভা ও অনুষ্ঠানে সেই কবিতাটি অনেকবার পড়েছিলেন মানজুর।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের 'র্যালি লিটারেরি সোসাইটি'র আয়োজনে একবার চার্লস ডিকেন্সের ওপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক ইএম ফরস্টার। তখন তাকে উপস্থিত অভ্যাগতদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য খাজা মানজুর ফরস্টারের এমন সব বিস্মৃত সাহিত্যকর্মের কথা উল্লেখ করেছিলেন যে খোদ ফরস্টারই সেসবের কথা ততদিনে ভুলে গিয়েছেন।
যেভাবে বিশ্বসাহিত্য উর্দুতে আধুনিক লেখায় উৎসাহ দিয়েছিল
সংস্কৃতিমান, নম্রভাষী খাজা মানজুর আলীগড়ে থাকাকালীন বিশেষ কিছু প্রকাশ করেননি। তবে সে সময় তিনি কিছু রাশিয়ান ছোটগল্পকারের সাহিত্যকর্ম উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে কবি ফয়েজের লেখা মুখবন্ধে গ্রন্থাকারে সেগুলো প্রকাশিত হয়।
আনসারির মতে উর্দুভাষী ছোটগল্পকারেরা রাশিয়ান বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন খাজা'র অনুবাদের সুবাদে। গজল নিয়েও বিস্তুর আগ্রহ ছিল খাজা মানজুরের। সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে গজলের সম্পর্কের অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন তিনি। গজল নিয়ে খাজা'র লেখা দুটো বই হলো 'তেহরিক জাদো জিহাদ বাতাউর মাউজু-ও- সুখান' এবং 'উর্দু গজল কা খারিজি রূপ বাহরূপ'। গজলের রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রা রয়েছে—এমন মতের কারণে খাজা মানজুর যেমন বাহবা পেয়েছিলেন, তেমনি তাকে সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল।
১৯৪৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেন সালামাতুল্লাহ খান। উত্তর ভারতে মার্কিন সাহিত্যের চর্চা করতেন তিনি। সে সময় ভারতের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কিন সাহিত্যের উপস্থিতি ছিল বিরল।
নিজের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য এমিলি ডিকিনসনের ওপর কাজ করেছিলেন খান। উর্দুভাষায় তার লেখা বইগুলো হলো 'মাজাজ কা আলমিয়া অওর দুসরে মাজামিন' (১৯৬৯), 'আমরিকি আদাব কা মুখতাসার জায়েজা' (১৯৭৮), ও 'আর্নেস্ট হেমিংওয়ে: হায়াত-ও-ফান কা তানকিদি মুতালা' (১৯৮০)। জোনাথন এডওয়ার্ডস, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন, ও থমাস জেফারসনের ওপরেও কাজ করেছিলেন খান।
যেভাবে সমসাময়িক উর্দু সাহিত্যকে সযত্নে ধরে রেখেছিল আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়
উর্দু সমালোচক আসলুব আহমদ আনসারি (১৯২৫-২০১৬) আলীগড়ের ইংরেজি বিভাগের পণ্ডিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলেন। তিনি ইংরেজি আর উর্দু, দু'ভাষাতেই লেখালেখি করতেন। ১৯৪৭ সালে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন তিনি। প্রায় ২০ বছর বিভাগটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আনসারি।
শেকসপিয়ার ও ব্লেকের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন আনসারি। প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ উর্দু কবিদের নিয়ে লিখেছিলেন তিনি, তবে গালিব ও ইকবাল ছিলেন তার প্রিয় কবি। তার লেখা বইয়ের মধ্যে আছে 'নাকশ-ই-গালিব' (১৯৭০), 'নাকশ হ্যায় রং রং' (১৯৯৮), 'ইকবাল কি তেরাহ নাজমেঁ' (১৯৭৭), 'ইকবাল হার্ফ-ও-মেঁ' (১৯৯৮), 'উর্দু কে পন্দ্রা নভেল' (২০০৩) ইত্যাদি। অসংখ্য বইও সম্পাদনা করেছিলেন আনসারি।
উর্দু ভাষায় 'নাকদো নাজার' নামক একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন আনসারি। এখানে নিয়মিত লিখতেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তার অন্যান্য সহকর্মীরাও। 'নাকদো নাজার'-এ প্রকাশিত কিছু সম্পাদকীয় ও অবিচুয়ারি (শোকজ্ঞাপন লেখা) নিজের ২০০৫ সালে প্রকাশিত বই 'হার্ফ-ই-চাঁদ'-এ যুক্ত করেছিলেন আনসারি।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারমুক্ত কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ও অনুবাদক জাহিদা জাইদি (১৯৩০-২০১১) চেখভ, পিরানডেলো' সার্ত্রে, বেকেটের নাটক এবং ইউজিনিও মন্টেল, গার্সিয়া লর্সা, পাবলো নেরুদার কবিতা উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। তার লেখা উর্দু নাটকগুলোতে মঞ্চ পরিচালনার বিস্তৃত বর্ণনা থাকত। এসব নাটক অ্যাবসার্ডিস্ট থিয়েটার ধারায় প্রভাবিত ছিল।
জাইদি'র নারীবাদী নাটক 'ও সুবেহ কাভি তো আয়েগি' (১৯৯০)। তার অন্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে 'দুসরা কামরা' (১৯৯০), 'জাঙ্গল জলতা রাহা' (১৯৯০), 'কিউঁ কার উস বাত সে রাখুন জান আজিজ' (১৯৯৮), 'সাহরা-ই-আজম' (১৯৯১), 'বহুত দূর তাক রাত হোগি' (২০০৬) ইত্যাদি।
এসবের পাশাপাশি জাহিদা জাইদি উপন্যাস ও কবিতাও লিখেছেন। তার সাতটি কবিতার বইয়ের মধ্যে দুইটি ইংরেজিতে লেখা। এগুলো হলো 'ব্রোকেন মিরর' (১৯৭৯) ও 'বিয়ন্ড ওয়ার্ডস' (১৯৮৪)। তিনি গজল ও নাজমও লিখতেন।
সাইয়েদ আমিন আশরাফ (১৯৩০-২০১৩) ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন ১৯৬৩ সালে। ১৯৯১ সালে অবসরের আগ পর্যন্ত এ বিভাগে পড়িয়েছিলেন তিনি। রসবোধের জন্য তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তার কবিতা রচনাবলিগুলো হলো 'জাদাহ সাব' (২০০০), 'বাহার ইজাদ' (২০০৭), ও 'কাফস-ই-রং' (২০১১)। তিনি পরিচিত ছিলেন প্রেমের, বিশেষত সুফিপ্রেমের কবি হিসেবে।
মোদ ইয়াসিন (১৯৩২-২০১০) উর্দুতে 'আংরেজি আদাব কি মুখতাসার তারিক' ও 'নাকুশ-ও-আফকার অউর নাজারায়েত: মুনতাখিব মাজামিন' শীর্ষক দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন। নাকদো নাজার-এ নিয়মিত নিবন্ধ ও গ্রন্থ পর্যালোচনা লিখতেন তিনি। এছাড়া সাময়িকীটির মাধ্যমে তার হাত ধরে ফরাসি ঔপন্যাসিক বালজাক ও ফ্লবার্টের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন উর্দুভাষী পাঠকেরা।
নাজমা মাহমুদের কবিতার বই 'রেজিস্তান মেঁ ঝিল' প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আরও অনেক সদস্য উর্দুতে লেখালেখি করেছেন। মাসুদুল হাসান (১৯২৮-২০১৯) উপহার হিসেবে পাওয়া বইগুলোর চমৎকার সমালোচনামূলক পর্যালোচনা লিখতেন। মাকবুল হাসান খান লিখেছেন গালিব, ইকবাল, কুররাতুলাইন হায়দারকে নিয়ে। কঠিন সাহিত্যকর্মগুলোর ওপর নিজের ব্যাখ্যা ও অনুধাবন লিখতেন জেডইউ উসমানি। এএমইউ'র প্রখ্যাত পণ্ডিতদের এ তালিকায় আরও আছেন এস উইকার হুসেইন, রাজা ইমাম, এআর কিদওয়াই, সাইয়েদ আসিম আলি প্রমুখ।
মোহাম্মদ আসিম সিদ্দিক: ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক
সূত্র: স্ক্রল ডটইন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত