বু বু ওয়ার্ল্ড: পরিবার ও শিশুদের আপন ভুবন
যৌথ পরিবার তো সেই কোনকালে ভেঙে গেছে। পরিসরে ছোট হচ্ছে একক পরিবারও। নগর জীবনে চাইলে বাচ্চাদের বেশি সময় দিতে পারে না কর্মজীবী বাবা-মা। ফলে ঠাকুর মার ঝুলি, নাসির উদ্দিন হোজ্জা কিংবা রূপ কথার গল্প শোনানোর মত আর কেউ নেই। নগরীতে খেলার পর্যাপ্ত মাঠ নেই। দুই একটি মাঠ থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতায় খেলার কোনো জো নেই। তাই অনায়েসে ক্ষুদে দুটো হাত খেলে বেড়াচ্ছে ল্যাপটপ কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে। ব্যাস, এই গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আজকের শৈশব।
বাচ্চাদের ঘরবন্দি এই জীবন থেকে মুক্তি ও বিনোদন দিতে চট্টগ্রামে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করল 'বু বু ওয়ার্ল্ড'। এখনো পর্যন্ত এটি নগরীতে শিশুদের একমাত্র সামাজিক ক্লাব। নগরীর জামালখান এলাকায় এস এস খালেদ রোডে এই পার্ক গড়ে তোলে চট্টগ্রামের নামকরা আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিপিডিএল।
কোভিডের কারণে প্রথম দুই বছর কার্যক্রম কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লেও ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে বাচ্চাদের কোলাহলে জমে উঠেছে বু বু ওয়ার্ল্ড। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোরের মেলা বসে বু বু ওয়ার্ল্ডে।
নগরীর একমাত্র এই ইনডোর পার্কে রয়েছে ১৮ ধরণের ইন্ডোর গেমস ও রাইড। পাশাপাশি শিশু ও তাদের পরিবার-পরিজনদের একসঙ্গে ডাইন-ইন ও বার্থডে পার্টির ব্যবস্থাও রয়েছে। রয়েছে টয়পোরিয়াম নামে একটি গিফট শপ। সেখানে শিশুদের জন্য খুব ভালো মানের স্বাস্থ্য উপযোগী খেলনা পাওয়া যায়।
কোনো ধরনের প্রবেশ মূল্য ছাড়াই বাচ্চা ও পরিবার-পরিজন প্রবেশ করতে পারে এই পার্কে। কয়েন প্রতি ৫০ টাকা মূল্যে ইচ্ছেমতো গেমস পছন্দ করে নিতে পারে বাচ্চারা। ভিন্ন ভিন্ন গেমসের জন্য কয়েনের পরিমাণ বিভিন্ন রকম। পার্কটিতে শতাধিক শিশু গেমস এ অংশ নিতে পারে।
বু বু ওয়ার্ল্ডে শিশুদের জন্য রয়েছে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি গেমিং ক্যাটাগরিতে প্রো বাস্কেটবল, এয়ার হকি, জাংগল জিম লস্ট ওয়ার্ল্ড, এনিমেটেড গেমিং এলিয়েন ফাইট, থ্রিডি রেইসিং কার, রেইজিং স্ট্রোম, ভি আর এক্সপেরিয়েন্স রাইড অন মাস্টাং, ম্যাজিক কার্পেট, নাইন ডিভিআর মুভি, ইন্টারেক্টিভ গেমিং বু বু কার, হ্যারিক্যান চপার, কিডস রোড রাশ, থ্রো ইট টু উইন ইট, ইউনিকনর্ন রাইড, পনি কেরাসেল, পেনিনসুলা রাইড, স্পিন দ্যা ওয়ার্ল্ড, রিডিমিশন গেমিং উইনিং ক্ল সহ ১৮ ধরনের মজার গেমস।
পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বর্ষপূর্তি, একুশের শিশুতোষ বইমেলা, ক্রিস্টমাস ডে সহ বিভিন্ন দিবসে বাচ্চাদের জন্য বিশেষ আয়োজন থাকে বু বু ওয়ার্ল্ডের। এরমধ্যে রয়েছে কারু প্রতিযোগিতা, অরিগ্যামি, ছবি আাঁকা ইত্যাদি। বিজয়ীদের পাশাপাশি এসব ইভেন্টে সব অংশগ্রহণকারীদের জন্য থাকে শুভেচ্ছা উপহার।
বিশেষ শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বিনোদন আয়োজন
সামাজিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও স্কুলের শিশুদের বু বু ওয়ার্ল্ড প্রায়ই উদ্যোগ নেয়। তাদের জীবন কিছুটা সময়ের জন্য হলেও রাঙিয়ে তোলে প্রাণময় উচ্ছ্বাসে। এ যেন বিশেষ এই শিশুদের অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়নে এক মহতী উদ্যোগ। সম্প্রতি বু বু ওয়ার্ল্ড ঘুরে গেছেন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা তিন সংগঠন উপলব্ধি, অপরাজেয়, বর্ণছড়া স্কুলের শিশু-কিশোররা।
গত ১ অক্টোবর ছোট ভাইকে নিয়ে লস্ট ওয়ার্ল্ডে খেলায় মত্ত সেন্ট মেরী'স স্কুলের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী রুফাইদা ওমর। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সে বলে, "বু বু ওয়ার্ল্ডে আসলে আমরা হেব্বি মজা করতে পারি। এখানে অনেকগুলো মজার মজার রাইড ও গেমস আছে। খেলাধুলা শেষে বাবা-মা'কে সঙ্গে নিয়ে মজাদার খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।"
রুফাইদা'র পাশে থাকা তার মা ইসরাত জাহান বলেন, শিশুদের বিকাশে খেলাধুলা ও বিনোদনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নগরীতে বাচ্চাদের এই সুযোগ খুবই সীমিত। এরমধ্যে বু বু ওয়ার্ল্ডের এই উদ্যোগ বাচ্চাদের জন্য কিছুটা হলেও বিনোদনের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে গেমস ও রাইডগুলোর দাম আরেকটু সহনীয় পর্য়ায়ে নিয়ে আসলে সব শ্রেণির বাচ্চারা বিনোদনের সুযোগ পাবে।
আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হয়ে শিশুদের জন্য কিছু সৃষ্টির ভাবনা কীভাবে এলো?
এমন প্রশ্নের জবাবে বু বু ওয়ার্ল্ডের উদ্যোক্তা দেশের অন্যতম আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিপিডিএল পরিবারের প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন বলেন, "আবাসন খাতে সিপিডিএল সব সময়ই ইনোভেটিভ সলিউশন নিয়ে কাজ করে। ছোট দেশ আমাদের, উচ্চ জনসংখ্যা, প্রতিনিয়ত ব্যবহার উপযোগী ভূমি'র পরিমাণ কমছে, ফলে স্বল্পতম স্থানের সর্বোচ্চ উপযোগ সৃষ্টি করা আবাসন খাতের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তাই আমরা মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো অনুধাবন করে আইডিয়া জেনারেট করি।"
"এরকম একটি মৌলিক সমস্যা এপার্টমেন্ট প্রকল্পে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত আয়োজন করা। এই প্রেক্ষাপটেই আমরা আমাদের প্রকল্পগুলোতে বাচ্চাদের খেলার জন্য কিডস জোন রাখা শুরু করি। সেসব কিডস জোনে যখন দেখি বাচ্চারা আনন্দময় সময় পার করছে, তখন মনে হয় আমাদের প্রচেষ্টা সফল, কিন্তু সব প্রকল্পে করতে না পারার আক্ষেপ মনে থেকেই যায়।"
সেই আক্ষেপ থেকেই নগর-শিশুদের বিনোদনের জন্য আলাদা স্পেস তৈরি করার চিন্তা মাথায় আসে বলে জানান ইফতেখার। যেখানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য আয়োজন থাকবে। থাকবে নানা রকম বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম, ফিজিক্যাল এক্টিভিটি, ক্রিয়েটিভ এক্টিভিটি, ক্যাম্পিং, সুইমিং সহ নানারকমের অতি গুরুত্বপূর্ণ লাইফ স্কিল বাড়ানোর সুযোগ। থাকবে সীমিত গন্ডি'র জীবনকে বৃহৎ পরিসরের সামাজিক জীবনে রূপান্তরিত করার সুযোগ।
"নগরীর ফয়'স লেক এলাকায় আমাদের নির্মাণাধীন প্রকল্পে সুবিশাল কলেবরে শিশু-কিশোর ও ব্যস্ত কর্মজীবীদের জন্য আমরা একটি ফ্যামিলি এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টারের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। এই পরিকল্পনা'র উপযোগিতা যাচাইয়ে আমরা জামালখানে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বু বু ওয়ার্ল্ড শুরু করি," যোগ করেন ইফতেখার।
এতে শিশুরা কীভাবে উপকৃত হবে?
এ প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার বলেন, "আমরা মনে করি, আমাদের বড়দের বিভিন্ন ধরনের ক্লাব আছে। যেখানে আমরা একজন আরেকজনের সাথে কানেক্টেড হই। আমরা চিন্তা করি, বাচ্চাদের সামাজিকীকরণের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার; ক্লাব দরকার। যেখানে স্কুলের বাইরেও বাচ্চারা সামাজিকীকরণ শিখবে। ফলে আমাদের শিশুরা নিজেরদের পরিমণ্ডল বড় করে বেড়ে উঠবে, প্রস্তুত হবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়।"
শিশুদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আপনাদের কী ব্যবস্থা আছে?
শিশুদের নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি। কোভিড চলাকালীন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আমরা বু বু ওয়ার্ল্ড এর প্রতিটি আইটেম অত্যন্ত যত্নের সাথে সেনিটাইজ করি, চেয়ার টেবিল থেকে শুরু করে প্রতিটি ছোট ছোট বিষয় স্থাপনের সময় আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছি, যাতে কোনো কিছু বাচ্চাদের কোনোভাবে অনিরাপদ করতে না পারে। ছোট শিশুদের নিয়ে বু বু ওয়ার্ল্ড কাজ করে, ফলে ওদের সংবেদনশীলতা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাচ্চাদের সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখার জন্য আমাদের আছে একদল প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কিডস এম্বেসডর। তাদের কৌশলগত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আচার ব্যবহার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও আমরা দিয়ে থাকি, যাতে প্রতিটি শিশু এবং তাদের অভিভাবক মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করেন। লস্ট ওয়ার্ল্ডে নির্দিষ্ট বয়স ও উচ্চতার শিশুদের ঢুকতে দেয়া হয়, পুরো লস্ট ওয়ার্ল্ড সেইফটি প্যাডিং করা, যাতে কেউ পড়ে গিয়ে ব্যাথা না পায়, এখানে ঢুকতে হলে প্রত্যেক শিশুর জন্য সম্পূর্ণ নতুন মোজা পড়তে হয়, যা আমরা সরবরাহ করে থাকি।
নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকায় অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের বু বু ওয়ার্ল্ডে রেখে তাদের অন্যান্য কাজে চলে যেতে পারেন।
পাইলট প্রকল্প হিসেবে কতটুকু সফল?
প্রকল্পটি কখনোই আমরা প্রথাগত ব্যবসা বা লাভ ক্ষতির জন্য তৈরি করিনি। এর সফলতার মাপকাঠি আমাদের কাছে মনস্তাত্ত্বিক, এই প্রকল্প আমাদের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রসেসের জন্য করা, সে বিবেচনায় আমাদের প্রকল্প অবশ্যই সফল।
আরও স্বার্থক হতো যদি শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে আমাদের বিশেষ আয়োজন কিড ক্যান ডু সেগমেন্টটি সাস্টেইনেবল হতো। কোভিডের সময়টাতে এই সেগমেন্টটি যৌক্তিক কারণেই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। অসাধারণ একটা ভাবনা ছিল কিড ক্যান ডু, অর্থাৎ শিশুরাও পারে, তাদের আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধির খুবই সময়োপযোগী এই উদ্যোগটি ভবিষ্যতে আবারও চালু করার ইচ্ছা রাখি। বর্তমানে বু বু ওয়ার্ল্ড চট্টগ্রাম শহরে শিশুদের প্রথম পছন্দ, এটিই আমাদের বড় প্রাপ্তি।
বু বু ওয়ার্ল্ড নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
বু বু ওয়ার্ল্ড নিয়ে আমরা নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। খুব শীঘ্রই, একে নতুন আঙ্গিকে, বড় পরিসরে আরো আকর্ষণীয় লোকেশনে প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়াও নগরীর ফয়'স লেক ও হালিশহরে আরো দুটি অ্যামিউজমেন্ট ফ্যাসিলিটি নিয়ে আসছে বু বু ওয়ার্ল্ড।
এরমধ্যে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফয়'স লেক রোডে নিজস্ব ভবনে ১৫ হাজার বর্গফুটের এডভেঞ্চার পার্কটিতে যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক সব গেম। যেখানে বাচ্চাদের পাশাপাশি শিশু ও তরুণদের বিনোদনের সুযোগ থাকছে। এডভেঞ্চার পার্কটিতে আসবে গেমিং এক্সপেরিয়েন্সের আপার ভার্সন ও লেজার টেক প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সরঞ্জাম।
এছাড়া, ঢাকা ও কক্সবাজারে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক স্থাপনেও প্রকল্প হাতে নিয়েছে বু বু ওয়ার্ল্ডের মাদার প্রতিষ্ঠান 'নিও সোল হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট'।