আজারবাইজানের শতবর্ষী মানুষদের দীর্ঘায়ুর রহস্য? পাহাড়ি বাতাস, পুষ্টিকর খাদ্য আর...
পৃথিবীর বেশকিছু অঞ্চল সেখানকার অধিবাসীদের দীর্ঘ আয়ুর জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে। এই যেমন, জাপানের ওকিনাওয়ার শতবর্ষী বাসিন্দাদের জন্য এ অঞ্চলের নাম 'চিরজীবীদের ভূমি'। আবার একই কারণে ইতালির ক্যাম্পোদিমেলের নাম 'ভিলেজ অব ইটারনিটি'। অন্যদিকে, ক্যালিফোর্নিয়ার লোমা লিন্ডা শহরেরর একদল বাসিন্দা পেয়েছেন সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের স্বীকৃতি।
কিন্তু এই পৃথিবীর এক কোণায় এমন একটি ছোট্ট দেশ আছে যেটির নাম হয়তো খুব পরিচিত নয় বা বিখ্যাতও নয়। অথচ এই দেশেই রয়েছে পৃথিবীর একমাত্র 'মিউজিয়াম অব লঞ্জেভিটি' বা দীর্ঘায়ুর জাদুঘর! আর সেই জায়গাটি হলো আজারবাইজানের লেরিক শহর।
দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের দেশ আজারবাইজানের লাংকারান ও নাগোর্নো-কারাবাখসহ একাধিক অঞ্চল তাদের শতবর্ষী বাসিন্দাদের জন্য বিখ্যাত। তবে লেরিক শহরের খ্যাতিটা যেন একটু বেশিই, কারণ এখানেই শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
দীর্ঘ আয়ু চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই কঠিন! সুস্থসবলভাবে বেঁচে থেকে জীবনের সকল স্বাদ-আহ্লাদ পূরণের আকাঙ্ক্ষাও আমাদের কম নয়। কিন্তু অন্য অনেকেই যা পারেননি তা আজারবাইজানের এই সৌভাগ্যবানরা করে দেখিয়েছেন। তালিশ পর্বতমালার উচ্চ ভূমিতে, মেঘের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথে আজারাবাইজানের নাগরিকরা যেন দীর্ঘ-স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের গোপন উপায় খুঁজে পেয়েছেন!
দীর্ঘায়ুর জাদুঘর
দুনিয়াতে কত রকম জিনিস যে সংরক্ষণ করা হয় তার ইয়ত্তা নেই, আর সেজন্য জাদুঘরও আছে প্রচুর। কিন্তু দীর্ঘায়ুর জাদুঘর? এই শব্দদুটি হয়তো অনেকেই আজ প্রথমবারের মতো শুনলেন! আজারবাইজানের লেরিক শহরে দুই কক্ষবিশিষ্ট এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। ২০১০ সালে এটি পুনরায় সংস্কার করা হয়। এ জাদুঘরে রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ব্যক্তিদের জীবন ও স্মৃতি নিয়ে দুই হাজারেরও বেশি নথিপত্র।
এ জাদুঘরে চার্ট আকারে সাজানো আছে দীর্ঘজীবী ব্যক্তিদের নাম ও তারা কত বছর বেঁচেছিলেন সেই সন। সাথে রয়েছে গৃহস্থালি কিছু সামগ্রী যেগুলো জীবদ্দশায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা ব্যবহার করেছেন; এই যেমন- তিন প্রজন্মের পুরনো একটি ইস্ত্রি। আরও আছে মাথায় বাঁধার স্কার্ফ, রূপার কলসি ও বোল, সুন্দর করে বোনা মোজা এবং হাতে রাঙানো মাদুর- যেগুলোর রঙ এত বছর পরেও রয়েছে উজ্জ্বল! জাদুঘরে আরও রয়েছে আজারবাইজানি ও রুশ ভাষায় লেখা চিঠি, এগুলো এতটাই পুরনো যে কালির লেখাও হালকা হতে শুরু করেছে!
তবে 'দীর্ঘায়ু জাদুঘর' এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন হলো জাদুঘরের দেয়ালে ঝোলানো শতবর্ষী নাগরিকদের পোট্রেইট। ত্রিশের দশকে ফরাসি আলোকচিত্রী ফ্রেডেরিক লাশোপ এই ছবিগুলো দান করে যান।
বলে রাখা ভালো, জাদুঘর এবং আজারবাইজানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বয়স ৯০ বছরের উর্ধ্বে গেলেই 'শতবর্ষী' তকমা দেওয়া হয়।
১৯৯১ সালের দিকে লেরিক শহরের ৬৩,০০০ অধিবাসীর মধ্যে ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে শতবর্ষী হিসেবে নাম রেজিস্টার করা হয় এবং তাদের প্রত্যেকের বয়সই ছিল একশো বছরের বেশি।
তবে এরপর থেকে এ অঞ্চলে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবেশ দূষণ এবং টেলিযোগাযোগের টাওয়ারের বিকিরণের কারণে মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে। বর্তমানে লেরিকের ৮২,০০০ বাসিন্দার ১১ জনের বয়স একশো বছরেরও বেশি।
বর্তমানে লেরিকের সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দার নাম রাজি ইব্রাহিমোভা, বয়স ১০৫ বছর। আপাতত তার দীর্ঘায়ু দেখে অবাক হলেও, এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশিকাল বেঁচে থাকা লোকটির কাছে ইব্রাহিমোভার রেকর্ডও সামান্য মনে হয়। আর সেই বিখ্যাত ব্যক্তিটি হলেন শিরালি মুসলুমভ, যিনি ১৬৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন বলে কথিত আছে।
শিরালি মুসলুমভের পাসপোর্টের হলুদ পাতা বলে দেয়, তার জন্ম ১৮০৫ সালে। আর তার কবরের গায়ে থাকা ফলক অনুযায়ী- তিনি মারা গিয়েছেন ১৯৭৩ সালে। আর তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে এ অঞ্চলের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু পাওয়া ব্যক্তি হবেন তিনিই।
তবে দুর্ভাগ্যবশত, উনিশ শতকের শুরুর দিকে শিরালি মুসলুমভের গ্রামের বাড়ি বারজাভুর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম না পৌঁছানোয়, তার জন্মসাল সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
তার জন্মদিনে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পাঠানো অগণিত চিঠি থেকে স্পষ্ট যে জীবিতবস্থায় তিনি বেশ বয়স্ক ও সম্মানিত মানুষ ছিলেন। মুসলুমভের সাথে যোগাযোগ ছিল এমন একজন হলেন ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিন। তিনি মুসলুমভকে 'প্রিয় দাদা' সম্বোধন করে একটি পোস্টকার্ডও পাঠিয়েছিলেন।
বলে রাখা ভালো, মুসলুমভের দীর্ঘায়ুর ধারাটি বংশগতভাবে তার পরিবারের অন্যদের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। তার মেয়ে, ৯৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা হালিমা কামবারোভা বলেন, বাবার মতো ১৬৮ বছর না বাঁচলেও, তিনি তার দাদার মতো অন্তত দেড়শো বছর বা তার আন্টির মতো ১৩০ বছর বাঁচতে চান।
মনের স্থিরতা
আজারবাইজানের যখন ঠান্ডা পড়ে, তখন দেশের বেশিরভাগ শতবর্ষী মানুষেরা লাংকারানের অপেক্ষাকৃত উষ্ণতর এলাকায় চলে যান। কিন্তু সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদক যখন লেরিকে কামবারোভার সাথে কথা বলতে গেলেন, তিনি তখনো বাবার দোতলা বাড়ি আঁকড়েই পড়ে ছিলেন।
আপেল ও নাশপাতি গাছে ঘেরা বাড়ির জানালার কাছে গায়ে শাল জড়িয়ে বসে ছিলেন এই বৃদ্ধা। তালিশ ভাষায় নিজস্ব টানে কথা বলতে বলতে নিজের পাসপোর্ট দেখান তিনি, যেখানে জন্মের দিন বা মাস নেই, আছে শুধু জন্মসাল: ১৯২৪। বয়স ৯৫ বছর হলেও, এখনো পুরোপুরি সজ্ঞানে কথা বলেন কামবারোভা; নাতিপুতিদের সাথে মজা করেন। তাই বয়স জিজ্ঞাসা করলেও সকৌতুকে উত্তর দেন- '১৫ বছর'!
তবে লেরিকের 'দীর্ঘায়ুর জাদুঘর'-এর গাইডের ভাষ্যে- "মনের স্থিরতাই তাদের দীর্ঘ আয়ুর রহস্য'। তারা দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকেন, দার্শনিক চিন্তা করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য শতরকম চিন্তা না করে বর্তমান নিয়ে ভালো থাকতে চান।"
ভালো খাদ্য-পুষ্টি ও প্রাকৃতিক ওষুধ
ঠিক ভোরে উঠে দিনের শুরুটা করেন কামবারোভা। অকারণে বিছানায় শুয়ে গড়ান না তিনি। তিনি বলেন, "সকালে চোখ মেলার সাথেসাথেই আমি উঠে পড়ি।"
এরপর সারাদিন নিজের বাগানে বা বাড়ির পাশে কাজ করেন তিনি। তার ছোট ঘরে ভারি কার্পেট পাতা এবং মেঝেতে বালিশ রাখা। বলে রাখা ভালো, এ অঞ্চলের বহু মানুষ মেঝেতে ঘুমাতে পছন্দ করেন, বড়জোর একটা পাতলা ম্যাট্রেস বা কম্পল বিছানো থাকে মেঝেতে। আর তাদের বিশ্বাস, এভাবে ঘুমালেই পিঠের সঠিক বিশ্রাম হয়।
গতানুগতিক ধারণাকে উপেক্ষা করে এখানকার শতবর্ষীরা মাংস খেতে পছন্দই করেন। তবে তারা টাটকা ডেইরি খাদ্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, যার মধ্যে আছে 'দুধের সর', মাখন, দুধ, দই ইত্যাদি।
এরই মধ্যে কামবারোভার এক আত্মীয় তাকে বড় এক প্লেট নাশপাতি, আপেল এনে দেন, সাথে সুগন্ধি চা। ভেষজ এই চা শরীর-মনকে এক নিমিষে চাঙা করে তোলে।
গাইডই জানান, আজারবাইজানের শতবর্ষীদের দীর্ঘায়ুর রহস্য হলো ভালো পুষ্টিকর খাবার, ঝর্নার পানি এবং ভেষজ মশলা মেশানো চা খাওয়া; শেষোক্ত বস্তুটি বিভিন্ন রোগকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। কামবারোভা জানান, তিনি পুরো জীবনে কখনো বাইরের ওষুধ খাননি!
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একসাথে বসবাস
বাইরে থেকে দেখতে শান্ত মনে হলেও, আজারবাইজানের গ্রামীণ মানুষেরা যে পরিশ্রম করেন তা অতুলনীয়! প্রতিদিন সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত তারা বাগানে বা ক্ষেতে কাজ করেন। আবার অনেকের দিন কেটে যায় বড় পরিবারের দেখাশোনা ও সেলাই-বোনাইয়ের পেছনে।
আজারবাইজানের জঙ্গমিরান গ্রামের ১০৩ বছর বয়সী মাম্মাদখান আব্বাসভের জীবনও এভাবেই কেটেছে। তবে এখন তিনি আর চোখে দেখতে পান না বললেই চলে। তবে প্রতিবেদকদের আগমনের কথা শুনে বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলেও, পরে ঠিকই সবাইকে স্বাগতম জানিয়ে গান গেয়ে শোনান তিনি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- আব্বাসভের ঠিক পাশেই বসে থাকা তার নাতির সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য ১০০ বছর।
সৃষ্টিকর্তা যা দিয়ে থাকেন...
আব্বাসভের ছেলে জানানা, তার শতবর্ষী বাবা 'সৃষ্টিকর্তা যা দিবেন' তাই খাবেন নীতিতে বিশ্বাসী। তার কোনো বাড়তি চাহিদা নেই এবং তিনি কখনো মদ্যপান করেন না।
নিজেদের ক্ষেতের শাক-সবজির পাশাপাশি তিনি ঝর্নার ঠান্ডা পানি পান করতেন। কারণ এই পানিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ, যা তাকে দীর্ঘ আয়ু লাভে সাহায্য করেছে।
তবে আজারবাইজানের পর্বতগুলোর কথা ভুলে গেলেও চলবে না।
২০১৭ সালে স্পেনের নাভারা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ ভূমিতে বসবাস করলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের ঝুকি কমে। ২০১১ সালে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, পর্বতের ওপরে যারা বসবাস করেন তাদের দীর্ঘ আয়ু লাভের হার অনেক বেশি।
আজারবাইজানের শতবর্ষী মানুষদের কারো কারো বয়স নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে, কিন্তু তারা যে গড়পরতা বহু মানুষের যে দীর্ঘ জীবন লাভের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আছেন তাদের আদর্শ জীবনযাপনের জোরে, তা বলাই বাহুল্য! সে কারণেই তারা বলেন: আমরা পৃথিবীতে একবারই বাঁচি, আর সেটা যদি ভালোভাবে করতে পারি তাহলে একবারই যথেষ্ট!
সূত্র: সিএনএন