সাত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, যে বইগুলো পড়ে শেষ করা প্রায় দুঃসাধ্য
বিশ্বে অনেক বই সর্বাধিক পঠিত হিসেবে বিখ্যাত। আবার কিছু কিছু বইয়ের রয়েছে পড়ে শেষ করা কঠিন- এহেন পরিচিতি। ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময় বের করে এসব দুর্বোধ্য বই পড়তে বসাও চাট্টিখানি কথা নয়। তবে এসব বই পড়ার পুরস্কারও কিন্তু ছোট নয়। গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য কিংবা কোনো মোটা কলেবরের বই থেকে শেখার অভিজ্ঞতাই হতে পারে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। চলুন জেনে আসি এমন সাতটি বইয়ের কথা যেগুলো পড়তে কঠিন বলে বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) হলেও পড়া উচিত। বিগ থিংক অবলম্বনে
আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ টাইম
একাধারে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাকাশবিজ্ঞানী ও লেখক স্টিফেন হকিং তার সারাজীবন ব্যয় করেছেন মহাবিশ্বকে বুঝতে। তাকে অনেক সময় আধুনিককালের আইনস্টাইনও বলা হয়।
হকিং যে কয়টি বই লিখে গেছেন- সেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বিক্রিত বই হলো- 'আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ টাইম', যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় 'কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস'। কসমোলজি নিয়ে লেখা এই বইটিতে মহাবিশ্বে মানুষের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন হকিং। বইটিতে পৃথিবীর সবকিছু কীভাবে কাজ করে তার বর্তমান মডেলগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
আশ্চর্যজনকভাবে, বইটিতে অনেক কঠিন বৈজ্ঞানিক বিষয় থাকলেও এতে গাণিতিক সমীকরণ আছে মাত্র একটি; সেটি হলো E = mc2।
সারাবিশ্বে বইটির বিক্রিত কপির সংখ্যা আড়াই কোটি। ব্যাপকভাবে বিক্রিত হলেই যে সর্বাধিক পঠিত হবে, তা কিন্তু নয়। হকিং ইনডেক্স -এ এই বইটির স্কোর ৬.৬ শতাংশ।
এই ইনডেক্সে ৬.৬ শতাংশ স্কোরের অর্থ হলো, যারা কিনেছেন তাদের অধিকাংশই বইটি পড়ে শেষ করতে পারেননি, কিংবা শেষের কাছাকাছিও যাননি।
হকিং ইনডেক্স হলো পাঠকরা হাল ছাড়ার আগে একটি বইয়ের কতটুকু পড়ে- তার একটি গড় হিসাব। মার্কিন গণিতবিদ জর্ডান এলেবার্গ ২০১৪ সালে এই ইনডেক্সের উদ্ভাবন করেন। বিজ্ঞানী হকিং-এর নামেই এটির নামকরণ করা হয়, কারণ তার লেখা আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ টাইমকে বলা হয় 'সর্বকালের সবচেয়ে অপঠিত বই'।
তবে যারা পড়ে শেষ করতে পারেন, আমরা মানুষেরা কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছি এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায়, এসব বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারেন। তার পাশাপাশি হকিং-এর বিখ্যাত রসবোধেরও স্বাদ পান তারা।
ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অভ সলিটিউড
এই বইটির লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। কলম্বিয়ার বুয়েন্দিয়া পরিবারের কয়েকটি প্রজন্মের গল্পকে কেন্দ্র করে লেখা এই বইটির ৫ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। অনূদিত হয়েছে ১২টি ভাষায়। গ্যাব্রিয়েলের মাস্টারপিস বলে বিবেচিত এই বইটি লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম সেরা সৃষ্টি।
পঠনযোগ্যতার বিচারে কঠিন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণ হলো বইটির গল্প (storyline), যেটির মূল থিমের একাধিক ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এছাড়াও বইটির প্লট সরলরৈখিক হলেও, সময়ের সাথে সাথে চরিত্রগুলোর উত্থান-পতন একাধিক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ থেকে যায়। এতে একটি পরিবারের ইতিহাসকে প্রভাবিত করা বাস্তব ঘটনা যেমন বর্ণিত আছে, তেমনি আছে কোনো কাল্পনিক শহরতলির চমৎকার কিছু ঘটনা।
যে পাঠকেরা 'ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম' জঁনরার সাথে পরিচিত নন- তাদের কাছে বইটিকে বিভ্রান্তিকর মনে হওয়াটা বিস্ময়ের কিছু নয়।
কিন্তু যা-ই হোক, বইটি কারণ ব্যতীত প্রশংসা কুড়ায়নি। পুলিৎজারজয়ী উইলিয়াম কেনেডি বলেছিলেন, 'বইটি সমগ্র মানুষজাতির পড়া উচিত।'
ইউলিসিস
সাহিত্যজগতের শ্রেষ্ঠ কাজ কিন্তু দুর্বোধ্য- এমন আরেকটি বই হলো ইউলিসিস। এটি দুই লাখ পঁয়ষট্টি হাজার দুইশ বাইশ শব্দের দীর্ঘ একটি বই, যেখানে উপন্যাসগুলো সাধারণত এর অর্ধেকেরও কম দীর্ঘ হয়ে থাকে। যারা পড়ে শেষ করতে পেরেছেন জেমস জয়েসের লেখা এই বইটি তাদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত।
ইউলিসিস আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে বাস করা এক ব্যক্তির গল্পকে কেন্দ্র করে 'চেতনার প্রবাহে'র (stream-of-consciousness) ধাঁচে লেখা। গল্পটি এত কঠিনভাবে লেখা যে, প্রস্তুত না থাকলে পড়তে গিয়ে মহামুশকিলে পড়তে পারেন। গল্প লেখার ধরনটাই এমন, যে মূল চরিত্রগুলোর মনোভাবের পরিবর্তন কিছুটা বিভান্তিকর মনে হতে পারে।
তবে বইটি আপনাকে সম্পূর্ণতার এক অনুভূতি দেবে যার দরুন মনে হবে চরিত্রগুলোর দৃষ্টিতে দেখা স্থান এবং ঘটনাগুলোর সাথে আপনারও কোনো সংযোগ আছে।
শত চেষ্টা করেও যদি বইটি পড়ে শেষ করতে না পারেন, ঘাবড়ে যাবার কোনো কারণ নেই। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া ওলফ এই বইটির ২০০ পৃষ্ঠা পড়ার পর হাল ছেড়েছিলেন। অথচ তিনি নিজেও তার লেখাতে 'চেতনার প্রবাহ'-র ব্যবহার করেছিলেন।
ক্যাচ-২২
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালীয় অভিযানের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি এয়ার কোরের একজন গোলন্দাজ সৈনিককে কেন্দ্র করে লেখা বই 'ক্যাচ-২২'। এই বইটিতে পাঠক দেখবেন আমলাতন্ত্রের সহজাত উন্মত্ততা; ট্র্যাজেডির মধ্যে খুঁজে পাবেন কমেডি এবং জীবনের এমন সব আপাতবৈপরীত্য যা শুধু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। লেখক জোসেফ হেলার-এর এই বইয়ের নামানুসারেই 'ক্যাচ-২২' শব্দগুচ্ছের প্রচলন ঘটেছে, যার দ্বারা এমন একটি উভয়সংকটাপন্ন পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে পরস্পর বিরোধী শর্ত ও নিয়মের কারণে কোনো সমাধান আসে না।
আরও মজার বিষয় হলো, এই বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই উদ্ভব হয়েছে 'ব্ল্যাক কমেডি' শব্দগুচ্ছের। প্রকৃতপক্ষে, এই বইটির বর্ণনা করতে গিয়েই প্রথমবারের মতো 'ব্ল্যাক কমেডি' টার্মটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
অস্পষ্ট ভাষা, অরৈখিক প্লট, গল্প এগিয়ে যাওয়ার দ্রুত গতির সাথে উদ্ভট এবং ভয়ংকর উপাদান, সবকিছু মিলিয়ে বইটি অনেকের কাছে বেশ বিভ্রান্তিকর। তা সত্ত্বেও, 'টু কিল আ মকিংবার্ড' -এর লেখিকা হার্পার লি-এর কাছে যুদ্ধভিত্তিক বইয়ের মধ্যে ক্যাচ-২২ই সবচেয়ে পছন্দনীয়।
লা মিজারেবলস
ভিক্টর হুগোর লেখা এই বইটির শব্দ সংখ্যা পাঁচ লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার নয়শ পঁচিশ। বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সে জিন ভালজিন নামে একদন তরুণ বিপ্লবী, কসেট নামে একজন তরুণী এবং দুনিয়াকে খুব সাধারণভাবে দেখা একজন দৃঢ় পলিশ কর্মকর্তার জীবন নিয়ে গল্প এগোয়।
মুশকিল হলো, মূল প্লটের সাথে গল্পটির অনেক অংশের কোনো সংযোগ নেই। মঠ, স্থাপত্য, ফরাসী ইতিহাস এবং প্যারিসের নর্দমা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে ভরপুর বইটির অধ্যায়গুলো। বইটি না পড়ে অনেকে এর অনুকরণে নির্মিত চলচ্চিত্র দেখার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে এর জন্যেও আপনাকে ব্যয় করতে হবে সাড়ে চার ঘন্টা।
সুদীর্ঘ লেখা এবং মূল গল্প থেকে সংযোগহীন অধ্যায় থাকা সত্ত্বেও বইটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ অনেক পাঠকের কাছে সমাদৃত হতে পারে, বিশেষ করে যারা প্রত্যেক অধ্যায়কে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করবেন। কারণ এ অধ্যায়গুলো সার্বজনীনভাবে সব সময়ে মানবতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গল্পে যে প্রশ্নগুলো এর চরিত্রদের মাথা ঘামিয়ে তুলবে, সেগুলো নিঃসন্দেহে পাঠককেও গভীরভাবে ভাবাবে।
দ্য টেইল অভ গেঞ্জি
মুরাসাকি শিকিবুর লেখা এই বইটিতে রয়েছে জাপানের রাজদরবার তথা ইম্পেরিয়াল কোর্টের সদস্যদের জীবনের গল্প। অনেকে দাবি করেন, এটিই পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস। পদাবনতি ঘটা এক রাজপুত্রের কাহিনী নিয়ে লেখা এই বইটি বহুকাল আগে বিলীন এক সময়ের গভীর চিত্র ফুটিয়ে তুলে।
বইটির মূল লেখাগুলোর কিছু অংশ হারিয়ে গেছে। আর বাকি যে অংশ আছে তা ধ্রুপদি জাপানি ভার্সনে লেখা, যে ভার্সন অনেক আগেই হয়েছে অপ্রচলিত। আধুনিক সময়ে এসে সমসাময়িক জাপানিজ এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে তবেই বইটি পাঠক পেয়েছে।
বইটি বুঝতে হলে পাঠকদের এগারো শতকের জাপানি পদ্য নিয়ে বিস্তর জ্ঞান থাকা আবশ্যক। মূল লেখাতে কোনো চরিত্রের নাম নেই। এছাড়াও বইটিতে রয়েছে প্রচুর হোমোফোন (একই উচ্চারণ বিশিষ্ট কিন্তু ভিন্নার্থক ও ভিন্ন বানান বিশিষ্ট শব্দ) যার ফলে পাঠকরা প্রায়ই বুঝতে পারেন না, যে গল্পে কখন কী হচ্ছে।
তবে অনূদিত কপিটি পড়ে ক্লাসিক্যাল জাপানের গভীরে প্রবেশ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, গত হাজার বছর ধরে উপন্যাসের মাধ্যম কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে তারও ধারণা পাওয়া যায়।
ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি
ফরাসী অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি'র লেখা বই ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি। ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক পুঁজিবাদের নিরীক্ষা করা এই বইটি ২০১৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পর বিতর্কের ঝড় তুলেছিল।
এরপর থেকেই বইটির আরও অনেক ফলো-আপ বই প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলোর কিছু লিখেছেন পিকেটি নিজেই। মজুরির চেয়ে বিনিয়োগের ওপর রিটার্ন বেশি- এরকম মৌলিক থিসিসের ভিত্তি এবং বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনা আছে বইগুলোতে।
যারা অর্থনীতি পড়েননি, তাদের জন্য বইটি কিছু বোধগম্য নাও হতে পারে। ২.৪ শতাংশ নিয়ে হকিং ইনডেক্সে এই বইটির স্থান আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ টাইম-এর চেয়েও নিচে। ৬০০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে রয়েছে অর্থনৈতিক ইতিহাসের মতো নিরস বিষয়ের আলোচনা।
তবে বইটি পাঠকদের আধুনিক অর্থনীতি এবং সামাজিক সমস্যা বুঝতে সাহায্য করবে। এছাড়াও আধুনিক অর্থনীতির ইতিহাস নিয়েও ধারণা পাবেন পাঠকরা।