বাংলাদেশি বৈধ শ্রমিকের রোমানিয়ায় শরণার্থী বনে যাওয়ার গল্প
প্রতিবছর বিশ্বের লাখো অভিবাসী অবৈধ উপায়ে পাড়ি দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশিরা। কাজের খোঁজ কিংবা ইউরোপে পাড়ি জমানোর স্বপ্নের তাড়না- কারণ যা-ই হোক না কেন অবৈধ উপায়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ইউরোপে যান। এতে যে তাদের অনেক ঝামেলার মুখে পড়তে হয়, সেটি নতুন কিছু নয়। তবে বৈধ উপায়ে গিয়েও অনেক বাংলাদেশি শ্রমিককে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। অনেকের বিক্রি হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ রোমানিয়ায় ঘটছে এমন ঘটনা। এসব তথ্য উঠে এসেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস-এর দুই পর্বের প্রতিবেদনে।
প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন, শ্রমিকদের দুরবস্থা, দূতাবাসের ভূমিকা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকদের জন্য প্রথম পর্বটি আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। আজ থাকলো প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় পর্ব।
বিদেশী শ্রমিকের কোটা দ্বিগুণ করার পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের মাঝে পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া বেশ জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। রোমানিয়ার বাংলাদেশি দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট সাত হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক রোমানিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন। কিন্তু বৈধভাবে গিয়েও নিয়োগের সময় বলা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, চাকরি, বেতন
কোনো কিছুই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক না পেয়ে তারা অনেকে প্রতারণার শিকার হন। এই দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাদের মধ্যে ছয় হাজার শ্রমিক বাধ্য হয়ে কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই পশ্চিম ইউরোপের পথ ধরছেন।
রোমানিয়ায় ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে আসা আহমেদ (ছদ্মনাম) ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, 'আমাদের প্রত্যেকের সাত-আট লাখ টাকা খরচ করে আসতে হয়েছে। এত টাকা খরচ করে দেশে ফিরতে প্রস্তুত না আমরা। আবার অনেকেই লোন নিয়ে এসেছেন।'
শেনজেনের বাইরে থেকে শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করার নাম অভিবাসীরা দিয়েছেন 'গেম'৷
"আমরা এখানে আসছি বৈধভাবে কাজ করতে এবং থাকতে। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতি আমাদের অন্যকিছুর পরিকল্পনা করতে বাধ্য করছে। সবাই বলে বাংলাদেশি অভিবাসীরা সবসময় 'গেম' মারতে চায়। কিন্তু কেন চায় তার কারণটা কেউ ভেবে দেখে না", সংযোজন করেন আহমেদ।
বাংলাদেশে রোমানিয়ার দূতাবাস না থাকায় অভিবাসীদের ভিসা দেয়া হয় ভারতের রাজধানী দিল্লীর দূতাবাস থেকে। তবে বর্তমানে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে রোমানিয়া যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে চলায় তাদের ভিসার ব্যবস্থা করতে কোনো কোনো সময় দিল্লী দূতাবাসের প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসেন।
উদ্দেশ্য বলকান রুট: বৈধ থেকে অবৈধ হওয়ার যাত্রা
প্লামার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, কার্পেন্টার ইত্যাদি নানা কাজের জন্য এক থেকে দুই বছরের কাজের চুক্তি হলেও শুরুতে শ্রমিকদের দেওয়া হয় মাত্র তিন মাসের ভিসা।
আবার, বৈধ ওয়ার্ক পারমিট এবং ভিসা থাকা স্বত্বেও বসবাসের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তারা। রোমানিয়ায় আসার পর সাময়িক বসবাসের অনুমতির (টিআরসি) জন্য আবেদন করতে কোম্পানির চুক্তিপত্রসহ বেশ কিছু কাগজ জমা দিতে হয়।
এহেন পরিস্থিতি অধিকাংশই বাধ্য হচ্ছেন অবৈধ উপায়ে অন্যত্র যেতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হলেও রোমানিয়া শেনজেনভুক্ত এলাকা নয়। ফলে এখানে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ ব্যবস্থা নেই।
তাই কোনো যথার্থ অনুমতি ছাড়াই বলকান রুটের যাত্রা ধরছেন অনেক অভিবাসী শ্রমিক।
বৈধ শ্রমিক থেকে শরণার্থী
আহমেদের মতো আরেক অভিবাসী হলেন রাকিব (ছদ্মনাম)। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হলেও রোমানিয়ায় এসে তাকে দিয়ে করানো হতো সব ধরনের ভারী ও কঠিন কাজ৷ অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে একসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পিঠব্যথায় ভোগেন।
ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি জানান, "রোমানিয়ায় আসতে আমার ছয় লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। অন্তত সেই খরচটা তুলে নেয়া আমার প্রথম লক্ষ্য। টাকাটা তুলতে পারলেই দেশে চলে যাব। 'গেম' মারার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।"
নিয়োগের পর রোমানিয়ায় কাজ পরিবর্তন করা খুব কঠিন। রাকিব চেয়েছিলেন কোম্পানির কাজ ছেড়ে দোকান বা রেস্তোরাঁর মতো অন্য কোনো কাজে যোগ দিয়ে রোমানিয়াতেই বৈধভাবে কাজ করবেন৷ কিন্তু তার কোম্পানি তাকে সে ছাড়পত্র তো দেয়ইনি, টিআরসিও ব্যবস্থা করে দেয়নি৷ অক্টোবরের ২২ তারিখে তার তিন মাসের ভিসা মেয়াদত্তীর্ণ হলে তিনি রোমানিয়াতে অবৈধ অভিবাসীতে পরিণত হন৷
রাকিব বলেন, 'আমি বারবার টিআরসির জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তারা জানায় আমার ভিসার মেয়াদ শেষ বলে তারা কিছু করতে পারবেনা।'
ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসের সাহায্যও নিতে পারছেন না তিনি।
'সাত লাখ টাকা খরচ করে আসছি৷ দেশে ফেরত চলে গেলে সব শেষ', বলেন রাকিব।
এক পর্যায়ে দেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও অনেক টাকা ধারদেনা এবং আত্মীয়-স্বজনের কথা শোনার ভয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন 'গেম মারা'র৷ অবশেষে রোমানিয়া থেকে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে অক্টোবরে তিনি পৌঁছান ইতালি৷ বর্তমানে ইতালির মিলান শহরে বসবাস করছেন তিনি।
রাকিবের মতো হাজার হাজার 'অবৈধ' বনে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিক ইতালিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশে এরই মধ্যে চলে গিয়েছেন অথবা যাওয়ার পথে রয়েছেন। নির্বাসন ঠেকাতে তাদের পরিচয় প্রমাণ করা পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র ফেলে দিচ্ছেন।
রোমানিয়া ছাড়তে বাধ্য তারা
রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী দিল্লীতে অবস্থিত রোমানিয়ান দূতাবাসের বরাত দিয়ে জানান, চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৭,১৫২ জন বাংলাদেশি শ্রমিককে ভিসা দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ১৬ আগস্ট রোমানিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে সেখানে মাত্র ১,৬৭৬ জন বাংলাদেশি বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি নিয়ে আছেন৷
অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকরা যে পরিস্থিতির শিকার হন তা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'এখানে সাপ্লাই কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই অন্যান্য ইইউভুক্ত দেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত৷ তারা এখানে এসে নামমাত্র কোম্পানি খুলে৷ কারণ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনলে তারা তাদের কাছ থেকে কমিশন হিসেবে মোটা অংকের টাকা নিতে পারে৷'
নতুন ওয়ার্ক পারমিট করাতে গেলে যে ঝামেলায় পড়তে হয় তার বর্ণনা দেন দাউদ আলী। রাষ্ট্রদূত জানান, এক্ষেত্রে আগের কোম্পানির অনাপত্তিপত্রের (এনওসি) প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ কোম্পানিই তা দিতে চায় না৷ কারণ এর ফলে পরবর্তীতে বিদেশি শ্রমিক আনার অনুমতি পেতে তাদের সমস্যা হতে পারে৷ এদিকে এনওসি না থাকায় কাজও পরিবর্তন করতে পারেন না শ্রমিকেরা৷ এই ধরনের জটিলতায় পড়ে শ্রমিকেরা এক সময় ভিন্ন পথ বেছে নেয়৷'
গেম মারাই কি লক্ষ্য?
অনেকের মতে অন্যান্য শেনজেনভুক্ত অঞ্চলে যাওয়ার জন্য রোমানিয়াকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা।
অনেক অভিবাসী গেম মারার চিন্তা মাথায় রেখেই রোমানিয়া যান বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি এশিয়া কন্টিনেন্টাল গ্রুপ-এর ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম।
তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রোমানিয়ার কনস্টান্টা বন্দরে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর কথা উদাহরণ হিসেবে টেনে তিনি বলেন, 'একটা কোম্পানিতে আমাদের ৫১ জন শ্রমিক পাঠিয়েছিলাম, এর মধ্যে ১৪ জন পালিয়ে গেছে৷ এদের জন্য জনপ্রতি আমাদের পাঁচ হাজার ডলার করে জরিমানা দিতে হয়েছে৷ কিন্তু বাকি যে ৩৭ জন রয়েছে, তারা নিজেরাও ভালো আছে, কোম্পানিও তাদের ওপর খুশি৷'
গ্রেপ্তার, আটক, ফেরত
রোমানিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরি সীমান্ত দিয়ে শেনজেন এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করেন বেশিরভাগ অভিবাসী৷ রোমানিয়ার সীমান্ত শহর তিমিসোয়ারা বর্তমানে পরিণত হয়েছে অভিবাসীদের হটস্পটে৷ রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কর্মকাণ্ডকে ঘিরে সেখানে গড়ে উঠেছে একটি মানব পাচারকারী দালাল চক্র৷
হাঙ্গেরির ডানপন্থি সরকার গত কয়েক বছর ধরে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ দেশটির সরকারের গ্রহণ করা বেশ কিছু পদক্ষেপ ইইউ-এর সমালোচনার মুখে পড়লেও শেনজেন সীমান্তে পরিস্থিতি দিনদিন আরও কঠোর হচ্ছে।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে, রোমানিয়ার পুলিশ অবৈধ পথে হাঙ্গেরি সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টার সময় ৩,৮৮৮ জন অভিবাসীকে আটক করেন। আগস্টে বৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে রোমানিয়া আসা তিন শ্রমিককে শেনজেনে প্রবেশের চেষ্টার সময় আটক করে দেশে ফেরত পাঠায় সেদেশের সরকার। রোমানিয়ায় প্রবেশে পরবর্তী পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে৷
তবে গুটিকয়েক অভিবাসী ধরা পড়লেও অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিতে পারেন।
রোমানিয়ার শ্রমবাজার বন্ধের আশঙ্কা
অভিবাসীদের এহেন পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পূর্ব ইউরোপে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে রোমানিয়ার সরকার সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাসের সাথে বহুবার যোগাযোগ করে বলে জানান রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী।
তিনি বলেন, 'আমাকে বিভিন্ন কর্নার থেকে সতর্ক করে বলা হচ্ছে এত ভিসা দেওয়া স্বত্বেও আমাদের লোকজন রোমানিয়ায় থাকছেনা৷ ফের এটা চলতে থাকলে হয়তো একসময় বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার সংখ্যা কমে যাবে। এমনকি একসময় বন্ধও হয়ে যেতে পারে৷'
অনেক ক্ষেত্রে রোমানিয়ান কোম্পানি যাচাইয়ের দায়িত্ব দূতাবাসকে দেওয়া হয় না। কোনো কোম্পানিতে ২৫ জনের কম শ্রমিক নিয়োগ দিলে দূতাবাস থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না৷ ফলে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি ৫০ জন লোক নিয়োগ দিলেও কাগজে-কলমে ২৫ জনের কম কর্মী নিয়োগ দেখিয়ে যাচাইবাছাই এড়িয়ে যায়৷
কেবল একজন শ্রমিক নিয়োগ দিতেও দূতাবাসের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক - এই নিয়ম করলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হতে পারত বলে মনে করেন রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী৷