কী কারণে জীবন বাজি রেখে সমুদ্রপাড়ি দিতেও দ্বিধা করছেন না বাংলাদেশিরা?
মে মাসের ২ তারিখ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আট বাংলাদেশির কফিন এসে পৌঁছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠের বয়স ১৮ বছর, আর সবচেয়ে বেশি বয়সি মানুষটি ছিলেন ৩৫ বছরের যুবক।
লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকায় চড়েছিলেন তারা। কিন্তু তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায় তাদের বহনকারী জলযানটি। নৌকায় বিভিন্ন দেশের ৫৩ জন অভিবাসন-প্রত্যাশী ছিলেন। ওই দুর্ঘটনায় আট বাংলাদেশিসহ অন্তত নয়জন নিহত হন। লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসারে তথ্য অনুযায়ী, ১৫ ফেব্রুয়ারি নৌকায় আগুন ধরে গেলে সেটি ডুবে যায়।
উদ্ধার করা ৪৪ জনের মধ্যে ২৭ জন ছিলেন বাংলাদেশি। বাকিরা আটজন পাকিস্তানি, পাঁচজন সিরিয়ান এবং চারজন মিশরের। অর্থাৎ পুরো নৌকার ৬৭ শতাংশ আরোহী ছিলেন বাংলাদেশি।
'ইউরোপিয়ান ড্রিম' তথা ইউরোপে একটা ভালো জীবন যাপনের স্বপ্ন নিয়ে অনেক বাংলাদেশি বিপদসংকুল ভূমধ্যসাগরীয় নৌপথ বেছে নিচ্ছেন। বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী অভিবাসন পথ হিসেবে পরিচিত ভূমধ্যসাগর। গত এক দশকে নৌকাযোগে এ সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাকারী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যা হচ্ছে বাংলাদেশি।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল এ নৌপথ দিয়ে ইউরোপে পৌঁছা ১৬ হাজার ২০০ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ২১ শতাংশ। ৭ মে রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আন্তজার্তিক অভিবাসন সংস্থা'র মহাপরিচালক অ্যামি পোপো।
কিন্তু একটু ভালো জীবন কাটানোর আশায় প্রাণ হাতে নিয়ে এ যাত্রার পেছনে বাংলাদেশি মানুষদের প্রেষণা কী?
নৌপথের অভিবাসীরা
২০২৩ সালের ১৪ জুন গ্রিসের উপকূলে সাড়ে ৭০০ অভিবাসী নিয়ে ডুবে যাওয়া ট্রলার আড্রিয়ানার কথা মনে আছে? ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ৬০০ জন মারা গিয়েছিলেন। খোদ ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক নৌরুটের জন্যও এটা একটা বড়মাত্রার ট্র্যাজেডি। হয়তো ঘটনাটার কথা আপনাদের মনে নেই।
ওইসময় গণমাধ্যমের নজর ছিল টাইটানের ওপর বেশি। ১৮ জুন টাইটান নামক একটি পর্যটক সাবমেরিন আটলান্টিক মহাসাগরের কয়েক হাজার ফুট গভীরে বিধ্বস্ত হলে ভেতরে থাকা পাঁচ যাত্রী মারা যান।
ওই সাবমেরিনে ভ্রমণের এক-একটা টিকিটের দাম পড়েছিল আড়াই লাখ ডলার।
মানুষের জীবনের মূল্যবিচারে বৈষম্য কতটা তীব্র হতে পারে এবং ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অভিবাসীদের মৃত্যু কতটা সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার জ্বলজ্বলে নজির ওই ঘটনা। বিভিন্ন খবরে প্রকাশ, আড্রিয়ানার ঘটনায় নিহতদের ৫০ শতাংশ ছিলেন পাকিস্তানি। তারা দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে ওই নৌকায় উঠেছিলেন।
জাতিসংঘ এবং আন্তজার্তিক অভিবাসন সংস্থা'র তথ্য বলছে, ভূমধ্যসাগরের অভিবাসন নৌপথ বেছে নেওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাত। এছাড়া শরণার্থীরাও এ পথ ব্যবহার করে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ভূমধ্যসাগরের হিসেবের খাতায় বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যার পরিমাণ এত বেশি কেন?
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, 'ইউরোপিয়ান ড্রিম হচ্ছে যখন তারা মনে করে সেখানে জীবনের মান উন্নত এবং যেকোনোভাবে হোক [ইউরোপে] পৌঁছাতে হবে।' তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের নরসিংদী. মাদারিপুর ইত্যাদি জেলায় জলবায়ু সংকটের প্রভাব না থাকলেও এসব এলাকা থেকেই বেশিসংখ্যক মানুষ ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
২০১৫ সাল থেকে '[ভূমধ্যসাগর নৌপথে পাড়ি দিতে চাওয়া অভিবাসীদের] সংখ্যায় বাংলাদেশিরা শীর্ষে ছিলেন। কোনো কোনো বছর বাংলাদেশিদের সংখ্যা শীর্ষ চার, এমনকি প্রথমও ছিল,' বলেন হাসান।
কেবল দরিদ্র এবং স্বল্পশিক্ষিতরাই এ পথ বেছে নিচ্ছেন বলেও একটা ভুল ধারণা রয়েছে। বরং 'দেখা যাচ্ছে, ভূমধ্যসাগর কেবল তারা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন না,' বলেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-এর অ্যাকাডেমিক ও নির্বাহী পরিচালক ড. সিআর আবরার।
জীবনের মূল্যের পাশাপাশি এ যাত্রার জাগতিক মূল্যও অনেক বেশি। ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে ১৫ লাখ টাকারও বেশি খরচ হতে পারে। কিন্তু বছরের পর বছর বাংলাদেশিরা এ ঝুঁকি নিচ্ছেন। ড. আবরার দুটো বিষয় উল্লেখ করেন: নির্দিষ্ট এ সমস্যাটির সমাধানের লক্ষ্যে আমরা এখন পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে কিছু করেছি কি না এবং এ সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে কি না।
'মানব পাচারকারীরা কী ধরনের বন্দোবস্ত করে রেখেছে, ভুক্তভোগীদের কী ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে এবং পাচারকারীদের ধরতে সরকারি সংস্থার ব্যর্থতার জায়গা কোথায় — এগুলো বোঝার জন্য ফেরত আসা অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করার কখনো কোনো চেষ্টা করা হয়েছে?,' প্রশ্ন করেন তিনি।
এছাড়া 'অবৈধ অভিবাসন দিনে দিনে উৎসাহিত হয়েছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কয়দিন পরপরই আমরা এ ধরনের মৃত্যুর খবর পাই, কিন্তু অল্প সময় পরই গণমাধ্যমে এসব নিয়ে আলোচনা মিইয়ে যায়। মানবপাচারকারী বা দালালদের কী হয় সে প্রসঙ্গে বিশেষ কোনো ফলো-আপ তথ্য জানাই যায় না।'
অবৈধ অভিবাসনে সহায়তার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিন্তু 'সেটা পর্যাপ্ত নয়। এ ধরনের অভিবাসনের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য তথ্য ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে হবে।' বলেন ড. আবরার।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ পাসপোর্ট ইন্ডেক্সে নিয়মিতই নিচের দিকে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিয়মিত অভিবাসনকে সীমিত করা বৈদেশিক নীতি। তাই আমাদের এখনই পর্যাপ্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে তরুণদের বিভিন্ন চাকরির জন্য দক্ষ করে তুলতে হবে।
বড় অর্থনীতি, ছোট পরিসর
দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এত মানুষ ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক নৌপথ বেছে নিচ্ছেন, তার ব্যাখ্যা কী? 'এটা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে বটে, কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে না। ফলে তারা অন্যত্র কাজ খুঁজছেন। তার জন্য বিপজ্জনক পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করছেন না,' বলেন ড. আবরার।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। জিডিপি, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি সূচকসাপেক্ষে দেশের অর্থনীতি উন্নতির দিকেই এগিয়েছে। 'তবে প্রবৃদ্ধির পুনর্বিভাজনের বিষয়টা নিয়েও কাজ করতে হবে,' বলেন সানেমের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক। তিনি বলেন, দেশে এখনো অনেক মানুষ এ প্রবৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছেন না।
'অভিবাসনের এ ঘটনা বোঝার জন্য পুল ও পুশ ফ্যাক্টরের বিষয়গুলোও বুঝতে হবে,' বলেন তিনি। অন্য দেশে উন্নত জীবনের আশায় কেউ যদি পুল ফ্যাক্টরের কারণে অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তারা তাদের গন্তব্যে বিমানযোগে পৌঁছান। "কিন্তু যারা 'ডাংকি' পদ্ধতি এবং/অথবা নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে প্রবাসে যেতে চাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা পুশ ফ্যাক্টরের," বলেন ড. সায়েমা হক।
বারবার ঘটা এ প্রবণতা বোঝার জন্য দরকার আরও বেশি গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'আমি জনমিতির সুবিধা [ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড] নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। আমার মনে হয়, তরুণ সমাজ, যারা সাধারণত একটি রাষ্ট্রের জন্য আশীর্বাদের মতোন, তারা শীঘ্রই আমাদের বোঝায় পরিণত হবে।'
এছাড়া তিনি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান নিট সমস্যা এবং অর্থনীতির কর্মহীন প্রবৃদ্ধি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ১৫–৩৫ বছর বয়সি যেসব তরুণ পড়াশোনা বা চাকরি কোনোটিই করেন না, তাদেরকে সামগ্রিকভাবে নিট [এনইইটি – নট ইন এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট, অর ট্রেইনিং] ক্যাটাগরিতে রাখা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাজারো বাংলাদেশির সলিলসমাধির নিয়তি বদলাতে দেশব্যাপী সচেতনতা ক্যাম্পেইন পরিচালনা, সমস্যার মূল কারণগুলো খুঁজে বের করা এবং মানবপাচারকারী ও দালালদের চিহ্নিত করার এটাই প্রকৃত সময়।
আন্তজার্তিক অভিবাসন সংস্থা'র মহাপরিচালক অ্যামি পোপো তার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের পর থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে ২৮৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।