মৃতদের স্মরণ করার দিন: অল সোলস ডে
আগরবাতি, গোলাপজল আর মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণের সঙ্গে মিশেছে মোতবাতির আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘাসের গন্ধ। সারি সারি কবর আলোকিত হয়ে আছে হাজারো মোমবাতির আলোয়। কোনো কবরের মাথায় ক্রুশের সাথে লাগানো মৃতজনের ছবি আর ফুলের মালা। রজনীগন্ধা, গোলাপ বা জারবেরা হাতে নিয়ে গাঁদা ফুলে ছেয়ে যাওয়া কবরের পাশে চুপচাপ বসে আছেন অনেকেই। কেউ আবার ব্যস্ত প্রয়াত স্বজনের স্মৃতির সাথে ছবি তোলায়। মৃতদের জন্য প্রার্থনা করার দিনে গত বুধবার (২রা নভেম্বর) ঢাকার তেজগাঁও খ্রিষ্টান কবরস্থানের দৃশ্য ছিল এটি। বিশ্বজুড়ে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে নভেম্বরের দ্বিতীয় দিনটি পরিচিত 'অল সোলস ডে' নামে। বাংলাদেশে অনেকেই বলেন 'মৃত লোকদের পর্ব দিবস' বা 'কবর আশীর্বাদ দিবস'।
খ্রিষ্টানরা তাদের মৃত স্বজনদের আত্মার পাপমোচন ও স্বর্গলাভের জন্য দোয়া করেন এই দিনে। সকাল থেকেই কয়েক দফায় মৃতদের উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয় গির্জায় ও কবরস্থানে। পরিবেশন করা হয় ধর্মীয় সঙ্গীত। আত্মাদের শান্তিলাভের উদ্দেশ্যে কবরে ছিটিয়ে দেওয়া হয় গোলাপজল। খ্রিস্ট প্রসাদ বিতরণ করা হয় ভক্তদের মধ্যে। অল সোলস ডে-র আগেরদিন অর্থাৎ নভেম্বরের ১ তারিখ পালিত হয় 'অল সেইন্টস ডে'। সেদিন স্বর্গগত সাধুদের আত্মার জন্য প্রার্থনা করেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা।
হোলি রোজারি চার্চের সামনেই কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে গাঁদা ফুলের মালা আর পাঁপড়ি দিয়ে অনেকক্ষণ যাবত একটি কবর সাজাচ্ছিলেন মধ্যবয়সী সুধীর। জানালেন তার বড় ভাইয়ের কবর এটি। ৮ বছর আগে মারা গিয়েছিলেন ভাই। সকালে গাজীপুরের গ্রামে মায়ের কবরের পাশে গিয়েও দোয়া করে এসেছেন তিনি। সুধীরের ভাষ্যে, "নভেম্বর মাস খ্রিষ্টানদের কাছে মৃত লোকের মাস। নভেম্বরের ২ তারিখ মৃত স্বজনদের বিশেষভাবে স্মরণ করা হলেও পুরো মাস জুড়েই চলে তাদের জন্য প্রার্থনা। প্রতিবছর অল সোলস ডে-তে পরিবারের সবাই আসে কবরস্থানে। বাড়িতেও প্রার্থনার আয়োজন করা হয় এদিন।"
চার্চের দরজার পাশে বসে একমনে কবরগুলোর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন রোজমেরি অনিতা গোমেজ। তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কবর এখানে। নিজের মৃত আত্মীয়স্বজন ছাড়াও যাদের কেউ নেই তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রার্থনা করেছেন তিনি। রোজমেরি বলেন, "মৃত্যুর পর তো আমরা কিছু করতে পারি না। মৃত ব্যক্তিরা আজকের দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন আমরা যারা জীবিত আছি তারা যেন প্রার্থনা করি। হয়তো একটু প্রার্থনার জন্য কেউ স্বর্গের দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতে পারছে না। তাদের জন্যই এই আয়োজন। সকালে চার্চে এসে মিশায় (প্রার্থনা) অংশগ্রহণ করেছি আমরা। আবার সন্ধ্যায় এসেছি এখন। নিজের মৃত্যুর কথাও চিন্তা করছি আমি। কবরটা কোথায় হবে। আমার জন্য কে প্রার্থনা করবে সেই ভাবনায় ডুবে ছিলাম এতক্ষণ।"
তেজগাঁও-এর এই কবরস্থানে প্রায় ৭০০টির মতো খ্রিষ্টান কবর আছে। এক একটি কবরে ৫-৭ বছর পরপর নতুন মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। শিয়রের দিকে সিমেন্টের ক্রুশে নাম্বার লিখে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে কবরগুলো। প্রতি সারিতেই ফুল, মোমবাতি হাতে ছিল স্বজনদের পদচারণা। অন্য ধর্মালম্বীর অনেক মানুষও এই কবরস্থানে এসেছিলেন অল সোলস ডে-র আয়োজনে সামিল হতে।
এক নিরিবিলি কোণে বসে কবরে মোমবাতি জ্বালাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেঁজুতি সাহা। প্রথমবার অল সোলস ডে-র আয়োজনে এসেছেন তিনি। সেঁজুতি বলেন, "যেকোনো ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে খুব আগ্রহ নিয়ে যাই আমি। মানুষের জীবনযাপনের বৈচিত্র্য মুগ্ধ করে আমাকে। কবরে এত মোমবাতি জ্বালানো দেখে আমার দীপাবলির কথা মনে পড়ছে। এত আয়োজন করে মৃত স্বজনদের স্মরণ করার বিষয়টিও খুব ভালো লাগছে আমার। এখানে বসে আমিও নিজের মৃত প্রিয়জনদের কথাই ভাবছিলাম।"
ঢাকায় তেজগাঁও চার্চের কবরস্থান ছাড়াও নারিন্দার চারশো বছরের পুরোনো খ্রিষ্টান কবরস্থানে বড় পরিসরে আয়োজিত হয় মৃতদের জন্য এই পর্ব। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের খ্রিষ্টান কবরস্থানেও প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান মানুষেরা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই কবরস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে অল সোলস ডে-র প্রস্তুতি।
অল সোলস ডে-র উৎপত্তি
রোমান ক্যাথলিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের মৃত্যুর পর স্বর্গে প্রবেশের আগে তার ছোট-খাটো সব পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য আত্মাকে যেতে হয় শুদ্ধিস্থান বা 'পার্গেটরি'তে। পুরোপুরি পাপমুক্ত হয়েই কেবল ঈশ্বরের সঙ্গে স্বর্গে সহাবস্থান করতে পারবে কোনো আত্মা। এই সময়কালে আত্মার দ্রুত পাপমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন তার জীবিত স্বজনেরা।
মৃতদের জন্য প্রার্থনা করার এই রীতি প্রাচীনকাল থেকেই পালন করতেন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা। তবে দশম শতাব্দী থেকে পার্গেটরিতে থাকা আত্মাদের জন্য শোকসভার একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করা হয়। অফিসিয়াল ভ্যাটিকান ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর নভেম্বরের ২ তারিখ পালিত হয় মৃতদের জন্য প্রার্থনার অনুষ্ঠান অল সোলস ডে। স্থান-কাল ভেদে এই প্রার্থনার আচার-অনুষ্ঠানও পরিবর্তিত হয়েছে অনেক।
উৎসব হিসেবেও উদযাপিত হয় কোনো কোনো দেশে
মৃতদের জন্য প্রার্থনার এই অনুষ্ঠান শোকসভা হিসেবে নয় কোনো কোনো দেশে পালিত হয় উৎসব হিসেবে। হলিউডের এনিমেশন সিনেমা 'কোকো'তে যেমন দেখানো হয়েছিল 'ডে অব দ্য ডেড' এর উৎসব। মেক্সিকানরা বিশ্বাস করে মৃত মানুষেরা এই দিনে পরলোক থেকে মর্ত্যলোকে আসে তাদের জীবিত আত্মীয়স্বজনের কাছে। তাদের জীবিত স্মৃতি প্রিয়জনেরা মনে রেখেছে কি না তাই জানতে চায় আত্মারা। সেই উপলক্ষেই নভেম্বরের শুরুর দুই দিন মেক্সিকোতে মৃত প্রিয়জনদের আত্মাকে আপ্যায়ন করার উৎসব পালন করা হয়।
ডে অব দ্য ডেডের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর উদযাপিত হয় মৃত শিশুদের আত্মার জন্য আর প্রাপ্তবয়স্ক আত্মাদের জন্য উদযাপিত হয় ২ নভেম্বর। এই দুইদিন পরিবারের সবাই মিলে মৃত ব্যক্তির পছন্দের নানা আয়োজন করে উৎসব উদযাপন করেন। মৃত স্বজনদের আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে তাদের ছবি, প্রিয় খাবার, পারিবারিক স্মৃতিসহ সব প্রিয় সামগ্রী আর ফুল দিয়ে 'অফ্রেন্ডা' বা বিশেষ বেদি সাজানো হয়। আয়োজনে গাঁদা ফুলের প্রাধান্য থাকে বেশি। গাঁদা ফুল মৃতদের আকৃষ্ট করে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
পরলোক থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে ক্লান্ত আত্মারা বেদিতে সাজানো খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয় বলে মনে করেন মেক্সিকানরা। অল্প বয়সে মারা যাওয়া শিশুদের আত্মার জন্য থাকে তাদের প্রিয় খেলনা। মৃত আত্মীয়দের নানান মজার স্মৃতি নিয়ে কবিতা আর ছড়া বানিয়েও সেদিন স্মরণ করা হয় তাদের। দেশের নানা প্রান্ত থেকে স্বজনেরা একত্রিত হন এই উৎসবে সামিল হতে। আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে সমাধিক্ষেত্রে গিয়েও শ্রদ্ধা জানান প্রিয়জনদের কবরে।
মেক্সিকোতে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় ডে অব দ্য ডেড। এছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকা, স্পেন, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে মৃতদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের আয়োজনে এই উৎসব পালিত হয়।