রবীন্দ্রনাথ এখানে নাচ দেখতে এসেছিলেন!
উঁচু বেদীর উপর রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের সামনের খোলা জায়গায় ক্রিকেট খেলছে ক'জন কিশোর। ভাস্কর্যটির ছবি তোলার জন্য ফোন বের করতেই খেলা থামিয়ে এগিয়ে এলো তাদের একজন। আলাপ করে জানা গেলো, তার নাম উচ্ছ্বাস সিংহ।
ভাস্কর্যের পাশের মন্ডপ দেখিয়ে উচ্ছ্বাস বলে উঠল, 'এটারও ছবি তোলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন।'
ভাস্কর্যের কয়েক ফুট সামনেই মন্ডপটি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশ পুরনো। তবে তার টিনের চালে লাগানো সাইনবোর্ডটা ঝকঝকে। তাতে লেখা রয়েছে- 'শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউড় আখড়া। স্থাপিত ১৮৮০ সন।'
সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে, মন্ডপের বয়স ১৪২ বছর। এখানেই ১৯১৯ সালে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারিখটা ছিলো ৬ নভেম্বর। এসেছিলেন মণিপুরী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে। এখানে এসেই এই নৃগোষ্ঠির সংস্কৃতির সবচেয়ে ঋদ্ধ অংশ- মণিপুরী নৃত্য প্রথম দেখেন কবিগুরু। বলা হয়ে থাকে, এরপর থেকেই মণিপুরী নাচ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।
কোথায় এই ভাস্কর্য আর মন্ডপ- তাই তো এখনও বলা হলো না! এলাকাটির নাম মাছিমপুর। সিলেট নগরের ভেতরে সুরমা নদীর তীরবর্তী ছোট্ট একটি পাড়া। ঘিঞ্জি ও নোংরা। এই এলাকায় পঞ্চাশটির মতো মণিপুরী পরিবারের বসবাস।
তা রবীন্দ্রনাথ কীভাবে তাদের সন্ধান পেলেন এই মণিপুরী পাড়ার? সে কাহিনী জানতে রবীন্দ্রনাথের সিলেট সফর সর্ম্পকে জেনে নিতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের সিলেট সফর
১৯১৯ সালে অবকাশ যাপনের জন্য অভিভক্ত ভারতের আসাম রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী শিলংয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে অবস্থানকালে শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাকে সিলেট সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ওই বছরের ৫ নভেম্বর পুত্র ও পুত্রবধূকে সাথে নিয়ে সিলেট আসেন রবীন্দ্রনাথ।
৫ নভেম্বর সকালে সুরমা নদীর চাঁদনী ঘাটে শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ সিলেটে স্বাগত জানানো হয় কবিকে। সিলেটে তিনদিন অবস্থান করেন কবি। ভ্রমণকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে সিলেটকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেন রবীন্দ্রনাথ। সেসময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সিলেটকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিলো। এ নিয়ে আক্ষেপও ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। শতবর্ষ পরেও সিলেটের বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনও অনেকেই দ্বারস্থ হন সেই কবিতার-
'মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।/ ভারতী আপন পুণ্য হাতে/ বাঙালির হৃদয়ের সাথে/ বাণীমালা দিয়া/ বাঁধে তব হিয়া/ সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে/ বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা আছে।'
সিলেটে ভ্রমণকালে ৬ নভেম্বর টাউন হল প্রাঙ্গণে ও ৭ নভেম্বর মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের উদ্যোগে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। টাউন হলে রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত বক্তৃতা 'বাঙালীর সাধনা' নামে 'প্রবাসী' পত্রিকায় আর এমসি কলেজের বক্তৃতার সারমর্ম 'আকাঙ্খা' নামে 'শান্তিনিকেতন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
টাউন হল প্রাঙ্গণে সংবর্ধনা মঞ্চের টেবিল মোড়ানো ছিলো মণিপুরীদের তাঁতের কাপড়ে। এটি পছন্দ হয় রবীন্দ্রনাথের। এই কাপড়ের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে মণিপুরীদের সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। এরপর মণিপুরীদের তাঁত শিল্প ও তাদের জীবনযাত্রা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন কবি।
মাছিমপুরে রবীন্দ্রনাথ
কবির আগ্রহে পরদিন, অর্থাৎ ৬ নভেম্বর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরের মাছিমপুর মণিপুরী পাড়ায়। সেখানকার বাসিন্দারা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরণ করেন কবিগুরুকে, মাত্র ছয় বছর আগে যিনি উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নোবেল জয় করেছেন। কবির সম্মানে আয়োজন করা হয় মণিপুরী নৃত্যের।
এ প্রসঙ্গে 'শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের লেখক কবি ও গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাস বলেন, ৬ নভেম্বর বিকেল ৩টার দিকে মাছিমপুর মণিপুরি পাড়ায় আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতে স্বাগত জানাতে এখানকার বাসিন্দারা সড়কে সারি সারি কলাগাছ পুঁতে তোরণ নির্মাণ করে। প্রতি গাছের গোড়ায় মঙ্গলঘট ও আমপাতার শোভনসজ্জা করেন। মাছিমপুরে আসার পর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপীনাথ জিউ মন্দিরে।
নৃপেন্দ্রলাল বলেন, মন্ডপে কবির উদ্দেশে মণিপুরি ছেলেমেয়েরা রাখালনৃত্য পরিবেশন করে। রাঁধাকৃষ্ণের প্রেম নিয়ে রাখাল নৃত্যের কাহিনি। এরপর রাসনৃত্যেরও আয়োজন করা হয় কিন্তু কবি ক্লান্ত বোধ করায়, রাসনৃত্য না দেখেই নয়াসড়ক টিলার ওপরে ফাদার টমাসের বাংলোয় ফিরে আসেন। সিলেট সফরকালে এখানেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এরপর সন্ধ্যায় মণিপুরি ছেলেমেয়েরা তার বাংলোয় এসে রাসনৃত্য পরিবেশন করেন, যা মুগ্ধ করে রবীন্দ্রনাথকে।
প্রচারের আলোয় মণিপুরী নৃত্য
মণিপুরী নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হন রবীন্দ্রনাথ। এই নৃত্য তাকে এতোটাই মুগ্ধ করে যে, শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের মণিপুরী নৃত্য শেখানোর আগ্রহ প্রকাশ তিনি। সিলেটে রবীন্দ্রনাথের সামনে যে মণিপুরী নৃত্য পরিবেশিত হয় তা পরিচালনায় ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী নৃত্যশিল্পী ইমাগো দেবী। ইমাগো দেবীকে কবিগুরু শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মণিপুরীদের কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে ইমোগা রাজি হননি। তবে এতেও ক্ষান্ত হননি রবীন্দ্রনাথ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকা তার 'সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষে ফিরে দেখা' প্রবন্ধে লিখেছেন- 'রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি নৃত্যকলায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, কলকাতায় ফিরবার পথে ত্রিপুরার রাজার সাহায্য নিয়ে একজন নাচের শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান সেখানকার শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাবার জন্যে'।
কেবল শিক্ষক নিয়োগ নয়, শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যের জন্য আলাদা শাখাও গঠন করা হয়। এমনকি পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও পাওয়া যায় মণিপুরী নৃত্যের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, মায়ার খেলা, নটীর পূজা, শাপমোচন নৃত্যনাট্যে মণিপুরি নৃত্যেও সুর ও তাল অনুসরণ করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে মন্ডপ প্রাঙ্গণ থেকে মণিপুরী নৃত্যকে সর্বজনীন করে তুলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণেই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা মণিপুরি নৃত্য প্রচারের আলোয় আসে বলে জানান প্রবীণ নৃত্যগুরু অনিল কিষান সিংহ। তিনি বলেন, শান্তিনিকেতনে চর্চা শুরুর পর থেকেই মণিপুরি নৃত্য সব মহলে সমাদৃত হতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে মণিপুরী শিল্পীরা আমন্ত্রিত হতে থাকেন।
তিনি বলেন, মণিপুরীদের কাছে নৃত্য তার ধর্মীয় আচারের অংশ। এখন এটি এই অঞ্চলের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। মণিপুরী নৃত্যের প্রচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসামান্য অবদান রেখেছেন।
রবীন্দ্র কালচারাল একাডেমি গঠনের দাবি
২০১৯ সালে সিলেটে মহাসমারোহে পালিত হয় 'শ্রীহট্টে রীবন্দ্রনাথ: শতবর্ষে স্মরণোৎসব'। তার আগের বছর সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত মাছিমপুরে নির্মিত হয় রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি।
তবে ঐতিহাসিক এই মন্ডপটি দীর্ঘদিনেও সংস্কার করা হয়নি এবং মন্ডপের জায়গাও বেদখল হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বাংলাদেশ মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতি, সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সংগ্রাম সিংহ বলেন, মাছিমপুরে মণিপুরী-রবীন্দ্র কালচারাল একাডেমি গঠনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানানো হচ্ছে। মন্ত্রী-মেয়রসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বরাবরই এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা নির্মাণে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
দ্রুত এই একাডেমি নির্মাণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, "এতে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে এবং তা চর্চার সুযোগ পাবে। এছাড়া মণিপুরী নৃত্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসও তারা জানতে পারবে।"