যেভাবে সন্ধান মিলেছিল দেশের প্রথম মুসলিম নারী চিত্রশিল্পীর
একশ দুই বছর আগে ১৩২৭ বাংলা সনের (১৯২০ খ্রিস্টাব্দ) মোসলেম ভারত পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় ছাপা হয় মেহেরবানু খানমের দুটি চিত্রকর্ম। এর একটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত 'খেয়াপারের তরণী' কবিতাটি। নজরুল জীবনীকার কমরেড মুজফফর আহমদ লিখেছেন, "তখন নজরুল ইসলাম আর আমি ৮/এ, টার্নার স্ট্রীটে বাস করছি। কী কারণে জানি না, আফজালুল হক সাহেব ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মোসলেম ভারতে ছাপানোর উদ্দেশ্যে ঢাকার বেগম মুহম্মদ আজম সাহেবার (খান বাহাদুর মুহম্মদ আজমের স্ত্রী) আঁকা একখানা নৌকার ছবি সঙ্গে নিয়ে আসেন। পত্রিকায় ছাপানোর আগে ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। তার জন্যে ছবিখানা একদিন বিকাল বেলা নজরুল ইসলামের নিকট আফজালুল হক সাহেব রেখে গেলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, নজরুল ইসলাম গদ্যে এই আধ্যাত্মিক ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে দিবে। রাত্রি বেলা প্রথমে মনোযোগ সহকারে ছবিখানা অধ্যয়ন করলেন তিনি এবং তারপরে লিখলেন এই ছবি নিয়ে তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'খেয়াপারের তরণী'।"
"এটি নজরুলের একটি বহুল প্রশংসিত কবিতা। সেই সময়ে তাঁর কলম যে পরশপাথর হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ছোঁয়া লাগলেই তা থেকে সোনা বের হয়ে আসছিল। খেয়াপারের তরণী নজরুলের স্বকীয় কলাকৌশলের অপূর্ব সৃষ্টির ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত। এই কবিতার কথাগুলোও বেগম সাহেবার ছবি হতে বের হয়ে এসেছে। কবিতাটিতে যে আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা একান্তভাবেই বেগম সাহেবারই। আমি আশ্চর্য হচ্ছি যে, খেয়াপারের তরণীর আলোচনা ও প্রশংসা যারা করেছেন তাঁরা বেগম আজমের ছবিখানার নামোল্লেখও করছেন না। ঢাকার সাহিত্যিকদের আলোচনায়ও যে বেগম সাহেবার ছবি বাদ পড়ে যাবে তাতে আমার আরও বেশি আশ্চর্য বোধ হচ্ছে।"
খেয়াপারের তরণী'র কয়েকটি লাইন:
যাত্রীরা রাত্তিরে হতে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
প্রলয়েরি আহবান ধ্বনিল কে বিষাণে?
ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া ঘনিল রে ঈশানে
নাচে পাপ-সিন্ধু তুঙ্গ তরঙ্গ।
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ।
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে
ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে।
সৈয়দ এমদাদ আলী ছবি দুটো সম্পর্কে লিখেন, "প্রথম চিত্র। ইহা একখানি ধর্ম্মচিত্র। নদী উত্তাল তরঙ্গরঙ্গে ছুটিয়া চলিয়াছে। এই নদীতে কাণ্ডারীহীন গোমরাহীর তরণী আত্মরক্ষা করিতে না পারিয়া আরোহীসহ নিমজ্জিত হইতেছে।… কিন্তু যাঁহারা তাঁহাদের তরণীতে আশ্রয় লইয়াছেন, তাঁহারা বাঁচিয়াছেন, কারণ এই তরণীর কর্ণধার স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়ালিহি ওয়াসাল্লাম।"
"দ্বিতীয় চিত্র। পল্লীদৃশ্য। বিক্রমপুরের উত্তর দিকে তালতলা একটি বন্দর। এই বন্দরের পূর্বদিকে যে গ্রামখাণি বিস্তৃত রহিয়াছে, চিত্রে তাহাই অঙ্কিত হইয়াছে। দক্ষিণে গ্রাম, উত্তরে ধলেশ্বরী নদী ধবল বারিরাষি বুকে করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। মৃদুল বায়ু হিল্লোলে নদীবুকে যে তরঙ্গের লীলা আরম্ভ হইয়াছে, চিত্রে তাহা বড়ই সুন্দর করিয়া অংকিত হইয়াছে।"
উল্লেখ্য মোসলেম ভারতের পরে চলচ্চিত্র ও ইতিহাস গবেষক অনুপম হায়াৎ প্রথম মেহেরবানু খানমকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনেন। বাংলা একাডেমী থেকে তাঁর রচিত জীবনীগ্রন্থ মেহেরবানু খানম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে।
মেহেরবানু খানম ছিলেন নবাবজাদী
ঢাকার খাজা বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলীমুল্লাহ চামড়ার ব্যবসায় প্রভূত সম্পদ উপার্জন করেছিলেন। পরে জমিদারিও খরিদ করেছিলেন। তাঁর ছেলে আব্দুল গণি ইংরেজের কাছ থেকে নবাব উপাধিপ্রাপ্ত হন। গণি নিজের ছেলে আহসানউল্লাহর নামে আহসান মঞ্জিল নির্মাণ করিয়েছিলেন। আহসানউল্লাহ চারটি বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের একজন কামরুন্নেসা খানম। ১৮৮২ সালে আহসান উল্লাহ তাঁকে বিয়ে করেন।
কামরুন্নেসার তিন মেয়ে পরীবাণু, মেহেরবানু আর আখতার বানু। ১৯০০ সালে কামরুন্নেসা মারা গেলে মায়ের নামে কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েরা। মেহেরবানুর বড় বোন পরীবাণুর বিয়ে হয়েছিল খাজা বদরুদ্দীনের সঙ্গে। তাঁদের মেয়ে জুলেখা খানম ১৯২৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত বিষয়ে ডিসটিংশনসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সওগাত পত্রিকায় এ খবর গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয়েছিল। জুলেখার জুলিয়ান নামে নিজের একটি লাইব্রেরি ছিল। জুলেখার মা পরীবাণু ৭/৮টি ভাষা জানতেন। জানতেন অশ্বচালনা আর জমিদারি পরিচালনা। বেগমবাজারে নবাবদের পারিবারিক গোরস্থানের শিলালিপি থেকে জানা যায়, পরীবাণু ১৮৮৪ সালে জন্মেছিলেন। পরীবাণুর পিঠেপিঠি বোন মেহেরবানু। পরিস্কারভাবে তাঁর জন্ম সাল জানা যায় নি তবে গবেষকরা ভাবছেন, ১৮৮৫-১৮৮৮ এর মধ্যে জন্ম মেহেরবানুর।
খাজা পরিবার শিক্ষার জন্য অর্থব্যয় করতেন। খাজা আব্দুল গণি কলেজিয়েট স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন, তা সত্ত্বেও এ পরিবারের পুরুষেরা বেশিদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করেননি। তবে পারিবারিক পরিবেশে সকলেই কিছু লেখাপড়া করতেন। মেহেরবানুর শিক্ষাও হয়েছিল পারিবারিক পরিবেশেই। তাঁর বিয়ে হয় ১৯০২ সালে বা ১৩০৮ বাংলা সনের পৌষ মাসে। নওয়াব সলিমুল্লাহর (মেহেরবানুর সৎ ভাই) উদ্যোগে খাজা আজমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আজম ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, জমিদার ও সমাজকর্মী হিসেবেও তিনি সুখ্যাত ছিলেন। তিনি ঢাকার পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছিলেন ১৯০৭ সালে। ঢাকা পৌরসভার কমিশনার, ঢাকা মুসলমান সমিতির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সদস্যও ছিলেন আজম। ব্রিটিশরা তাকে ১৯০৯ সালে খান সাহেব এবং ১৯১৭ সালে খান বাহাদুর খেতাব দেয়। দ্য পঞ্চায়েত সিস্টেম অব ঢাকা গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। শরৎচন্দ্রের বড় বউ উপন্যাসটিও খাজা আজম উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন বঢ়ী বহু নামে। হেকীম হাবিবুর রহমান সম্পাদিত উর্দু মাসিক যাদুর তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
মেহেরবানু ও খাজা আজম দম্পতি বাস করতেন দিলকুশায়। গেল শতকের প্রথম তিন দশক তাদের বাসভবনটি হয়ে উঠেছিল সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীদের মিলনস্থল। তাঁদের ছিল দুই পুত্র ও এক মেয়ে। বড় ছেলে খাজা মোহাম্মদ আদিল (১৯০৪-১৯৭৩) ছিলেন ঢাকার একজন গণমাণ্য ব্যক্তি। তিনি কবি ছিলেন, সাংবাদিক, সাহিত্যমোদী ও খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও টেনিস খেলায় তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি নারায়ণগঞ্জে র্যালি ব্রাদার্সে চাকুরি করতেন। মেহেরবানুর দ্বিতীয় পুত্র খাজা আজমল জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ সালে। খাজা শামসুল ডায়রিতে এ ব্যাপারে লিখেছেন, 'আজকে দেওয়ালীর দিন। মেহেরবানুর বাড়িতে আজকে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। নওয়াবের (সলিমুল্লাহর) আদেশে আজকে আসর ও মাগরেবের সময় শাহবাগকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। প্রায় বিশ হাজার লোক জমায়েত হয়েছে।'
খাজা আজমল পরবর্তীকালে দেশের ক্রীড়া, চলচ্চিত্র ও বেতার জগতে তারকার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকার ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সংগঠক এবং রেফারি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকা বেতার প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ঘোষক, সংবাদ পাঠক ও অভিনেতা হিসেবে জড়িত হন। ঢাকার মঞ্চ নাটকেও ছিল তাঁর অবদান। ক্রীড়া ও নাটকের সূত্রে বিশ ও তিরিশ দশকের বিশিষ্ট ব্যক্তি, জগন্নাথ কলেজের শরীর চর্চার প্রশিক্ষক অম্বুজ গুপ্তের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। খাজা আজমলের নেতৃত্বে অম্বুজ গুপ্ত, অভিনেতা টোনা রায় ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা চালান। ফলাফলে সুকুমারী (১৯২৭-২৮) নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং দি লাস্ট কিস (১৯৩১) নামের ঢাকার প্রথম নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। দ্য লাস্ট কিসে নায়ক চরিত্রে অভিনয় ছাড়াও আজমল এর চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনায় অংশ নেন।
মেহেরবানু তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। সংসার ধর্ম পালন করেও তিনি শিল্পের সেবা করে গেছেন। মোসলেম ভারত পত্রিকা এ ব্যাপারে লিখেছে, "নওয়াবাজাদী মেহেরবানু খানম সাহেবা স্বামী-পুত্র-কন্যা পরিবৃৎ বৃহৎ সংসার লইয়াও যে চারুশিল্পের সেবায় মন দিতে পারিয়াছেন, ইহা তাঁহার মত এক অতি সম্ভ্রান্ত মোসলেম নারীর পক্ষে কম কৃতিত্বের বিষয় নয়।"
অনুপম হায়াৎও লিখেছেন, "চিত্রশিল্পী মেহেরবানু খানম ঢাকার নওয়াব পরিবারের মধ্যে ব্যতিক্রমী মহিলা ছিলেন। পারিবারিক জীবন-যাপন ও ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে থেকেও তিনি সমাজসেবা, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। মেহেরবানুর স্বামী খাজা আজম ছিলেন সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক। তাঁদের দিলকুশাস্থ বাসভবনে মুশায়েরা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। মেহেরবানু যে ধর্মপ্রাণ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁর আঁকা ছবিতেও। তিনি বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পর আত্মার হিসাব নিকাশ হবে।"
নবাব বাড়িতে মেহেরবানুর আগে
নওয়াব গণির চাচাতো বোনের পুত্র মির্জা আলীজান কামার ছিলেন কবি, নাট্যকার ও মঞ্চকর্মী। কামারের পুত্র মির্জা ফকির মোহাম্মদও ছিলেন কবি ও নবাব সলিমুল্লাহর প্রাইভেট সেক্রেটারি। তিনি চিত্রকরও ছিলেন। তাঁর আঁকা চিত্রাবলির বিষয় ছিল প্রকৃতি, গাছপালা, ফুল ইত্যাদি। ১৯৯০ সালে মির্জা ফকির মোহাম্মদের আঁকা দুটি চিত্রকর্ম আহসান মঞ্জিলে তাঁর মেয়ের ঘরে দেখেছিলেন অনুপম হায়াৎ।
মেহেরবানুর দাদা নওয়াব গনি ও নওয়াব আহসানুল্লাহও চিত্ররসিক ছিলেন। বিদেশি শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে তাঁরা নওয়াববাড়িকে চিত্রময় করে রেখেছিলেন। আহসানুল্লাহ ১৮৮০ সালে উইলস নামে এক শিল্পীকে কলকাতা থেকে আনিয়ে সামিয়ানা চিত্রিত করিয়েছেন। আহসান মঞ্জিলের পাঠাগারেও চিত্রকলা বিষয়ক সচিত্র গ্রন্থ ছিল বেশ কিছু।
মেহেরবানু ঠিক কবে থেকে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন তা জানা যায়নি। তবে ১৯১৩-১৪ সালে তোলা একটি আলোকচিত্রে দেখা যায় মেহেরবানু পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত হয়ে ছবি আঁকছেন। মোসলেম ভারত বলছে, "অবসর সময় বিনোদনের জন্য তিনি যে পথ (চিত্রাংকন) বাছিয়া লইয়াছেন, ইহা হইতে উৎকৃষ্ট পথ আর কিছু আছে কিনা জানি না।"
মেহেরবানু মারা যান ১৯২৫ সালে। মোসলেম ভারতে প্রকাশ হওয়া দুটি ছবি ছাড়া তাঁর আর কোনো ছবির কথা জানা যায় না। তবে অনুপম হায়াৎ ধারণা করেন, একজন শিল্পী কেবল দুটি ছবি এঁকেই পরিতৃপ্ত থাকবেন, তা হয় না। নিশ্চয়ই তিনি আরো ছবি এঁকেছেন তবে সেগুলো কালের গর্ভে চাপা পড়েছে।
অনুপম হায়াতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কিভাবে মেহেরবানু খানমের সন্ধান পেয়েছিলেন?
অনুপম হায়াৎ: আমি কলেজে পড়া শুরু করি ১৯৬৬ সালে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নজরুলের খেয়াপারের তরণী অন্তর্ভুক্ত ছিল। কবিতাটির ঠিক নীচেই টিকা হিসাবে লেখা ছিল, ঢাকার নবাব পরিবারের এক নওয়াবজাদীর আঁকা ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতাটি লেখেন কবি নজরুল। কিন্তু নওয়াবজাদীর কোনো নাম লেখা ছিল না। কিন্তু বিষয়টি আমার মনে দাগ কেটেছিল। পরে আটাত্তর সালে যখন নজরুলকে নিয়ে গবেষণা শুরু করি তখন নওয়াব পরিবারের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়েও আগ্রহী হই।
তারপর চলচ্চিত্রের ইতিহাস বিষয়ে কাজ করতে শুরু করি আর জানতে পারি ঢাকায় নওয়াব পরিবারই চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ শুরু করে। ওই পরিবারের সদস্য খাজা আজমল পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিসের নায়ক ছিলেন। তাঁর পিতা খাজা আজম ছিলেন ঢাকা পঞ্চায়েতের প্রধান। কিন্তু তখনো মেহেরবানুর কথা জানতে পারিনি। খাজা মোহাম্মদ হালিম ছিলেন ঢাকার একজন কমিশনার, বাস করতেন আহসান মঞ্জিলে। তাঁর ঘরে আমি স্তুপ করা নওয়াব বাড়ির দলিলপত্র, দুর্লভ আলোকচিত্র দেখতে পাই। প্রায় দিনই আমি তাঁর সান্নিধ্য নিতাম, তিনি আমাকে দলিলপত্র বা চিঠি বা ডায়রি থেকে নানান কিছু পড়ে শোনাতেন। এরই ফলাফলে আমি 'নওয়াব পরিবারের ডায়রিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি' গবেষণাগ্রন্থটি লিখে শেষ করতে পেরেছিলাম। আর আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল মেহেরবানু খানমের চিত্রজগত।
তারপর কিভাবে এগুতে থাকলেন?
অনুপম হায়াৎ: মেহেরবানু খানমের কথা জানতে পেরে আমি শিহরিত হয়েছিলাম। আনিস স্যারকে (ড. আনিসুজ্জামান) জানালাম এই কথা। স্যার উৎসাহ দিলেন, বিস্তারিত গবেষণা করতে বললেন। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক ও ঢাকা গবেষক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম স্যারের সাহায্য নিতে চাইলাম। তাঁর কাছে ১৯২০ সালের মোসলেম ভারত সংখ্যাটি ছিল। স্যার সেটি ব্যবহারের অনুমতি আমাকে দিলেন। তারপর থেকে আমার উৎসাহ বেড়ে দ্বিগুণ হলো।
ছবি আঁকায় মেহেরবানুর গুরু কে ছিলেন?
অনুপম হায়াৎ: তিনি স্বশিক্ষিত। তাঁর কোনো গুরুর সন্ধান পাইনি। একটি ফটোগ্রাফে দেখতে পাই তিনি ইজেলের ওপরভাগে একটি ছবি রেখে নীচের ক্যানভাসে সেটি কপি করছেন।
তৎকালীন সময়ে এক মুসলমান নারীর ছবি আঁকা কতটা ব্যতিক্রমী বলে আপনি ভাবেন?
অনুপম হায়াৎ: নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী এবং দুঃসাহসিক। কারণ তখন নারীদের হস্তাক্ষর পরপুরুষে দেখার ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তাই মেহেরবানু এবং তার পরে আর যেসকল নারী শিল্পী চিত্রচর্চা করেছেন তাঁদের বেশিরভাগই রয়ে গেছেন অন্তরালে বা হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। মোসলেম ভারতে ছাপা না হলে হয়তো মেহেরবানুও অজ্ঞাতই থেকে যেতেন। তাঁর স্বামী যেহেতু সংস্কৃতিমনা ছিলেন, তাই তাঁর কিছু সুবিধা হয়েছিল।
এটা কি বলা যায়, মেহেরবানু নবাব পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়েও অগ্রসর ছিলেন?
অনুপম হায়াৎ: হ্যাঁ বলা যায়। তিনি যখন ছবি আঁকতেন তখন তাঁর ভাই-বোনরা ব্যস্ত থাকতেন ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতর ওড়ানো বা অন্য কিছু নিয়ে। আর মেহেরবানু সংসারধর্ম পালন করেও চিত্রকলা চর্চা করেছেন। তিনি অবশ্যই সময়ের চেয়ে অগ্রসর ছিলেন।
মোসলেম ভারতে ছাপা হওয়া ছবি দুটি ছাড়া মেহেরবানুর আর কোনো ছবি কি পাওয়া যায়নি?
অনুপম হায়াৎ: না আর কোনো ছবি পাইনি। মোসলেম ভারতে ছাপা হওয়া ছবি দুটির মূল কপিও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রামাণ্য ভাবেই জানতে পেরেছি, তিনি ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন ১৯১২-১৩ সালে। সে হিসেবে মারা যাওয়া (১৯২৫ সাল) পর্যন্ত এক যুগ ধরলে তিনি নিশ্চয়ই আরো ছবি এঁকেছেন। কিন্তু সেসবের কোনো সন্ধান পাইনি। তবে আমি তাঁর কবর খুঁজে পেয়েছি, সেটি আছে জীবন বীমা ভবনের কাছে দিলকুশা মসজিদ চত্বরে।