এক বিদ্রোহী চিত্রশিল্পী; যিনি ভারতবর্ষের শিল্পজগতে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন
কিছু শিল্পীর মৃত্যুর পরেও তার কাজ ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে নানা রহস্য এবং আলোচনা চলতেই থাকে। ভারতীয় চিত্রশিল্পী বাসুদেব সন্তু গাইতোন্ডে ছিলেন এমনই একজন। ১০০ বছর আগে ১৯২৪ সালের ২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন গাইতোন্ডে।
দক্ষিণ এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বিমূর্ত চিত্রশিল্পীদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। গাইতোন্ডে শিল্পীদের সেই বিদ্রোহী প্রজন্মের অংশ ছিলেন, যারা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষে শিল্পের এক নতুন যুগের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। খবর বিবিসির
তিনি পশ্চিমা চিত্রশিল্পীদের ব্যবহৃত কৌশল দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তবে তার কাজের মধ্যে নিহিত ছিল এশীয় দর্শন। তিনি তার শিল্পে আলো ও রঙের বিন্যাসের মধ্যে এমনভাবে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতেন যে, ভক্তরা বলতেন এই ব্যঞ্জনা; মনে গভীর প্রশান্তির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
সোথবি'স বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় শিল্পকলার আন্তর্জাতিক প্রধান হিসেবে কাজ করা ইয়ামিনী মেহতা বলেন, তার আঁকা চিত্রকর্মগুলো ছিল 'আলো ও মহাবিশ্ব নিয়ে ধ্যান'।
তিনি বলেন, 'আলো ও ছায়া এবং রঙের বিন্যাসের খেলা এই চিত্রকর্মগুলোকে জীবন্ত করে তোলে।'
কয়েক দশক ধরে শিল্প চর্চা করা গাইতোন্ডে কখনও খ্যাতি বা ভাগ্যের পিছনে ছুটেননি। কিন্তু ২০০১ সালে মৃত্যুর পরও, তার কাজগুলো নিলামে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে।
২০২২ সালে তার একটি শিরোনামহীন তৈলচিত্র ৪২০ মিলিয়ন রুপি (প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার; ৩.৯ মিলিয়ন পাউন্ড) আয় করেছিল, যা সেই সময়ে ভারতবর্ষের শিল্পকর্মের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড তৈরি করেছিল।
চিত্রকর্মটির নীলচে ছায়াগুলো দর্শকদের সমুদ্র বা আকাশের বিশাল বিস্তৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
গাইতোন্ডে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় নিভৃতচারী হিসেবে কাটিয়েছেন। তিনি 'জাপানি জেন' দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এই ধ্যানমগ্ন মানসিকতার প্রতিচ্ছবি প্রায়ই তার চিত্রকর্মগুলোতে উঠে এসেছে।
১৯৯১ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক প্রীতিশ নন্দীকে শিল্পী বলেছিলেন, সবকিছু নিস্তব্ধতা থেকে শুরু হয়। ক্যানভাসের নিস্তব্ধতা, পেইন্টিং নাইফের নিস্তব্ধতা। এই সমস্ত নিস্তব্ধতা ধারণ করার মধ্য দিয়ে শিল্পী কাজ শুরু করেন... তার সমগ্র অস্তিত্ব ব্রাশ, পেইন্টিং নাইফ, ক্যানভাসের সঙ্গে একসঙ্গে মিলেমিশে সেই নীরবতাকে গ্রহণ এবং প্রকাশ করার কাজ করে।
গাইতোন্ডের পরিবার মূলত ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গোয়ার অধিবাসী ছিল। সেখান থেকে তার পরিবার মুম্বাই শহরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তারা শহরটিতে শ্রমিকদের বসবাসের জন্য থাকা একটি সস্তা তিন কামড়ার বাড়িতে বাস করতেন।
গাইতোন্ডে ১৯৪৬ সালে প্রশিক্ষণের জন্য মুম্বাইয়ের বিখ্যাত জেজে স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন। বাবার মত না থাকায় গাইতোন্ডে নিজেই নিজের পড়ার খরচ যোগাড় করেছিলেন এবং ১৯৪৮ সালে তিনি এ বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
কিছুদিন তিনি 'প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ'- নামের ভারতীয় শিল্পীদের একটি গ্রুপের অংশ ছিলেন। নতুন ধারার শিল্পকর্মকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৪৭ সালে মুম্বাইয়ে এই গ্রুপটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ফ্রান্সিস সুজা, এস এইচ রাজা, এমএফ হুসেন এবং অস্কার জয়ী প্রথম ভারতীয় ভানু আথাইয়ার মতো শিল্পীরা এর সদস্য ছিলেন।
গাইতোন্ডে মুম্বাইয়ের ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটেও চাকরি করেছিলেন। সেতারবাদক রবি শঙ্কর এবং নাট্যশিল্পী ইব্রাহিম আলকাজির মতো কিংবদন্তিরা প্রায়ই সেখানে যেতেন।
গাইতোন্ডের ওপর মারাঠি ভাষায় একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন শিল্পী ও লেখক সতীশ নায়েক।
সতীশ নায়েক বলেন, 'এটি একটি দুর্দান্ত সময় ছিল, কারণ মুম্বাই ছিল সৃজনশীলতার কেন্দ্রস্থল।'
সেই সময়ে ভারতবর্ষের শিল্পে মূলত রিয়েলিজম ধারার আধিপত্য ছিল। অজন্তা গুহার দেয়ালচিত্র এবং মুঘল শিল্প বা চিত্রকর্মগুলোতে এর প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়।
নায়েক বলেন, 'গাইতোন্ডে রিয়েলিজম ধারা দিয়ে শুরু করলেও, কিছুদিন পরই তিনি ভিন্ন পথে পা বাড়ান। তিনি ছিলেন শুরুর দিকের সেইসব শিল্পীদের একজন, যারা মূর্ত প্রতীক আঁকার বদলে, বিমূর্ত শিল্প আঁকতে শুরু করেছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, 'সেই অর্থে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। কেউ তাকে যেভাবে নির্দেশ দেবে সেভাবে নয়, তিনি নিজের খুশিমতো আঁকতে চেয়েছিলেন।'
আধ্যাত্মিকতার প্রতি গাইতোন্ডের গভীর আগ্রহ, তাকে তার শিল্পকর্মে উন্নতিতে করতে সাহায্য করেছিল।
১৯৬৩ সালে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের জন্য লেখা এক প্রশ্নাবলীতে তিনি লিখেছিলেন, 'আমার আঁকা ছবি প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়।'
১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমূর্ত ধারার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মরিস গ্রেভস ভারত ভ্রমণের সময় গাইতোন্ডের শিল্পকর্ম দেখেছিলেন এবং দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তিনি তৎক্ষণাৎ নিউ ইয়র্কের উইলার্ড গ্যালারির ড্যান এবং ম্যারিয়ান জনসনকে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি গাইতন্ডেকে 'তার দেখা অন্যতম সেরা শিল্প 'হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
গ্রেভস তার চিঠিতে লিখেছিলেন, 'তিনি মার্ক রথকোর মতোই দুর্দান্ত বা সেরা এবং একদিন অবশ্যই তিনি একজন বিশ্বখ্যাত শিল্পী হয়ে উঠবেন।'
তিনি আরও লেখেন, তিনি অসম্ভব সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন এক বিমূর্ত চিত্রশিল্পী। তার শিল্পকর্মগুলো মনের সঙ্গে ও আলোর ব্যঞ্জনার সুন্দরতম ল্যান্ডস্কেপ।
১৯৬৪ সালে, গাইতোন্ডে রকফেলার ফেলোশিপ পাওয়ার পর নিউ ইয়র্কে চলে যান। পরবর্তী দুই বছর তার কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ছিল, যেখানে এই তরুণ শিল্পী আমেরিকান আধুনিক শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাদের কাজ দেখেন, যা তার শৈলীকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করে।
১৯৭১ সালে শিল্পকলায় অসামান্য অবদানের জন্য গাইতোন্ডে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী লাভ করেন।
তবে তার খ্যাতি অনেক বাড়লেও, পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি আরও বেশি অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন।
নায়েকের বইয়ে তার শিষ্য এবং প্রখ্যাত শিল্পী লক্ষ্মণ শ্রেষ্ঠ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে মকবুল ফিদা হুসেন প্রায়ই গাইতোন্ডের সঙ্গে তার দিল্লির বাড়িতে দেখা করার চেষ্টা করতেন।
গাইতোন্ডে কারো সঙ্গে দেখা করতে না চাইলে দরজা খুলতেন না, এমনকি হুসেনের জন্যও না। হুসেন সেসময় দরজায় কিছু স্কেচ এঁকে রেখে যেতেন। এটাই ছিল তাকে হুসেনের 'আমি এসেছিলাম' বলার ভঙ্গি।
ক্রমে তার কাজেও পরিবর্তন এসেছিল। সাধারণত এই শিল্পী বছরে ছয় থেকে সাতটি ছবি আঁকতেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে মেরুদণ্ডের আঘাত পাওয়ার পর সেই সংখ্যা অনেকটাই কমে যায়।
তিনি একবার আর্ট গ্যালারিস্ট দাদিবা পুন্ডোলকে বলেছিলেন, 'আমি এখনও ছবি আঁকি; মাথার ভেতর ছবি আঁকি। আমার শক্তি এখন খুব সীমিত, আমার এটা [শক্তি] সংরক্ষণ করা দরকার এবং ক্যানভাসে পেইন্ট লাগানোর মধ্য দিয়ে আমি তা নষ্ট করতে পারি না।'
শিল্পী হিসেবে গাইতোন্ডের মর্যাদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, তার চিত্রকর্মের সংখ্যা আরও কমে যায়। এর ফলে তার শিল্পকর্মগুলোকে ঘিরে আকর্ষণ এবং রহস্য বাড়তে থাকে।
আজও তার চিত্রকর্মগুলোর এত চড়া দাম ওঠার এটিও সম্ভবত একটি কারণ।
২০০১ সালে ৭৭ বছর বয়সে গাইতোন্ডে যখন মারা যান, তখন তার মৃত্যুর কথা খুব কম মানুষই জানতে পেরেছিল। কারণ তিনি তার জীবনের শেষ বছরগুলো সবার অলক্ষ্যে কাটিয়েছিলেন।
কিন্তু মৃত্যুর পরও তার চিন্তা-উদ্দীপক ক্যানভাসগুলো বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলতে থাকে।
মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের সহযোগী কিউরেটর কারা মানেস একবার বলেছিলেন, গাইতোন্ডের কাজগুলো নীরবতা দেখতে কেমন হতে পারে, তার একটি মূর্ত প্রতীক।
এই শিল্পীর কাছে অবশ্য শিল্প ছিল আত্মপ্রকাশের গভীর ব্যক্তিগত রূপ।
তিনি প্রায়ই বলতেন, 'আমি রংগুলোকে বয়ে চলতে দেই আর দেখি। সেটিই আমার চিত্রকর্ম।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি