আবদুল হালিম: তুলির ছোঁয়ায় দেশের প্রাইমারি স্কুল রাঙিয়ে তোলা যার নেশা
মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল মো. আবদুল হালিমের সঙ্গে। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল বাচ্চাদের উচ্ছ্বসিত হাসি ও দৌড়ানোর আওয়াজ। মাঝেমধ্যে গানের কণ্ঠও শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তিনি কোনো পার্কে বসে আছেন। কিন্তু না, আবদুল হালিম আছেন ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুরের একটি প্রাইমারি স্কুলে। তিনি ও তার তিন সহযোগী মিলে ওই স্কুলে রং করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তখন।
ফোনের ওপাশ থেকে তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশে ১৫-২০ জন শিশু আছে। স্কুলের রং করার প্রকল্প নিয়ে ওরাই সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত। ওরা রং আর আঁকাআঁকি এত ভালোবাসে যে প্রতিদিন আমাদের চারপাশে জড়ো হয় এবং খেলা করে। এটি আমাদের কাজ করার জন্য আরও উৎসাহিত করে।'
হালিম নিয়মিত তার প্রজেক্টের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন। স্কুলগুলোতে গেলে তার আঁকা রঙিন দেয়ালগুলোতে চোখ পড়বে আপনার। সেখানে আছে হলুদ সূর্যের সঙ্গে গাঢ় নীল আকাশ কিংবা কমলা আকাশের নিচে নীল হ্রদে লাল পাল তোলা নৌকা। প্রাণবন্ত রঙে আঁকা দেয়ালগুলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও আপনার চোখকে চমকে দেবে।
হালিম বললেন, 'এ পর্যন্ত আমি ও আমার টিম সারা দেশে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালীসহ দেশের প্রায় ৩০টিরও বেশি জেলায় দুই শতাধিক বিদ্যালয়ে ছবি এঁকেছি। সবগুলোই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।'
তিনি জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শাখা রং করার জন্য বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও ইউএনওরা (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) তাকে নিয়োগ দেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যানের (এসএলআইপি) অংশ হিসেবে শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক অর্থ বরাদ্দ থাকে। সেখান থেকেই এসব কাজের বরাদ্দ আসে।
২০২৩ সালের স্লিপ নির্দেশিকা অনুযায়ী, যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী নেই, সেসব বিদ্যালয়ে ৫০ হাজার টাকা, ৫১ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ, ৩০১ থেকে ৬০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার, ৬০১ থেকে ১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২ লাখ টাকা এবং এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে।
শিক্ষা উপকরণ কেনা, অবকাঠামো ও আসবাবপত্র সংস্কার, শ্রেণিকক্ষের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করা, ওয়াটার পিউরিফায়ার কেনা (প্রয়োজনে), ক্লাব ও স্কাউট কার্যক্রমে বিনিয়োগ, জমির ফি পরিশোধ ইত্যাদি কাজে এই অর্থ খরচ করা হয়।
এই পরিকল্পনার আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এখন রঙিন ক্লাস ও বারান্দা দিয়ে তাদের ইন্টেরিয়র সংস্কার করছে।
এ নিয়ে আমরা কথা বলি নোয়াখালীর সেনবাগের পূর্ব মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ইয়াসমিন আক্তারের সঙ্গে। গত ডিসেম্বরে হালিম তার দলের দুই সদস্যকে নিয়ে তিন দিন ওই বিদ্যালয়ে অবস্থান করে প্রাক-প্রাথমিক বিভাগ ও বারান্দা রং করেন।
ইয়াসমিন আক্তার বলেন, 'শিশুরা এখন স্কুল নিয়ে এত খুশি যে ওরা শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা করে আনন্দ পাচ্ছে। বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ রং করা হয়নি। বাকি অংশগুলো রং করার জন্য আমরা তাকে (হালিম) আবার ডেকে আনার পরিকল্পনা করছি।'
এই প্রকল্পের জন্য হালিম ৩০ হাজার টাকা দাবি করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ দরদাম করে ২৭ হাজার টাকায় তা করিয়ে নেয়। হালিম বলেন, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে হলেও শেষ পর্যন্ত সবাই তার কাজের প্রশংসা করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে ছবি আঁকছেন
চল্লিশ বছর বয়সী হালিমের জন্ম ময়মনসিংহের আট ভাইবোনের এক বিশাল পরিবারে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। ২০০০ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পাস করেন। আর্থিক অনটন ও পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে তিনি আর পড়াশোনা করতে পারেননি।
খানিকটা আক্ষেপের সুরে হালিম বলেন, 'কে না বেশি পড়াশোনা করতে চায়, বলেন, আপা? চারুকলা নিয়ে যদি পড়তে পারতাম, খুব ভালো হতো। কিন্তু যে ঘটনা ঘটেনি, তার জন্য আফসোস করে লাভ কী? '
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে স্কুলে পড়ার সময় হালিম তার ওস্তাদ (শিক্ষক) আবদুস সালামের অধীনে ব্যানার এবং সাইনবোর্ড আঁকতে শেখা আরম্ভ করেন। চারুকলায় তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও তার কাজগুলো ছিল সুন্দর।
তিন বছর আগে হালিমের মা মারা যান। এ নিয়ে হালিম বলেন, 'লেখাপড়া করতে পারিনি, কিন্তু বুঝেছি শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই কষ্ট হলেও সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছি।'
হালিমের মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে।
২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হালিম ব্যানার-পোস্টার তৈরি এবং রাস্তাঘাট রং করতেন। ২০১৭ সালে তিনি ও তার দল ছবি আঁকা শুরু করেন।
তার ভাষ্যে, 'ডিজিটালি প্রিন্ট করা ব্যানার, পোস্টার আসার পর হাতে আঁকা ব্যানারগুলো চাহিদা হারিয়ে ফেলে। তাই আমরা কাজ করার জন্য বিকল্প প্রকল্প খুঁজছিলাম। সেজন্যই শেষ পর্যন্ত স্কুলের ছবি আঁকার ভাবনাটা আমাদের মাথায় আসে।'
মোট ছয় থেকে সাতজন কর্মচারী নিয়ে হালিম দুই শিফটে কাজ করেন। একটি স্কুলের কাজ শেষ করতে তাদের অন্তত তিনজন লোক লাগে।
তিনি যোগ করেন, 'সময় নির্ভর করে স্কুলের আয়তনের ওপর। একটি বারান্দা ও তিনটি শ্রেণিকক্ষসহ একটি স্কুলের রং শেষ করতে আমাদের দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। আমরা সবচেয়ে বেশি দিন কাজ করেছি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের একটি স্কুলে। এটি শেষ করতে আমাদের প্রায় এক মাস সময় লেগেছে।'
প্রাক-প্রাথমিক বিভাগ ও বারান্দায় তারা বিভিন্ন বর্ণমালা, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ, সংখ্যা, ঋতু, সপ্তাহের দিন, বাংলা মাস ইত্যাদি আঁকেন। বারান্দায় আমাদের দেশের জাতীয় প্রতীকসমূহের চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়।
আর রুমের সিলিংয়ে সাধারণত ছায়াপথ, সৌরজগৎ, রংধনু, হাস্যোজ্জ্বল সূর্য এবং ফুল, পাখি ইত্যাদির ছবি থাকে।
তিনি বলেন, 'আমরা শিশুদের জন্য একটি রঙিন পরিবেশ তৈরি করতে চাই। সাধারণত বাজার থেকে পাঁচ থেকে ছয়টি রং পাওয়া গেলেও আমরা সেগুলোকে মিশিয়ে ১৫ থেকে ২০টি রং তৈরি করি।'
হালিম জানান, তারা গ্যালন হিসেবে [মূলত বার্জার পেইন্ট] রং কেনেন। মাসে গড়ে ১৫-২০টি স্কুলে রং করতে তাদের ২০ থেকে ৩০ গ্যালন রং লাগে।
বারান্দা রং করার জন্য হালিম ১৫-২০ হাজার টাকা নেন। আর সিলিংসহ একটি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ রং করার জন্য নেন ১৫ হাজার টাকা।
বাচ্চাদের ওপর অতিরিক্ত উজ্জ্বল রঙের প্রভাব কেমন ?
আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন স্পেশালিস্ট এবং এবিসি আর্লি লার্নিং ডে কেয়ার সেন্টারের মালিক, সোনিয়া আকরাম অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছেন এবং সেখানে আট বছর ধরে ডে কেয়ার সেন্টারে কাজ করেছেন।
তার মতে, শিশুরা যেখানে থাকবে সেই জায়গার ইন্টেরিয়র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেয়ালগুলো খুব বেশি রঙিন হওয়া উচিত নয়, এগুলো তাদের মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উত্তেজিত করবে। তিনি বলেন, 'রঙের শেড (ছায়া) হওয়া উচিত একটু ফ্যাকাশে ও উষ্ণ।'
সোনিয়া যোগ করেন, 'এখনকার শিশুরা প্রচুর মিষ্টি খাবার খায় এবং তারা টিভি ও মোবাইল স্ক্রিনে প্রচুর সময় দেয়। স্ক্রিনের অতি উজ্জ্বল রংগুলো তাদের মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে।'
তবে হালিম নিয়ন-জাতীয় রং ব্যবহার না করে লাল, নীল এবং হলুদ রংগুলো ব্যবহার করেন।