স্মোকি ফ্লেভারের ধোঁয়া ওঠা তন্দুরি চা! হয়ে যাক এক কাপ...
ফুল-লতাপাতা আঁকা, কারুকাজে ভরা তামার পাত্রটির ভেতর যখন টগবগ করে চা ফুটছিল, সেইসময় মিতু আর তার বন্ধুদের উচ্ছ্বাসটা ছিল চোখে পড়ার মতোই! চা-টা খেতে কেমন হবে, তৈরি চায়ের মধ্যে মাটির ভাঁড়টা কেন দেওয়া হলো, ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বেশ বেগই পেতে হচ্ছিল বিসমিল্লাহ ক্যাফেইনের সত্বাধিকারী সুমনকে। তা-ও হাসিমুখেই কৌতূহল মেটাচ্ছিলেন, পাশাপাশি 'চা' বানাতে হাতও চলছিল সমান পারদর্শিতায়। তবে যে-সে চা নয়, রীতিমতো তন্দুরে পোড়ানো চা!
বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যার পালা, চলছিল তন্দুরি চা বানানোর বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। একদিকে বড় এক ডেকচিতে ফুটছে গরুর দুধ! ওপরে সেই দুধের বেশ পুরু সর। গরুর দুধের মিষ্টি সুবাস, গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। এরই এক পাশে বিশাল এক ড্রামে চলছে চা বানানোর যজ্ঞ। এলাচসহ বেশ কয়েক ধরনের গরম মশলার সেই চা যখন ফুটছে, তখন নিচে তাকাতেই চোখ পড়ে একটি পাত্রের দিকে। বেশ কয়েকটি মাটির ভাঁড় পোড়ানো চলছে সেখানে। সুমনের ভাষ্য, "তন্দুর চায়ের আসল মজাই এটি। এই পুড়ে যাওয়া মাটির ভাঁড় চায়ে ডোবানো হলে তবেই মিলবে তন্দুরের স্বাদ!"
বলতে বলতেই এরপর তন্দুরে পোড়ানো সেই ভাঁড় থেকে আরেকটি মাটির ভাঁড়ে সবার হাতে চায়ের মটকা তুলে দিলেন সুমন। চা মুখে দিয়েই কিছুটা বিস্ময় যেন মিতু আর তার দলবলের চোখেমুখে।
"মাটির ভাঁড় বা মটকায় ঘন গরুর দুধের চা! আর সেই চায়ে পোড়া মাটির ভাঁড়ের ঘ্রাণ মিশে কিছুটা স্মোকি ফ্লেভার, ওপরে ভাসছে মালাই। অর্থাৎ মশলা চায়ের সঙ্গে মালাইয়ের সংযোজন—সবমিলে ভীষণ উপভোগ্য তন্দুরি চা।" গুলিস্তান পেরিয়ে পুরোনো ঢাকার তাঁতিবাজার এরপর লক্ষ্মীবাজার। হেমন্তের এক সন্ধ্যায় সেখানে চা খেতে খেতে এভাবেই তন্দুর চায়ের বর্ণনা দিলেন উচ্ছ্বসিত মিতু।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর এই দলটি ক্লাস শেষ হলেই বেরিয়ে পড়ে একসঙ্গে। মিতুদের সেদিনের আড্ডাস্থল ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মুসলিম গভ. হাইস্কুল আর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের মাঝখানে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেখানেই। রাজ কচুরি, নেপালি চিকেন মোমো, ফুচকা, দই ফুচকা, ঝালমুড়ি, সঙ্গে জিলাপি, পিঁয়াজু, বেগুনি—সবমিলে আরও হাজারো খাবারের পসরা সেখানটায়। তবে সেই সন্ধ্যায় মিতুর বন্ধুদের মিশন ছিল 'তন্দুরি চা' খাওয়া, তাই তাদের হাজিরা 'বিসমিল্লাহ ক্যাফেইনে'। তাদের আড্ডা-গান যখন তুঙ্গে, তখনই সুমনের তন্দুরি চায়ের অনবদ্য স্বাদ নিতে নিতে তার সঙ্গে গল্পে মজে যাই।
তার মুখ থেকেই জানলাম, ২০১৮ সালে অনেকটা শখের বশে খুলেছিলেন দোকানটি। ভ্যানগাড়ির ওপর সাজানো-গোছানো বেশ পরিপাটি তার দোকান। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা... ষড়ঋতুর দেশে সবসময়ই চলে দোকানটি। চকলেট তন্দুরি, মালাই তন্দুরি, কফি তন্দুরি, মাসালা তন্দুরি, সবই বিক্রি হয় বছরজুড়ে। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০ টাকাতেই মিলবে এসব চা। তবে শীতকালে বিক্রিবাট্টার মাত্রা বেড়ে যায় প্রচুর পরিমাণে। বিকেল ৪টা থেকে শুরু করে রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত চলে বিকিকিনি। দিনে দুইশ', চারশ' কাপ পর্যন্ত চা বিক্রি হয় অনায়াসেই। তবে গরমের সময় স্বাভাবিকভাবেই চা বিক্রির মাত্রা কিছুটা কমই থাকে বলে জানালেন পুরান ঢাকার এ চা বিক্রেতা।
একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ল আরও একটি তন্দুরি চায়ের দোকান। 'শাহি সুলতানি চা' নামে সেই চায়ের দোকানটিও বেশ শাহিভাবেই সাজানো। ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের আনাগোনা চলে বিকেলের পর থেকেই। এখানকার দোকানি কাজলের মুখে শুনলাম, ওই রাস্তা ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলেই আরেকটি তন্দুরি চায়ের দোকানের দেখা মিলবে।
তন্দুরি চায়ের আদ্যোপান্ত!
দুধ চা। বাঙালির অন্যতম প্রিয় এক পানীয়। মন ভালো হলে চা, মন খারাপ থাকলে চা, আড্ডায় চা, সুখে চা, অসুখে চা, বিষাদে চা, নিঃসঙ্গতার বন্ধু চা। যেকোনো পরিস্থিতিতে চা টা যেন বাধ্যতামূলক। বাঙালিদের চা প্রেম নতুন কিছু নয়, এক কাপ চায়ে প্রেয়সীকে চাওয়া নিয়ে গান লিখে ফেলা বাঙালিদের পক্ষেই সম্ভব। হুমায়ূন আহমেদ তার জনপ্রিয় সৃষ্টি হিমুর ওপর লেখা বইগুলোতেই যতবার দুধ চা নিয়ে বলেছেন, অন্যকোনো সাহিত্যে এতোবার দুধ চা নিয়ে লেখা হয়েছে কিনা জানা নেই। এই এক চা নিয়ে রোমান্টিসিজমের কি ঘাটতি আছে? চা বানানো নিয়েও তেমনি চা প্রেমীদের রয়েছে হাজারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
তবে তন্দুরি চায়ের ধারণাটি কিন্তু বেশ নতুন। ২০১৮ সালের দিকে ভারতের পুনেতে দুইজন চা বিক্রেতা তন্দুরি চা প্রথম আবিষ্কার করেন। পরে এই চা বানানোর পদ্ধতি ভাইরাল হয়ে পড়ে, দেখাদেখি বাংলাদেশেও চালু হয়ে যায় এরপরই।
মশলা চায়ের চল তো ছিলই আগে থেকেই, সেই চায়ে একটু স্মোকি ফ্লেভার হলেই বা মন্দ কী! স্বাদ? দুধ চাপ্রেমীদের জন্য এককথায় অনবদ্য। দুধ চায়ের সঙ্গে হালকা একটু ধোঁয়ার ঘ্রাণ। গ্রামে খড়ির চুলায় রাঁধলে খাবারে যেমন একটা সুন্দর ঘ্রাণ পাওয়া যায়, এই তন্দুরি চাও খেতে কিছুটা সেরকম। আবার মশলা চাপ্রেমীদের ক্ষেত্রেও এ চায়ের স্বাদ মন কেড়ে নেবে নিঃসন্দেহে। একে তো ঘন জ্বাল দেওয়া দুধ, তন্দুরে পোড়ানো ভাঁড়ের ধোঁয়া ধোঁয়া ঘ্রাণ—জিভে জল আসতে তো বাধ্য।
নাম তন্দুরি কেন? এই উত্তর সহজভাবে দিলেন সুমন। জানালেন, তন্দুর রুটি যেমন তন্দুরে দিয়ে পোড়ানো হয়, তেমনি এই চাও তাই!
কোথায় কোথায় পাওয়া যায় তন্দুরি চা
ভারতে এর প্রচলন হলেও বাংলাদেশে আরও অনেক জায়গাতেই এখন পাওয়া যায় তন্দুরি চা। খুব অল্পসময়ে যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই চা তার প্রমাণ মিলবে বিকেলবেলা স্ট্রিটফুডের দোকানগুলোতেই। পুরান ঢাকা তন্দুরি চায়ের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রবিন্দু হলেও, এখন রাজধানীজুড়েই দেখা মেলে তন্দুরি চায়ের।
কোলকাতা তন্দুরি মাটির হাঁড়ির চা
পুরান ঢাকার ৫১/১আগা সাদেক রোডে `কোলকাতা তন্দুরি মাটির হাঁড়ি' নামে এক দোকান। ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা ৬টা। দোকানটির সামনে পাশটায় বেশ হই-হট্টগোল আর খদ্দেরদের বেশ বড়সড় লম্বা লাইন! নাহলেও ২০ থেকে ৩০টা মাটির ভাঁড় রাখা কয়লার ওপর।
দেখলাম, দোকানি চিমটা দিয়ে বের করে আনলেন একটি ভাঁড়। এবার তামার পাত্রে রাখা চায়ে একেবারে পপাত ধরণীতল সেই ভাঁড়। টগবগ ফুটতে থাকা চা, আর কয়লায় পোড়ানো মাটির ভাঁড়ের গন্ধ মিলেমিশে একাকার। তবে ওই ভাঁড়গুলোতে চা পরিবেশন হয় না। আলাদা করে পাশে থরে থরে সাজিয়ে রাখা মটকায় করে পরিবেশন করা হয় এই চা।
বিসমিল্লাহ মটকা চা
গুলশান ১ লেকের পাশে গুদারাঘাটে বিসমিল্লাহ মটকা চায়ের দোকানে মিলবে তন্দুরি চা। শুধু তন্দুর চায়ের ক্ষেত্রে ৩০ টাকা আর মালাই তন্দুর মিলবে ৪০ টাকায়। এছাড়া সাধারণ চা, দুধ চা, মশলা চাও মিলবে এ দোকানে। আর চায়ের স্বাদ যে দারুণ, তার প্রমাণ বোঝা গেল ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে দোকানটি সবার প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে।
চা চাই
গুলশান এভিনিউয়ে `চা চাই'-এর আউটলেটটিতে ভিড়ভাট্টা সবসময় লেগেই থাকে। সাধারণ দুধ চা, চকলেট চা, মালাই চায়ের পাশাপাশি তন্দুরি চাও রয়েছে বহাল তবিয়তে। ৩৫ টাকা থেকে শুরু করে ৯০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের চা রয়েছে। স্পেশাল তন্দুরি চা মিলবে ৯০ টাকাতেই। শীতে এই চায়ের চাহিদা বেড়ে গেলেও সারাবছরই এ চায়ের অনেক চাহিদা রয়েছে বলে জানা গেল দোকানটির কর্মচারীদের কাছে।
দরবারই তন্দুরি
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে দরবারই তন্দুরির অবস্থান। কফিশপ হলেও রং চা, দুধ চা, অরেঞ্জ চাও রয়েছে এখানে। আবার স্পেশাল চা হিসেবে মাখন চা থেকে শুরু করে আরও বেশ কয়েক ধরনের চা রয়েছে। তবে এই কফিশপটির অন্যতম মূল আকর্ষণ তন্দুরি চা। ১০০ টাকার ভেতরই মিলবে দোকানটির চা।
জাফরানি তন্দুরি চা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাপান সিটি গার্ডেন থেকে আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে বেশকিছু ভ্যানগাড়ি। সেখানে রয়েছে জাফরানি তন্দুরি চা।
অন্যান্য সময় লাচ্ছি বিক্রি হলেও নভেম্বর থেকে পুরো শীতের সময়টুকুতেই চলে তন্দুরি চা, জানালেন চা বিক্রেতা রুবেল। দিনে ৩০০ কাপ পর্যন্ত বিক্রি হয় তার চা। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০ টাকার মধ্যে দোকানটিতে মিলবে তন্দুরি চা।
রাজা মামার বিখ্যাত চা
"চা নিয়ে বাঙালির আবেগ তো আর আজকের নয়। আর বন্ধু-আড্ডা-গানে চা না হলে তো চলেই না। তাই চলে আসা রাজা মামার চায়ের দোকানে। সারাবছরই আসা হয় তবে শীত আসার এই সময়টায় তন্দুরি চা খেতে বেশ লাগে।"
'রাজা মামার চা'-এর দোকানের নিয়মিত খদ্দের রাকিব আনোয়ার জানাচ্ছিলেন এসব কথা। মিরপুর ৬-এর লাভ লেনে গেলেই দেখা মিলবে রীতিমতো বিখ্যাত এই চায়ের দোকানটি। রাকিব জানালেন, তার বাসা পল্লবী, তবে টিউশনির সুবাদে এখানে প্রত্যেকদিনে আসেন। বন্ধুদেরও নিয়ে আসেন চা খাওয়াতে। দামটাও হাতের নাগালে বলে জানালেন তিনি।
এছাড়াও বসুন্ধরাসহ আরও অনেক জায়গাতেই এখন পাওয়া যায় তন্দুরি চা। নামের মতোই স্বাদ, ঘ্রাণ আলাদা হওয়ায় খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই তন্দুরি চা।