কপ-২৭ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল: দক্ষিণ এশিয়া কী সুবিধা পাবে?
মিশরের শার্ম আল-শেখে এবারের আয়োজিত জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৭ এ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো উন্নয়নশীল ও জলবায়ু পরিবর্তনে সংকটাপন্ন দেশগুলোর জন্য 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল গঠনে চুক্তি করেছে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে শুরু থেকেই গড়িমসি করে আসছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সহায়তা ও ক্ষতিপূরণের দাবী জানাচ্ছে। অবশেষে কপ-২৭ সম্মেলনে এসে আলোর মুখ দেখল এই তহবিল।
ক্লাইমেন্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের গ্লোবাল পলিটিকাল স্ট্রাটেজি-র প্রধান হারজিত সিং বলেন, "নতুন 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল গঠন কপ-২৭ দূষণকারী দেশগুলোর কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। জলবায়ু ও প্রকৃতি বিধ্বংসী কাজ করে এখন আর কেউ এমনি এমনিই পার পাবে না"।
"এই দেশগুলোর কারণে যেসব মানুষ প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড়, ভয়াবহ বন্যা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে", বলেন তিনি।
নতুন এই তহবিল যেন যথাযথভাবে কাজ করার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষ ও কমিউনিটিগুলোকে প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে সব দেশকে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তহবিল গঠনে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশি জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সালিমুল হক বলেন, এই তহবিল গঠন একটি বড় জয়।
দুই সপ্তাহের সম্মেলন শেষে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এটাই প্রথম কপ সম্মেলনে যেখানে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করা হলো।
বিতর্কিত বিষয়
'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' ছিল এবারের কপ-২৭ সম্মেলনের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়।
১৩০টির বেশি উন্নয়নশীল দেশের জোট জি-৭৭ এই তহবিল গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। প্রথমবারের মতো কপের অফিসিয়াল অ্যাজেন্ডায় এই বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছিল।
জলবায়ু বিষয়ক আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল গঠনের পক্ষে একজোট হয়ে অবস্থান নিয়েছিল।
জি-৭৭ এর বর্তমান প্রধান পাকিস্তানের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের লড়াইয়ে মাঠে নামে।
চলতি বছর জুনে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে পাকিস্তান। দেশটির জলবায়ু মন্ত্রী শেরি খান বলেন, তহবিল অবশ্যই সবকিছু নয়, তবে এটা নিশ্চিত করবে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দূষণকারী দেশগুলো ঐতিহাসিক দায়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতি পূরণে ন্যূনতম সহায়তা প্রদান করবে।
তহবিলের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে চূড়ান্ত চুক্তির পর তহবিল কীভাবে কাজ করবে তা নির্ধারণে ২০২৩ সালে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করা হবে।
চুক্তির চূড়ান্ত নথিতে বলা হয়েছে, "প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগ সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির প্রতি সাড়া দিতে তহবিল গঠনের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে"।
২০২৩ সালের মধ্যে তহবিলটি কার্যকর করার জন্য উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি ২৪ সদস্যের অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করা হবে।
জলবায়ু বিপর্যয় পরবর্তী পুনর্গঠনে সহায়তার প্রয়োজন এমন দেশগুলোকে কারিগরি সহায়তার আওতায় আনতে সান্তিয়াগো নেটওয়ার্ক নামের সংস্থা গঠনেও সম্মত হয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা।
নতুন তহবিল নিয়ে অনিশ্চয়তা
সম্মেলনের শেষ দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছুটা শিথিল হতেই জলবায়ু ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের আলোচনা নতুন মোড় নেয়। এর আগে বড় ধরনের দূষণকারী দেশগুলো জলবায়ু সম্পর্কিত দুর্যোগ ও চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার দায় এড়াতে নির্দিষ্ট তহবিল গঠনের বিরোধিতা করে আসছিল।
তহবিলটি আসলেই গঠিত হবে কিনা তা নিয়ে পরিবেশ ও জলবায়ু আন্দোলনকারীরাও সন্দিহান ছিলেন।
তাছাড়া তহবিলে কে বা কারা দান করবে, কত টাকা করে জমা দিবে, কারা এই তহবিল থেকে সুবিধা পাবে- এই বিষয়গুলোও পরিষ্কার নয়। এর বাইরে কোন কোন দেশ ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাটাগরিতে আছে এবং আসলেই কতটুকু ঝুঁকিতে সেগুলো নির্ধারণ করাও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র দাতব্য দেশগুলোর কাতারে চীনের মতো দেশগুলোকেও টানতে চাইছে। তবে বেইজিং প্রায় নিশ্চিতভাবেই এর বিরোধিতা করবে।
অর্থাৎ, তহবিল গঠন ও কার্যকর হতে এখনও বেশকিছু সময় লাগবে।
বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মির্জা শওকত আলী ডিডব্লিউকে বলেন, "বুঝতেই পারছেন এর কার্যক্রম শুরু করতে সময় লাগবে। এক বছরের মধ্যে এর কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে"।
তহবিল সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতিমালা ও পরিচালনা পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে এখনও অনেক সময় লাগবে বলে মনে করেন পাকিস্তানি লেখিকা আফিয়া সালাম।
"এটা কেবল শুরু। এর মানে হলো তহবিল বিষয়ক নীতি চূড়ান্ত হতে হতে আরও কয়েকটি কপ সম্মেলন কেটে যাবে। এর অন্তবর্তীকালে কী ঘটবে তা নিশ্চিত নয়," বলেন তিনি।
শুধু কি মনোযোগ ঘুরাতেই এই চাল?
বন্ড, ইন্সুরেন্সসহ আরও বিভিন্ন উদ্ভাবনী উপায়ে কীভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যায় তা নিয়ে কপ-২৭ সম্মেলনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
গ্লোবাল শিল্ড নামে পরিচিত জি-৭ দেশগুলোও একই সময়ে বন্যা, খরা ও হারিকেনের মতো জলবায়ু বিপর্যয় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে দ্রুত সহায়তা দানে পূর্বপরিকল্পিত ইন্স্যুরেন্স ও অন্যান্য আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে।
জি-৭ সভাপতি জার্মানি ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ভালনারেবল টুয়েন্টি বা ভি-২০ দেশগুলোর সমন্বয়ে তা আয়োজিত হয়।
বার্লিন জানায় তারা এই উদ্যোগে ১৭৯ মিলিয়ন ইউরো দান করবে। ডেনমার্ক ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলোও কয়েক মিলিয়ন ইউরো প্রদানের অঙ্গীকার করে।
কিন্তু সমালোচনরা জানান প্রকৃত 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' ফান্ড থেকে মনোযোগ সরাতেই এই আয়োজন।
চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হবার জন্য কী যথেষ্ট?
দরিদ্র দেশগুলোর অধিকাংশের বক্তব্য হলো তারা অনুদান চায়, কোনো ঋণ বা ইন্স্যুরেন্স নয়। আফিয়া সালামের মতে, এই ঋণ ও ইন্স্যুরেন্স দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
এছাড়া ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ তহবিলের অঙ্গীকার জানিয়েছে সেগুলোও যথেষ্ট নয় বলে তার মন্তব্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় নাইজেরিয়ার মতো দেশের একারই কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ধনী দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই এই চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানে যথেষ্ট নয়।
২০০৯ সালে ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার শুরুর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে সহায়তা করতে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদানের ঘোষণা করে।
তবে আজ পর্যন্ত এই উদ্যোগে কখনোই পুরো তহবিল দেওয়া হয়নি।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে এই অনুদান ৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার মাত্র ২৯ বিলিয়ন ডলার অভিযোজনের জন্য বরাদ্দকৃত।
কিন্তু অক্টোবরে অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনুদানের পরিমাণ প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে অনেক কম বলে তাদের অনুমান। অন্যদিকে জলবায়ু তহবিলের ৭০ শতাংশই ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে।
'বৈশ্বিক দক্ষিণ বা উন্নয়নশীল দেশগুলো কপ-২৭ সম্মেলনে ক্ষুদ্ধ ছিল কেননা আগের কোনো প্রতিশ্রুতিই পূরণ করা হয়নি। ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার কিংবা অভিযোজন সহায়ক ফান্ড কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখেনি কেউ,' বলেন আফিয়া সালাম।
- সূত্র: ডিডব্লিউ থেকে অনূদিত