ব্রিটেনের মাটিতে সবজি-ফল ফলিয়ে নিজেদের এক টুকরো বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মাঝে জনপ্রিয় উঠছে বাগান করা। হরেক রকমের ফুলের পাশাপাশি তারা উৎপাদন করছেন নানা ধরনের মৌসুমি সবজি। নিজের চাহিদা মিটিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শির সাথে এসব ফসল ভাগাভাগি করছেন অনেকে; কেউবা অর্থ উপার্থন করছেন স্থানীয় কোনো গ্রোসারি স্টোরে বিক্রি করে। আবার অনেকে ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে নিজেদের বাগান সম্পর্কিত জ্ঞান বিলিয়ে দিচ্ছেন হাজার হাজার দর্শকদের মাঝে। এমন কজন ব্রিটিশ বাঙালিদের নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান-এ লিখেছেন তাসলিমা বেগম। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পাঠকদের জন্য তা প্রকাশিত হলো।
৮০'র দশকে আমার মা ফুলনাহার বেগম ইংল্যান্ডে প্রথমবার আসেন। তার স্পষ্ট মনে আছে সেসময়ের কথা। বিমানের জানালা দিয়ে নতুন দেশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন, 'এ কোথায় এলাম! সবুজের ছোঁয়া নেই, সবকিছুই ধূসর; কেমন যেন করুণ করুণ দেখতে। দেশের চেয়ে যেন একেবারে ভিন্ন চিত্র এখানে।'
আমার মায়ের বেড়ে ওঠা সিলেটে; চিত্রবৎ পাহাড়ে ঘেরা এবং চাবাগানের জন্য বিখ্যাত বিভাগ সিলেট। মায়ের বাড়ি ছিল বড়খাপন গ্রামে। প্রত্যন্ত এ গ্রামটির সমতলভূমি অত্যন্ত উর্বর; সেখানে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত সোনালী ধানের ক্ষেত। সিলেটের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমী জলবায়ু ফসলের জন্য বেশ উপযুক্ত; অধিকাংশ পরিবার কৃষির ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করে। মায়েদের বাড়ির উঠোনের প্রান্তজুড়ে ছিল নারিকেল, কলা, কাঁঠাল, আম, কমলা, লেবুসহ হরেক রকমের গাছ!
ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে তার মা অর্থাৎ আমার নানি আবিজান বিবি একটি খামে করে চারাগাছের একগুচ্ছ বীজ সুটকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন দেশের নতুন বাড়ির আঙিনায় সেগুলো ছিটিয়ে দেওয়ার উপদেশ দিয়ে নানি বলেছিলেন, 'এতে করে এক টুকরো দেশ সবসময় তোমার সাথে থাকবে।'
কাস্টম অফিসে ব্যাগ চেক করার সময় নানির দেওয়া বীজগুলো এক কর্মকর্তার চোখে পরেছিল। আমার ৭৪ বছর বয়সী মা সেদিনের কথা স্মরণ করে মৃদু হেসে বলেন, 'ভাগ্যিস! অফিসার বীজগুলো আনার অনুমতি দিয়েছিলেন।'
ইংল্যান্ডে এসে মায়েরা পশ্চিম লন্ডনের গাছগাছালিতে ঘেরা শহরতলি ইলিংয়ে নতুন ঠিকানা গড়েন। প্রতি সকালে এ বাড়ির উঠোনের বাগানে তাকালেই তার বাড়ির কথা মনে পড়ে। এ বাগানকে নিয়ে তাই তার ভালোবাসা অন্তহীন। জন্মভূমির স্মৃতির চেয়েও যেন আরও বেশি কিছু এ বাগান; তার ভাষায়, এটি আমাদের সবকিছু এবং এর প্রতিদিন দেখভাল করা দরকার।'
বাগানের লম্বা গাছগুলোর বড় বড় মখমলে পাতাগুলো যেন ডোরাকাটা সামিয়ানা তৈরি করে।এসব গাছের পাতাগুলো মৃদু বাতাসে দোল খেতে খেতে তাদের নিচে থাকা ছোট ছোট কোমল গাছেদের রক্ষা করে যায়।
মা বাগানটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান; এটি তার জন্য সবুজের সমারোহের মাঝে শান্ত উদ্যানে কাটানোর সমতুল্য। তিনি বলেন, 'আমার সন্তানরা এই বাগানেই বড় হয়েছে, এখন আমার নাতিনাতনিরা গ্রীষ্মে এখানে সময় কাটায়।'
এমন গল্প যে শুধু ফুলনাহার বেগমের, তা নয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন বাংলাদেশি বাস করছেন, যাদের অধিকাংশই সিলেটের গ্রামীণ অঞ্চল থেকে আসা, কৃষিই ছিল যাদের জীবন।
ফুলনাহার বলেন, 'অধিকাংশ পরিবার একসাথ হয়ে তাদের জমিতে চাষ করে, এখানে কারো গুরুত্ব কম নয়। এটা একটা দলীয় প্রচেষ্টা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা কৃষি-কৌশল ধরে রাখতে সবাই আগ্রহী।'
ব্রিটেনে স্থানীয় অনেক সুপারস্টোরে গেলেই দেখা মিলবে নানা বাংলাদেশি শাকসবজির। এখানকার ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা নিজেরাই এসব উৎপাদন করেন।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের জন্য বাগান কেবল একটা শখ নয়, এটি তাদের শেকড়ের সাথে এবং বৃহত্তর সম্প্রদায়ের সাথে মেলবন্ধনে থাকার একটি উপায়। এছাড়া তাদের মাঝে উৎপাদিত শাকসবজি ভাগাভাগি করা একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকের কাছে সুলভ মূল্যে সবজি পাওয়া, সহজতর উপায়ে টাটকা খাবার পাওয়ার জন্য নিজেদেরই এগুলো চাষ করা সুবিধাজনক। বিশেষ করে করোনা মহামারি উদ্ভূত লকডাউনের সময় সুপারমার্কেটের পণ্য দ্রুত শেষ হয়ে যেত, তখন এ পন্থা খরচ বাঁচানোর পাশাপাশি যোগানের বিচারেও কার্যকর ছিল।
আমার মা তার বাগানে ঝুলন্ত ঝুড়ি এবং টেরাকোটার পাত্রে করে ধনেপাতা, পুদিনা থেকে শুরু করে রোজমেরি, মেথি ইত্যাদি হার্ব জন্মান; এগুলো সুপরিচিত ঘ্রাণের পাশাপাশি একটা বিদেশি বিদেশি ঘ্রাণও দেয়। এবছর তিনি বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, গাজর, মূলা, পার্সনিপ, লাল আমারান্থ, মটরশুঁটি মরিচ কত কিছুর গাছ লাগিয়েছেন! লাউ তার সবচেয়ে প্রিয় সবজি। মাচায় ঝুলতে থাকা নানা আকারের ঝুলন্ত লাউগুলো দেখিয়ে আদরমাখা গলায় মা বলেন, 'এই লাউ আমার কাছে সন্তানসম।'
কেবল মা-ই যে লাউ পছন্দ করেন তা নয়, ব্রিটিশদের জন্যেই লাউ পরম উপাদেয়, যদিও বাংলাদেশিদের কাছে একটু বেশিই বধয় জনপ্রিয়।
এই সবুজ সবজিটির আকার আকৃতি নির্ভর করে কীভাবে চাষ করা হবে আর সংগ্রহ করা হবে তার ওপর। লাউয়ের খোসা ছাড়ালেই দেখা যায় নরম সাদা অংশ; স্বাদে কিছুটা মিষ্টি এই সাদা অংশটি কিউব করে কেটে মাছ কিংবা মাছের সাথে মিশিয়ে রান্না করলেই হবে মুরগি লাউ বা মুরগি তরকারি। মুরব্বা বানাতেও লাউয়ের ব্যবহার সমাদৃত।
শখের বাগান লিখে ইউটিউবে সার্চ করলেই পর্দায় চলে আসে শত শত ভিডিও, যেগুলোতে বাংলাদেশিরা তাদের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে, বাগান করার বা সবজি উৎপাদন করার নানা পরামর্শ, টিপস দিচ্ছেন। এমন একটি চ্যানেল হলো বাগান আর বাগান। ৫০ বছর বয়সী আজাদ আলী এ চ্যানেলের মালিক। বাগানে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার জন্যে খণ্ডকালীন চাকরি বেছে নিয়েছেন।
উত্তর লন্ডনে বেড়ে উঠেছিলেন আলি, তাদের বাসায় ছিল ছোট্ট একটি ব্যালকনি। সেখানেও লাগাতেন নানা গাছ। এরপর আরও শান্ত, আরও সবুজাভ পরিবেশের খোঁজে ছয় বছর আগে বেডফোর্ডশায়ারে বদলি হন। সেখানেই এখন স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ থাকেন।
ছোটবেলায় ছোট পরিসরের ব্যালকনিতে পারেননি, এখানেই এসেই তার স্বপ্নের বাগান গরা শুরু করে দেন। এখন তার সে বাগান যেন আনারস, আম, কলা, কিউই, পেঁপে, বাতাবিলেবু, সাতকরা ইত্যাদি নানা ফলের স্বর্গরাজ্য! সুদীর্ঘ তালগাছ, বাঁশ আর এগুলোকে ঘিরে থাকা লতাপাতার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হবে যেন কোন জঙ্গলে আছি।
আলীর সবচেয়ে প্রিয় হলো বাংলাদেশের জাতিয় ফল কাঁঠাল। কিন্তু ব্রিটেনের জলবায়ুতে এই সুমিষ্ট ফল উৎপাদন করা প্রায় অসম্ভব বলে জানান তিনি। কিন্তু গ্রীষ্মের খরা কিংবা আকস্মিক বন্যা আলিকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি; এক বাড়ন্ত কলাগাছের পাশে ছোট কাঁঠাল গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে জানিয়ে দিলেন ব্রিটেনের বিরূপ জলয়ায়ুও তাদকে পছন্দের ফল উৎপাদনের চেষ্টাকে ব্যহত করতে পারেনি।
ব্রিটেনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনের জন্য বন্যাপ্রবণ বাংলাদেশে ব্যবহৃত জলবায়ুবান্ধব পদ্ধতিগুলো পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেন আলী; যেমন, সহচর উদ্ভিদ পদ্ধতি। বাংলাদেশে প্রচলিত ভাসমান ক্ষেতের মতো করে পুকুরে হাইড্রোপনিক সিস্টেম বানিয়ে সবজি উৎপাদনের চেষ্টাও করেছিলেন তিনি।
লকডাউনে এই বাগানই ছিল আলী ও তার ছেলেদের মেলবন্ধনের অন্যতম উপায়। তার সবচেয়ে ছোট ছেলে ইয়াকুবের বয়স মাত্র আট; এই বয়সেই বাগানের ছোট একটি অংশে সেও তার নিজের ফল ও সবজি চাষ শুরু করে দিয়েছে।
ছোটদের সারাক্ষণ ফোনের নেশায় বুঁদ হয়ে না থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে অনুপ্রাণিত করা খুবই গুরুত্বপুর্ণ বলে মনে করেন আলী।
ব্রিটেনের আরেক বাংলাদেশি মোহাম্মদ শাহ ইলিয়াস ওয়ালসাল টাউনে তার মালিকানাধীন একটি জায়গায় এক দশকের চেয়ে বেশি সময় ধরে নানা কিছু চাষ করছেন। ৬০ বছর বয়সী ইলিয়াস এখানে গাঁদা, সূর্যমুখী ফুল লাগিয়েছেন। ফুলের সুগন্ধ পছন্দ বলে টমেটো, শসা, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, শালগম, পালংশাকের সারির মাঝে মাঝেই লাগিয়েছেন জুঁই আর গোলাপ ফুলগাছ। এছাড়াও চাষ করেন আপেল, নাশপাতি, চেরি, গুজবেরি এবং বরই ইত্যাদি; আর নানা আকৃতির লাউ তো আছেই।
একটু সময়ে পেলেই এই শান্ত পরিবেশে পালিয়ে আসেন তিনি। 'এখানে দিনে একবার, মাঝে মাঝে দুইবার, কিংবা পারলে পুরো একটা দিন এখানে কাটাই!' হেসে জানালেন ইলিয়াস।
তিনি বলেন, 'এখান্তা অনেক শান্ত এবং নিরিবিলি। ভালোবাসি এমন একটা কাজ করতে আমার অনেক ভালো লাগে; মানসিক চাপ কমায়, আমার রক্তচাপ ঠিক থাকে। এক কথায় এর বলেই তো সচল আছি! নিজের কষ্টে ফলানো সবজি এবং ফল দেখলেই মন ভরে যায়।'
ছোট থাকতে বাবার থেকেই বাগান করা শেখা বলে জানালেন ইলিয়াস। অতিতের কথা স্মরণ করে বলেন, 'আমাদের গ্রামে নিজস্ব ফসল উৎপাদন না করা মানে কোনো খাবার না পাওয়া।'
শাকসবজির বাগান করা জীবনধারণের খরচ কমাতে ইলিয়াসের মতোই আরও অনেক ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের দারুণভাবে সাহায্য করছে। কোনো বছরে বাম্পার ফলন হওয়া মানে পরিবারপরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় এবং পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে ফসল ভাগাভাগি করা! বাগান করার আনন্দ এভাবেই যেন ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটেনের বাঙালীদের মাঝে। অনেকে আবার নিজের চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয় স্টোরগুলোতে এসব ফসল বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থও উপার্জন করেন।
ব্রিটিশ বাঙালি তরুণদের মাঝে বাগান বা চাষাবাদ করা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই যেমন, তার তরুণ ভ্রাতুষ্পুত্র মতিন আলী তার মতোই বাগান করছেন। পাশাপাশি ব্রিটিশ হর্টিকালচারে বৈচিত্র্য ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ডিগ ইট আউট। এছাড়াও মাই ফ্যামিলি গার্ডেন নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে তার, যেখানে হাজার হাজার ব্যবহারকারী তার নিয়মিত দর্শক।
বাংলাদেশি হিসেবে নিজের শেকড়কে ভুলে যাওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন ইলিয়াস। 'ফসল আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আমাদের পৃথিবী যে কত উদার। যতই তাকে দেবেন, তার চেয়ে বেশি ফিরিয়ে দেবে আমাদের এ বসুন্ধরা। এ কাজে কঠোর পরিশ্রম যেমন প্রয়োজন, তেমনি ধৈর্যও হতে হবে অফুরন্ত; কিন্তু দিনশেষে মনে হবে এ কাজ সার্থক।'