মোজাম্বিকে নির্বাচনের ফল ঘিরে বিক্ষোভ: রাতারাতি কোটি টাকার পণ্য লুটপাট, নিঃস্ব বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা
২০১৭ সালের জুনে উন্নত জীবনের আশায় দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে পাড়ি জমান চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নের বাসিন্দা ওবায়দুল হক চৌধুরী। এক বছর চাকরির পর নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। দেশটির রাজধানী মাপুতো সিটিতে জমি কিনে বড় গোডাউন সংবলিত চারটি দোকান নির্মাণ করেন। এর মধ্যে তিনটিতে দোকান নিজেই চালাতেন। কিন্তু গত ২৩ ডিসেম্বর দেশটিতে নির্বাচনি ফলাফল নির্ধারণে আদালয়ের রায় নিয়ে সহিংসতায় ওবায়দুলের দোকানপাট লুটপাট হয়ে গেছে।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) ওবায়দুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আদালতের রায় ঘোষণার পর সন্ধ্যা থেকেই কৃষ্ণাঙ্গ ডাকাতরা লুট শুরু করে। আমরা সবগুলো দোকানের মালামাল নিয়ে গেছে। দোকানের লোহার পাত দিয়ে তৈরি তাক ও বিদ্যুতের তার, টিন পর্যন্ত কেটে নিয়ে গেছে। প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার।'
শুধু ওবায়দুল নন, তার মতো আরও দুই শতাধিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর দোকানপাট, সুপারশপ, মিলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট হয়েছে। কোটিপতি ব্যবসায়ীরা রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
চলতি বছরের ৯ অক্টোবর মোজাম্বিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ অক্টোবর ফলাফলে সরকারি দলের প্রার্থী ফ্রেলিমো পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ড্যানিয়েল চ্যাপোকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই অস্থিরতা শুরু হয়।
এই ফলাফলের বিরুদ্ধে দেশটির সাংবিধানিক আদালতে আপিল করেন বিরোধীদলের নেতা ভেনানসিও মন্ডলেন। গত ২৩ ডিসেম্বর সাংবিধানিক আদালত ড্যানিয়েল চ্যাপোর বিজয়ীয় ঘোষণা করেন। তখন বিরোধীদলের নেতা ভেনানসিও মন্ডলেন নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে অভ্যুত্থানের হুমকি দেন।
আদালত চ্যাপোর জয়কে বৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়ার পরই মোজাম্বিকজুড়ে নতুন করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই বাংলাদেশিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নজিরবিহীন লুটপাট শুরু হয়েছে। রাজধানী মাপুতো, সিমুই, বেইরা, নামপুলা, মুনফোলা, নাখালা, জাম্বিজিয়া, ইলিমান, বেয়ারাও মকুবাসহ বহু শহরে লুটপাট শুরু হয়।
মোজাম্বিকে বাংলাদেশি কমিউনিটির তথ্যমতে, ২০০০ সালের পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশিরা যেতে শুরু করেন। দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে ভারতীয় ও চীনাদের পাশাপাশি বাংলাদেশিরাও গত এক দশক ধরে অবদার রাখছেন।
বর্তমানে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি রয়েছে মোজাম্বিকে। তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের। গত কয়েকদিনের সহিংসতায় প্রায় তিন শতাধিক দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট হয়েছে।
২০১৬ সালে মোজাম্বিকে পাড়ি জমানো চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াছিন মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতো সিটির মাতুলা শিল্প এলাকায় সুপারশপ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি পাইকারিতে মাছ-মাংস বিক্রির গ্রোসারি শপ ছিল।
ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে কাঁদতে কাঁদতে ইয়াছিন টিবিএসকে বলেন, 'সবকছিু লুট করে নিয়ে গেছে। দোকানের লোহার তাক, বৈদ্যুতিক তার, এমনকি ফ্রিজের মটরগুলোও নিয়ে গেছে।'
বাংলাদেশ কমিউনিটি মোজাম্বিকের আহ্বায়ক আনিছুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি এখানে বসবাস করেন। গত ২৩ ডিসেম্বর বিকাল থেকে রাজধানী মাপুতো থেকে লুটপাট শুরু হয়। ২০-৩০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ দুর্বৃত্ত এসে একসঙ্গে আক্রমণ করছে। পুলিশ কিছুই করতে পারেনি। সেনাবাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করছে। উল্টো লুটপাটকারীদের সহযোগিতা করছে। সেনাবাহিনী হয়তো বিরোধীদলকে সাপোর্ট করছে। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। বাংলাদেশ হাইকমিশনকে নিয়মিত পরিস্থিতি জানাচ্ছি।'
ঘরে ঘরে হামলা, জীবন বাঁচাতে আর্তনাদ বাংলাদেশিদের
শুধু দোকানপাট বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়, ঘরে ঘরে হামলা ও লুটপাট করছে দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বাংলাদেশিরা। দেশটিতে অনেক বাংলাদেশি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তারা এখন দেশে ফেরার জন্য আর্তনাদ করছেন।
মোজাম্বিকপ্রবাসী কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাসিন্দা মুজিবুল করিম টিবিএসকে বলেন, 'সব লুটপাট হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। ডাকাতরা ঘরে ঘরে হামলা করছে। আমি আবাসিক এলাকায় থাকি। সেখানে নিরাপত্তা রয়েছে, এরপরও পর্যাপ্ত নয়। তাই রাতে নিজেরাই পাহারা দিচ্ছি। দিনের বেলায় ঘুমাই। দেশে ফেরার মতো পরিস্থিতি হলেই দেশে ফিরব।'
প্রবাসী ইয়াছিন বলেন, 'আমার তিন সন্তানরা এখানে পড়ালেখা করে। পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। দেড় হাজার ডাকাতকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে ঘরে ঘরে ডাকাতরা হামলা করছে। ঘরের খাট-পালঙ্ক, কাপড়-চোপড় পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেরা রাতে পাহারা দিচ্ছি। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া যাচ্ছে না। পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধ। অনেকগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কদিন পর গাড়িও চলবে না।'
বাংলাদেশ কমিউনিটির আহ্বায়ক আনিছুর বলেন, 'এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া যাচ্ছে না। আমরা টাকা-পয়সা, ডিজেলের খরচ দিয়েছি স্থানীয় পুলিশকে। এরপরও প্রতিহত করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেছি। সঙ্গে পাকিস্তানি, সোমালিয়ান, ভারতীয়দের নিয়ে নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কমিউনিটির লোকজন নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরে, হাতে ধারালো দা ও লাঠি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।'
পর্তুগালের লিসবনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর ও চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স লায়লা মুনতাজেরী দীনা টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। আর তাদের একটি তালিকা করতে বলেছি কতজন পুরুষ, নারী ও শিশু আছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলে দেশটির সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'