একটি মাছ ৮ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন যিনি, সেই ‘পোপা গনি’র চিন-পরিচয়
সাত বছর বয়স থেকে গনি সাগরে যায়। সেটা ২১ বছর আগের কথা। তখন সেন্ট মার্টিনে একটি ডাব বিক্রি হতো ৭-৮ টাকায়। গনির বাবা সোলতান আহমদের একটি ছোট্ট ট্রলার ছিল। সেটাই ছিল গনিদের পুরো পরিবারের সম্বল।
গনিরা চার ভাই চার বোন। গনি তিন নম্বর। মাছ ধরাই ছিল তাদের জীবিকার বড় উপায়। আর সেসঙ্গে গনি সাগরপাড়ে কড়ি কুড়াত। হাতগুটি খেলার ছোট কড়ির সঙ্গে বড় কড়িও মিলত তীরে। ত্রিশ টাকায় ১০০ কড়ি বিক্রি হতো।
গনির স্কুলে যাওয়ার সুযোগ বেশি হয়নি। ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছেন। সংসারে টানাটানি ছিল, বাবা অসুস্থ থাকতেন বেশিরভাগ সময়।
সেটা এমন এক সময় ছিল, যখন সারাদিন কষ্ট করেও খাওয়ার টাকা রোজগার করা যেত না। পর্যটকও বেশি আসত না সেন্ট মার্টিনে। হুমায়ুন আহমেদের সমুদ্র বিলাসের কথা জানত যারা, তারাই বেশি আসত।
গনি বলছিলেন, 'এখন এই শেখ হাসিনার আমলে দেখতেছি টাকার বেশ আমদানি। কষ্ট করলে কেস্ট মেলে।'
প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের পশ্চিম পাড়ায় গনিদের বাস। চার দফায় পাঁচটি পোপা মাছ পেয়ে গনি তারকা খ্যাতি পেয়েছেন, হয়েছেন লাখপতি।
১৩ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর গনির ভাইবোনেরা পরামর্শ করে নিজেদের একটা জমি বিক্রি করলেন। ভাইয়েরা ২৮ হাজার করে টাকা পেলেন। গনি সেই টাকার সঙ্গে আরো কিছু টাকা ধার করে বাবার ছোট্ট ট্রলারটিকে সারিয়ে তুললেন, সেসঙ্গে আরো একটু মজবুত করলেন।
এবার প্রয়োজন একটি জাল যা বড় মাছ ধরার উপযুক্ত। গনি টেকনাফ থেকে একটি সেকেন্ডহ্যান্ড জাল কিনে আনলেন। তাতেও নানা রকম সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজ আর তালি দিতে হলো। তারপর নিজের ট্রলারে নিজের মাছ ধরা শুরু গনির।
তবে পোপা ধরে বিখ্যাত পোপা গনির গল্প আসলে শুরু হয় ২০১৮ সালে। সে বছর তিনি বিয়ে করেন, মেয়ের বাড়ি টেকনাফের সাবরাংয়ে।
ওই বছরেরই নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তার জালে একটি বিশাল পোপা মাছ ধরা পড়ে। মাছটির ওজন ৩৫ কেজি। মাছটি খুব চেনা নয়, কারণ বেশি ধরা পড়ে না।
প্রবীণ জেলেদের কাছ থেকে গনি জানতে পারেন, এটি খুব দামি মাছ। কারণ এর বায়ুথলি (ব্লাডার) বা পটকার চাহিদা অনেক বিদেশে।
গনি তাই মাছটি টেকনাফেও নয়, কক্সবাজারে নিয়ে যান। মাছটির দাম তিনি পেয়েছিলেন ৮ লক্ষ টাকা। নিজেও হতবাক হয়েছিলেন এত দাম পেয়ে।
পরের বছর, মানে ২০১৯ সালে আর পোপা পাননি একটিও। তবে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসেই আরেকটি পোপা তার জালে আটকা পড়ে। সেটির ওজন হয়েছিল ২৮ কেজি আর বিক্রি হয়েছিল ৫ লাখ টাকায়।
গনির জাল বড় মাছের জাল। তিনি বলছিলেন, '৫ কেজির কম ওজনের মাছ আমার জালে আটকায় না। তবে আমি এক মণ, মানে ৪০ কেজি বা তার বেশি ওজনের মাছ এখনো পাইনি।
'অনেক কোরাল ধরা পড়ে আমার জালে—৭ কেজি, ১০ কেজি, ১৫ কেজি ওজন হয়। ঢাকা বা চট্টগ্রামের বাজারে যদি বড় কোনো কোরাল দেখতে পান তবে ভাবতে পারেন সেটি আমার জালেই ধরা পড়ে থাকবে।
'আমার ট্রলারের জাল আমি নিজেই তৈরি করি। ১,৫০০ ফুট দীর্ঘ আর ৭০ ফুট প্রস্থের জাল আমার। বিকাল ৪টা-৫টায় জালের দুই পাশে দুটি বড় বড় নোঙর বাঁধিয়ে ফ্লুট দিয়ে ভাসিয়ে রেখে আসি সাগরে। সন্ধ্যার পর গিয়ে তুলি, কখনো কখনো রাত গভীর হওয়ার পর।'
কখন মাছ ভালো ধরা পড়ে জানতে চাইলে আব্দুল গনি বলেন, বাতাস কম থাকলে, মানে সাগরে ঢেউ কম থাকলে মাছ পড়ে ভালো। দিনের বেলায় মাছ ভালো ধরা পড়ে না, রাত ১০টা-১১টায়ও মাছ পাই না ভালো।
প্রশ্ন: শুনেছি পোপা মাছ বড়শি ও নকল মাছ (প্লাস্টিকের তৈরি) দিয়ে ধরতে হয়?
গনি: না, এটা সত্যি না। নকল মাছ দিয়ে আমি কখনো পোপা ধরিনি।
প্রশ্ন: পোপা মাছ কী খায়?
গনি: ছোট মাছ খায়।
প্রশ্ন: মাছটি খেতে কেমন?
গনি: খেতে তেমন সুস্বাদু না। এটার দাম বাড়ে এর পটকার জন্যই। বড় বড় পোপায় ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম পটকাও থাকে। তবে স্ত্রী পোপার পটকা বড় হয় না, তাই দাম বেশি হয় না।
লাকি নভেম্বর
এই বছর, মানে ২০২২ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখে আব্দুল গনির জালে আরো ২টি পোপা ধরা পড়ে। একটির ওজন ২৫ কেজি, অন্যটির ৩০ কেজির বেশি। কিন্তু দুটি মাছই ছিল স্ত্রী পোপা। তাই দাম পেয়েছেন কম। দুটি মিলিয়ে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। শেষে গেল ১৯ তারিখে পেয়েছেন ২৩ কেজি ওজনের আরো একটি পোপা মাছ। স্ত্রী পোপা বলে দাম পেয়েছেন ৮৫ হাজার টাকা।
আব্দুল গনি বলেন, 'পরপর ৫টি পোপা মাছ পেয়ে আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। বসতঘরের উন্নতি হয়েছে। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে, নাম সাইফুল ইসলাম; আর মেয়েটির নাম সায়েবা নূর।
'এখন আমার ২টি ট্রলার—এফবি মায়ের দোয়া ১ ও ২। সাতজন করে একেকটি ট্রলারে কাজ করে। তাদের একেকজনের মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা।
'তবে আমার ব্যাংক একাউন্টে আপনি এক লাখ টাকাও পাবেন না। আমি সবাইকে নিয়ে চলি। ভাই-বোন তো বটেই, পাড়া-প্রতিবেশীকেও সাহায্য-সহযোগিতা করি। সেন্ট মার্টিনে জীবনধারণের খরচ অনেক বেশি। এক বস্তা চাউল এখানে ৩,২০০ টাকা।'
শহরে থাকতে পারেন না
একবার বাবা মারা যাওয়ার বছরখানেক পরে এক পর্যটক এসেছিলেন সেন্ট মার্টিনে। গনিদের বাড়িতে কয়েকদিন থেকেছিলেন। গনির সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল তার। তিনি ধানমন্ডির বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, ঢাকায় চলে এসো, কাজের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এসেছিলেন গনি ঢাকায়, থেকেওছিলেন ২০-২৫ দিন, কিন্তু সাগরের জন্য মন টানত। তাই শেষে বলেকয়ে চলে এসেছিলেন, ফিরেছিলেন সেন্ট মার্টিনে।
আর এখন তো কাজের চাপেই দূরে কোথাও যেতে পারেন না। বড়জোড় বছরে দু-চারবার শ্বশুরবাড়ি যান। তবে মাছ বিক্রি করতে মাঝেমধ্যে কক্সবাজার যেতে হয়। গনির ভালো লাগে যে, মানুষ তাকে ভালোবাসে।
দিন কয় আগে সেন্ট মার্টিনে জেটির ধারে সুরমা মাছ বিক্রি করতে বসেছিলেন। চার হাজার টাকা দাম উঠেছিল, গনি তবু ছাড়তে চাইছিলেন না—এই সময় আরেকজন ক্রেতা জোরে বলে ওঠে, গনি আমি আরো ৫শ টাকা বেশি দিব, দিয়ে দাও।
তখন এক পর্যটক এসে বলে, আপনি গনি ভাই? আপনার নাম অনেক শুনেছি। গনি খুশি হয়ে তাকে চা না খাইয়ে ছাড়েননি। মাছ অনেক ধরেন গনি, তবে বেশি খান না। পোল্ট্রি মুরগি তার ছেলেমেয়েরাও খেতে পছন্দ করে, বাসায় সেটাই রান্না হয় বেশি।
গনি অবশ্য জানেন না, পোপা কেন তার জালেই বেশি ধরা দেয়। তবে প্রতিবার জাল ফেলে তিনি পোপার আশাতেই বসে থাকেন। সাগরের ডিসির বান, নয় বান ইত্যাদি পয়েন্টেই তিনি জাল ফেলেন বেশি। কারণ আগের পোপা মাছগুলো এসব জায়গাতেই পেয়েছেন। এলাকায় তার নাম হয়ে গেছে পোপা গনি বলে। এ নাম পেয়ে খুশিও তিনি।
গনি আশা করেন, এ মাছ তাঁর জালে ফিরে ফিরেই আসবে।
পোপার দামের হেতু
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান জানান, পোপা মাছের পেটের ভেতরে থাকা পটকা বা বায়ুথলিটি অত্যন্ত মূল্যবান। এটি বিশেষ ধরনের সার্জিক্যাল সুতা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এ মাছের পটকা চীন, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
সাগরের উপকূলীয় নদীর মোহনায় এই মাছটি বেশি ধরা পড়ে। কক্সবাজারের পাশাপাশি খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট মোহনায়ও এ মাছ পাওয়া যায়। মাছটি কত বড় তার উপর নির্ভর করে এর মূল্য।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনিস্টিটিউটের মহাপরিচালক সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার জানান, মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম মিকটেরোপারকা বোনাসি (Mycteroperca bonaci)। একে স্থানীয়ভাবে 'কালা পোপা'ও বলা হয়।
পৃথিবীর আরো যত দামি মাছ
কিয়োশি কিমুরাকে লোকে বলে টুনা কিং। তিনি একজন সুশি শেফ, কিয়োমুরা করপোরেশনের প্রধান। প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি সুশি রেস্তোরাঁ পরিচালনা করে। ২০২০ সালে একটি বিশাল ব্লুফিন টুনা কিনে কিমুরা পত্রিকার শিরোনাম হন। ৬০০ পাউন্ড ওজনের টুনাটি তিনি কিনেছিলেন ১.৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে।
ড্রাগন ফিশ নামে পরিচিত এশিয়ান আরোয়ানা সংগ্রাহকদের কাছে মহার্ঘ্য। মৎস্য সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেখা যায় একে প্রায়ই। এই অ্যাকুরিয়াম ফিশটির দাম ১০ হাজার ডলারের নিচে নামে না। স্বাদু ও লবণ উভয় পানিতেই এটি বেঁচে থাকতে পারে।
আমাদের দেশেও পাফার ফিশের কিছু স্বজাতি আছে যাদেরকে পটকা বা টেপা মাছ বলে ডাকা হয়। এরা দেহের ভেতর জল ঢুকিয়ে বেলুনের মতো ফুলে উঠতে পারে বলে 'বেলুন মাছ' তকমা পেয়েছে। পাফার ফিশদের ঠিকমতো সামলাতে না পারলে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, আর মাছটি বিষও ধরে। তাই বিষ-টিষ ছাড়িয়ে খাবার হিসাবে যখন পরিবেশন করা হয় তখন দাম বাড়ে চড়চড় করে। রেস্তোরাঁয় এর ছোট্ট কিছু অংশের দাম ধরা হয় প্রায় ৪০০ ডলার।
স্যামনকে বলা হয় রাজা মাছ। খাদ্য হিসাবে দারুণ জনপ্রিয় এ মাছ। এটি ব্যয়বহুল হওয়ার পেছনের কয়েকটি কারণ হলো—প্রকৃতিতে এটি ধরা বেশ কষ্টকর, এটি যথেষ্ট পুষ্টিকর, এর চাহিদা দিনে দিনেই বাড়ছে, এবং স্যামনের বিকল্প কেবল স্যামন।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, সেলেনিয়াম ও ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ সোর্ড ফিশের চাহিদা অনেক। গবেষণায় পাওয়া গেছে, সোর্ড ফিশ হার্ট ও হাড় ভালো রাখতে দারুণ কার্যকর। তাই এক পাউন্ড সোর্ড ফিশের দাম পঞ্চাশ পাউন্ডের বেশি হয়ে থাকে।