জোবাইকের কী হলো?
বর্তমানে শহরে মোটর বাইক কিংবা প্রাইভেট কারের মতো যানবাহন ব্যবহারের আধিক্য থাকলেও বাইসাইকেল একেবারে হারিয়ে যায়নি। বরং স্বল্প দূরত্বে সহজে চলাচল বিবেচনায় বাইসাইকেল আজও অনেকের পছন্দের বাহন।
সাইকেল একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব, অন্যদিকে এর ব্যবহারে খরচও অনেক কম। আর এ দুটি বিষয়কে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের আইডিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে তানভীর আলী, ফাহিম সালেহ ও শামিম আহসান নামের তিন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ২০১৮ সালে 'জোবাইক সার্ভিস' নামের একটি ভিন্নধর্মী স্টার্টআপ শুরু করেছিলেন।
জোবাইক সার্ভিসের অধীনে একজন ব্যবহারকারীকে মোবাইলে জোবাইক অ্যাপস নামিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। পরবর্তীতে আইডিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ রিচার্জ করে ইচ্ছামতো সময় অনুযায়ী একটি বাইসাইকেল চালাতে পারেন।
প্রথমদিকে উদ্যোক্তারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো টার্গেট করেন। ক্রমান্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জোবাইক সার্ভিস চালু হয়।
উদ্যোগটি ভিন্নধর্মী হওয়ায় প্রথমদিকে সামান্য জটিলতা দেখা গেলেও ধীরে ধীরে অ্যাপটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে। এর ব্যবহারও বাড়তে থাকে।
কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন করোনা মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘসময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় জোবাইক বড় আকারের লোকসানে পড়ে। সম্প্রতি কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেদী রেজা কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে, জানিয়েছেন কোম্পানিটির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে।
২০২০ সালে করোনার শুরুতে জনসাধারণ যখন গণপরিবহনে চলাচল করতে নিরাপদ বোধ করছিল না তখন জোবাইকের কর্মকর্তারা ভেবেছিল স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে জোবাইকের ব্যবহার বাড়বে। তাই কোম্পানিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ঢাকার গুলশান ও মিরপুর ডিওএইচএস-এ ১০০টি বাইসাইকেল নিয়ে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করে।
ওই সময় পাঁচ মাসের মধ্য কোম্পানিটি প্রায় ৩৫ হাজার নিবন্ধিত গ্রাহকও পেয়ে যায়। এছাড়াও সেই সময়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাহক জোবাইক ব্যবহার করতে থাকে। কিন্তু ততদিনে দুই বছর আগে যাত্রা শুরু করা কোম্পানিটির বাইসাইকেলগুলো পুরনো হয়ে যায়। নতুন বাইসাইকেল কিনতে প্রয়োজন পড়ে বিপুল অর্থের।
ওই সময়ে নতুন অর্থের জোগান সম্পর্কে কোম্পানির সিইও মেহেদী বলেন, 'করোনাকালীন সময়ে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ তখন সবকিছুই অনেক বেশি অনিশ্চিত ছিল। তবুও আমরা সেই সময় বিনিয়োগের জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলি। এমনকি কিছু টার্মশিটও স্বাক্ষর করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা বিনিয়োগ আনতে ব্যর্থ হই।'
করোনাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসগুলো শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে যাওয়ার পরে জোবাইক সার্ভিস টিকে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কোম্পানিটির সিইও মেহেদী বলেন, 'করোনাকালে আমরা সাইকেলগুলো ব্যবহার করে খাবার, ঔষধ ও ই-কমার্স প্রোডাক্ট ডেলিভারির কাজ শুরু করেছিলাম। নিজেদের যেহেতু বাইসাইকেল ছিল, তাই আমরা ডেলিভারি ব্যবসায় যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। আমাদের হয়ে অন্য কোম্পানির পণ্য ডেলিভারি করার জন্য বেশ কিছু রাইডারও নিয়োগ দিয়েছিলাম।'
কিন্তু করোনাকাকে জোবাইক ডেলিভারি ব্যবসায়ও সুবিধা করতে পারেনি। কারণ ততদিনে বাজারে বেশ কিছু ডেলিভারি কোম্পানি শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিল। এছাড়া পান্ডামার্ট, ফুডপান্ডা, হাংরিনাকির মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডেলিভারি ব্যবস্থাও ছিল। তাই জোবাইকের নিজস্ব সাইকেল থাকলেও অন্য কোম্পানির সঙ্গে মূলধন ও এরিয়া বিবেচনায় তারা প্রতিযোগিতা করতে পারেনি।
করোনার পর ক্যাম্পাস যখন আবারও চালু হয় তখন দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বাইসাইকেলগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। এছাড়া বাইসাইকেলের লকার ও জিপিএস সিস্টেমও নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে কোম্পানি হিসেবে জোবাইক তাদের প্রচারণাগুলো আকর্ষণীয় উপায়ে জনগণের কাছে তুলে ধরতে না পারায় পরবর্তীতে মানুষ আর আগ্রহ দেখায় নি।
অনেক বিনিয়োগকারী বাইসাইকেল শেয়ারিং বিষয়টির জন্য বাংলাদেশ এখনো প্রস্তুত নয় বলেও মন্তব্য করেছেন। তবে এ বিষয়টির সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন জোবাইকের সিইও। মেহেদী রেজা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দেশে স্টার্টআপে যারা বিনিয়োগ করে তারা ম্যাচিউর নন। তারা শুধু সফটওয়্যারনির্ভর ইনিশিয়েটিভে বিনিয়োগ করতে চান। হার্ডওয়ারনির্ভর ইনিশিয়েটিভে বিনিয়োগ করতে চায় না। কারণ হার্ডওয়্যারনির্ভর ইনিশিয়েটিভে বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। অন্যদিকে সফটওয়্যারনির্ভর ইনিশিয়েটিভে শুধু সফটওয়্যারের পেছনে অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ করলেই চলে।'
মেহেদী বলেন, অনেকেই ভাবতে পারেন, তাদের ব্যবসার মূল পুঁজি বাইসাইকেল চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের মাত্র নয়টি বাইসাইকেল চুরি গেছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া তিনি আরও বলেন, 'জোবাইক ইনিশিয়েটিভে অ্যাপসের পাশাপাশি বাইসাইকেলও কিনতে হয় এবং সেগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কোম্পানিকেই নিতে হয়। কিন্তু অন্য রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে যানবাহন কোম্পানির নিজের থাকে না। ফলে সেসব কোম্পানি শুধু অ্যাপসের মাধ্যমেই মুনাফা অর্জন করে। যানবাহন কিংবা চালকের বিষয়ে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।
জোবাইকের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সিইও মেহেদী রেজা জানান, জো-বাইকের কার্যক্রম বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। করোনাকালীন সময়ের পর তারা বেশ কয়েকবার কোম্পানির কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করলেও প্রচেষ্টাগুলো আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়াও স্টার্টআপটি নতুন কোনো বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে জো-বাইক আর কখনই চালু হবে না, এমনটা মানতে নারাজ কোম্পানিটির সিইও।
জোবাইক ফের বাজারে প্রবেশের জন্য নিজেদেরকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে শুধু পায়েচালিত বাইসাইকেল নয়, বরং মোটরচালিত বাইসাইকেলও যুক্ত করারও পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। সবশেষে কোম্পানিটির সিইও বলেন, 'ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই কোম্পানি হিসেবে জোবাইকের যাত্রা থেমে যাবে না। তবে মার্কেটে ফিরে আসার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সময় লাগবে।'