নাসির আহমেদ: বন্দুক বিক্রেতাদের শেষ প্রজন্ম
১৯৫২ সাল। ১৪ বছর বয়সী নাসির তখন ঢাকা'র আর্মানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়তেন।
কোনো এক ছুটির মৌসুমে গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় থাকার সময় একদিন কিশোর নাসির দোনলা একটা বন্দুক কাঁধে বলেশ্বর নদীর চরে শিকারে বেড়িয়ে পড়লেন। সঙ্গে ছিল তার চাচাতো ভাই।
'ওই চরে অনেকগুলো পাতি চ্যাগা পাখি বসেছিল। আমি বন্দুকের ঘোড়া চাপলাম। আমার প্রথম গুলিতেই আটটা পাখি মারা পড়ল,' বলেন নাসির।
পল্টনে একটি বন্দুকের দোকান পরিচালনা করেন ৮৪ বছর বয়সী নাসির আহমেদ। তার দোকানের নাম 'শিকার ও শিকারী'।
ওই বয়সেও নাসিরের কাছে বন্দুক অপরিচিত কোনো বস্তু ছিল না। তার দাদা মইজ উদ্দিন আহমেদ ও বাবা নুজুম উদ্দিন আহমেদেরও বন্দুক ছিল। তারাও নিয়মিত শিকারে যেতেন। নাসিরের চাচারা ও শ্যালিকাও শিকার পছন্দ করতেন। শিকারের যাত্রায় বাপ ও চাচাদের সঙ্গে নিয়মিতই ঝুলে পড়তেন নাসিরও।
'ওই সময়ে আমার বাবা ১০ টাকা ফিয়ের বদলে মাসে দুইবার সুন্দরবনে শিকার করতে যেতেন,' নাসির বলেন। স্ত্রী হরিণ বাদে তার বাবার মাসে চারটা পর্যন্ত হরিণ শিকার করার অনুমতি ছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অ্যাগেইনস্ট টিউবারকালোসিস-এ কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতেন নাসির আহমেদ। কিন্তু বন্দুকের প্রতি ভালোবাসার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৮০ সালে ঢাকায় একটি বন্দুকের দোকান দিয়ে বসেন।
'দোকানটা দিয়েছিলাম বিভিন্ন ধরনের বন্দুক দেখতে ও নতুন নতুন মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে। আমার খরিদ্দারেরা সবাই খুবই সমঝদার গোছের লোক,' তিনি বলেন।
অতীতে যেহেতু শিকারের ওপর কোনো নিয়মকানুন ছিল না, তাই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বন্দুকের ব্যবসায় ভালোই চলত। তখন যে কেউ বন্দুক কিনতে বা সংগ্রহে রাখতে পারতেন।
তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর সরকার বেসরকারিভাবে বন্দুক ও কার্তুজ আমদানি নিষিদ্ধ করে। সরকারি সিদ্ধান্তের পর দেশে সেকেন্ড-হ্যান্ড বন্দুকের বাজার সৃষ্টি হয়।
এরপর বাংলাদেশ আর্মস ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বর্তমানে বাংলাদেশ আর্মস ডিলারস অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংস্থাটি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর মাধ্যমে বন্দুক আমদানির ব্যবস্থা করে। টিসিবি বন্দুক আমদানি করে ডিলারদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করে।
'কোনো গ্রামে সবার বন্দুক রাখার অনুমতি ছিল না। যাদের ছিল, তারা সবাই গণ্যমান্য মানুষ ছিলেন। অন্যরা তাদেরকে শিকারে সাহায্য করতেন। অতীতে শিকার ছিল ক্ষমতা ও সম্মানের প্রতীক,' নাসির বলেন।
এরপর থেকে অবশ্য সরকার বন্দুক সংগ্রহ করার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন জারি করেছে।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ চালু করার পর দেশের বাজারে আগ্নেয়াস্ত্রের বিক্রি আরও পড়ে যায়। ২০১৬ সালে সরকার আগ্রেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে ১৫ লাখ টাকার আয়কর শর্ত যুক্ত করার পর বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিক্রয় আরও কমে যায়।
'টাকা থাকলেও যদি লাইসেন্স না থাকে, তাহলে আপনি বন্দুক কিনতে পারবেন না। সরকার জনগণকে বন্দুক ক্রয়ে নিরুৎসাহিত করছে। এর ফলে বিপদে পড়েছি আমরা,' বলেন নাসির।
'নির্বাচনে আগে বন্দুকের মালিকদের তাদের বন্দুক জমা দিতে হয়। তাদেরকে উচ্চহারে কর দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেয়। শিকার নিষিদ্ধ। লাইসেন্স নবায়ন করার ফি বাড়ানো হয়েছে। এসবের কারণে অনেক বন্দুক মালিক তাদের অস্ত্র সমর্পণ করেছেন,' জানান নাসির আহমেদ।
তবে ধনী ও বনেদি লোকেরা এখনো বন্দুক কেনেন। অতীতে ক্রেতারা দোনলা বা একনলা বন্দুকের মতো কনভেনশনাল অস্ত্র কিনতেন। বর্তমানে তারা নিরাপত্তার জন্য শটগান কেনেন।
আগে রিভলভারের জনপ্রিয়তা ছিল। হাল আমলে এসে মানুষ পিস্তলের দিকে ঝুঁকেছে। কারণ পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার পর খোসাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হয়ে যায়। আর রিভলভারের চেয়ে পিস্তল তুলনামূলকভাবে হালকা।
নাসির জানান, পিস্তলের ক্যালিবার (ইঞ্চি হিসেবে ব্যারেলের ব্যাস) .২২, .২৫, .৩২, ও .৩৮ হতে পারে। .৩২ ক্যালিবারের পিস্তল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। .৩৮ ক্যালিবারের পিস্তল কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ আর্মস ডিলারস অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নাসির আহমেদ। তিনি জানান, প্রতি মাসে বা বছরে কতগুলো বন্দুক বিক্রি হয় তা নিয়ে তার ধারণা নেই। দেশের বৈধ অস্ত্রের বাজারের ব্যাপ্তি নিয়েও তার জানা নেই।
তবে পুলিশের ২০২১ সালের উপাত্ত অনুযায়ী, দেশে ৪৪,০০০ বৈধ বন্দুক রয়েছে।
নাসির বিশ্বাস করেন, সময় এসেছে অস্ত্র ব্যবসায় গুটিয়ে ফেলার। এখন আর বিক্রিবাট্টা বলে কিছু নেই।
'শিকার নিষিদ্ধ, তাই গোলাবারুদ বিক্রি করতে পারবেন না। বন্দুক নিয়ে বের হওয়া যায় না। আপনি বন্দুক রেখে করবেনটা কী?' তিনি বলেন।
বর্তমানে কিছু বন্দুক যুক্তরাষ্ট্র, চেকোস্লোভাকিয়া, স্পেন ও ফ্রান্স থেকে আমদানি করা হয়। তবে তুলনামূলক সস্তা বলে বেশিরভাগ আমদানি হয় তুরস্ক থেকে।
নাসিরের দোকানে থাকা সবচেয়ে দামি পিস্তলগুলোর একটি হচ্ছে জার্মান মাউজার। এটির দাম প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো। ইতালিয়ান বেরেটা ও চেকোস্লোভাকিয়ার সিজেড পিস্তলগুলোও বেশ দামি। তুরস্কের তিসাস পিস্তলগুলোর দাম পড়ে ১,১৫,০০০-এর মতো।
বাংলাদেশে এখন আট আমদানিকারক ও ৮৪টি বন্দুকের দোকান রয়েছে। নাসির জানান, যারা আমদানি করছেন, তারা লাভ করতে পারছেন। ডিলারদের বন্দুকের ব্যবসায় থেকে কোনো লাভ হচ্ছে না।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে নাসির দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে তিনটি পিস্তল বিক্রি করেছেন। 'এ ব্যবসায় টিকে থাকবে না। অদূর ভবিষ্যতেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে,' তিনি বলেন।