যেভাবে দেখা মিলল বর্ষার দুর্লভ বনবিড়ালের, প্রাণে বাঁচল দুই ছানা
সময়টা ২৪ জুলাই ২০০৮। সকালে ঘুম ভাঙল প্রতিবেশী চিকিৎসক আমজাদ কাজীর ডাকে। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতেই দেখি কাজী সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল এক কিশোর, হাতে চটের ব্যাগ। কিশোরটি আমার দিকে এগিয়ে এসে চটের ব্যাগটি মেলে ধরল। অবাক হয়ে দেখলাম ভেতরে জড়াজড়ি করে বসে আছে দুটি বনবিড়ালের বাচ্চা। আমি ওদের গায়ে হাত রাখলাম। কী নরম তুলতুলে টুকটুকে বাচ্চা! খুব বেশি হলে এদের বয়স দুই সপ্তাহের কিছুটা বেশি।
ছেলেটার কাছ থেকে জানতে পারলাম সুলতানপুর স্কুলের পার্শ্ববর্তী গোরস্থান থেকে সে বাচ্চা দুটি সংগ্রহ করেছে। খুব ভোরে বনবিড়ালের অবস্থান টের পেয়ে আশপাশের লোকজন গোরস্থানের নির্দিষ্ট একটি জায়গা ঘিরে ফেলে। জায়গাটাতে গ্রিলের বেষ্টনী দেওয়া পাশাপাশি তিনটি কবর রয়েছে। বনবিড়ালটি আক্রান্ত হওয়ার পর লম্বা লাফ দিয়ে বেষ্টনী ভেদ করে পালিয়ে যায়। ক্ষুধার তাড়নায় বনবিড়ালেরা মাঝেমধ্যে পোষা হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে যায়। এজন্য এখনো গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তাদের শত্রুজ্ঞান করে থাকে। বনবিড়ালটি পালিয়ে যাওয়ার পর দুটি বাচ্চা লোকজনের চোখে পড়ে। সবাই বাচ্চা দুটিকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। ছেলেটি তখন অনেক চেষ্টা করে বনবিড়ালের বাচ্চা দুটির জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়। তারপর ছুটে আসে এখানে।
ঘুম-জড়ানো অবস্থায় ঠিক মন দিয়ে কথা বলতে পারলাম না ছেলেটির সঙ্গে, তার মধ্যেও কেমন যেন এক উজ্জ্বল অস্থিরতা ছিল। চটের ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে সে হাসতে হাসতে এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। কাজী সাহেব বিদায় নিয়ে রওনা দিলেন চেম্বারের উদ্দেশে। বাচ্চা দুটিকে ব্যাগ থেকে বের করে সযত্নে রেখে দিলাম কাঠের আলমারির নিচের তাঁকে।
বনবিড়াল সাধারণত বছরে দুবার বাচ্চা প্রসব করে, শীতে আর বর্ষায়। এরা সর্বোচ্চ পাঁচটি পর্যন্ত বাচ্চা দিয়ে থাকে। বর্ষার সময় জন্ম নেওয়া বাচ্চাগুলো টেকে কম। অতিবৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অধিকাংশ বাচ্চার মৃত্যু ঘটে। তবে মানুষের হাতে বনবিড়ালের বাচ্চার মৃত্যুর হার শীত, বর্ষা উভয় ঋতুতেই সমান। শীতের বাচ্চা বহুবার দেখেছি, নানা জায়গা থেকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেছি। বর্ষার বাচ্চা এই প্রথম দেখলাম।
প্রাতঃরাশ শেষে বাচ্চা দুটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আলমারির কবাট খুলতেই নয়ন জুড়িয়ে গেল। কী সুন্দর ভঙ্গিতে তুলতুলে নরম দেহ দুটি পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল ওরা, গুড়ি মেরে আলমারির এক কোণ থেকে অন্য কোণে এগিয়ে আশ্রয় নিল। মখমলের মতো নরম-কোমল শরীর। আলতো করে ধরে তাদের কোলে তুলে নিলাম। তারপর একে একে হাতে নিয়ে চুমু খেলাম তাদের রেশমি কপালে। বাচ্চা দুটির একটি মদ্দা অন্যটি মাদি।
এদের বাদামি গায়ে ফুটে আছে বাঘের মতো কালো ডোরা দাগ। এই দাগ দেখে অনেক বিজ্ঞলোকও বনবিড়ালের বাচ্চাদের মেছো বাঘের বাচ্চা মনে করে ভুল করে থাকেন। বাচ্চাদের গায়ের এই দাগ অবশ্য মাস তিনেকের মধ্যে বাদামি রঙে মিলিয়ে যায়। মেয়ে বাচ্চাটি আকৃতিতে ছেলেটির চাইতে কিছুটা ছোট, কিন্তু ভীষণ চটপটে। ছেলেটি কিছু সময়ের জন্য বাধ্য বালকের মতো আমার কোলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলেও তার ছোটাছুটির বিরাম নেই। বনবিড়ালদের মধ্যে মেয়েরা একটু ছিপছিপে আর চটপটে হয়ে থাকে। মাতৃছাড়া বাচ্চা দুটি এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। কী হারিয়েছে এখনো তারা ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে আমার জানা আছে, কতটা সময় পর মায়ের জন্য ওরা অস্থির হয়ে উঠবে।
কিছুটা সময় ধরে বাচ্চাগুলোকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে আবার আলমারিতে ভরে রাখলাম। এবার ছেলেটার পরিচয় জানার জন্য প্রথমে গেলাম কাজী সাহেবের ফার্মেসিতে। আমাকে হতাশ করে দিয়ে কাজী সাহেব জানালেন, ছেলেটার নাম-পরিচয়-ঠিকানা কিছুই তিনি জানেন না। অথচ মা বনবিড়ালের সঠিক অবস্থান জানার জন্য ছেলেটির সাহায্যের ভীষণ প্রয়োজন। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল। সকালেই ছেলেটির কাছ থেকে সবকিছু জেনে রাখা উচিত ছিল। যে হৃদয়বান ছোট্ট মানুষটি দুটি জীবন বাঁচাতে ছুটে এসেছিল আমার কাছে, তন্দ্রার ঘোরে তাকে অবজ্ঞা করা মোটেও ঠিক হয়নি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নার্সারির তদারকির উদ্দেশ্যে বাগানবাড়িতে চলে এলাম। কিছুক্ষণ চারায় চারায় ঘুরে তারপর বাগানের ঘরে বসে ভাবতে লাগলাম ছেলেটির কথা। তার সঙ্গে স্বল্প কথোপকথনে শুধু এটুকুই জানতে পেরেছি, মা বনবিড়ালটি বাচ্চাসহ অবস্থান করছিল সুলতানপুর স্কুলের পাশের গোরস্থানে। সুলতানপুর গ্রামে বেশ কয়েকটি স্কুল রয়েছে। প্রত্যেকটি স্কুলের নিজস্ব নাম থাকলেও সাধারণভাবে সবগুলো গ্রামের নামে পরিচিত। আর প্রায় প্রত্যেক স্কুলের পাশেই গোরস্থান আছে। একাধিক গোরস্থানের মধ্যে স্বল্প সময়ের ভেতর বনবিড়ালের আস্তানা খুঁজে বের করা এক দুঃসাধ্য কাজ। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল গ্রিলের বেষ্টনী দেয়া পাশাপাশি তিনটি কবরের কথা। আরও কিছুক্ষণ ভাবার পর স্পষ্ট মনে পড়ল, এ ধরনের কবর রয়েছে তৌহিদ মেমোরিয়াল হাইস্কুলসংলগ্ন মিয়াবাড়ির গোরস্থানে।
ঠিক দুপুরে বাগানবাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইক নিয়ে রওনা দিলাম মিয়াবাড়ির গোরস্থানের উদ্দেশে। দূরত্ব খুব বেশি নয়, মাত্র ২ কিলোমিটার। স্কুলের কাছে পৌঁছে গেলাম মিনিট দশেকের মধ্যে। কবরস্থানের অবস্থান স্কুলের দক্ষিণ-পূবকোণে। স্কুল মাঠের দক্ষিণে মিয়াবাড়ির প্রাচীরের পাশে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম গোরস্থানের দিকে। বাঁ দিকের পাকা সড়ক ধরে কিছুদূর যাওয়ার পরই সিমেন্টের দেয়ালের ওপর গ্রিলের বেষ্টনী দেওয়া পাশাপাশি তিনটি কবর চোখে পড়ল। প্রত্যেক কবরের আশপাশে এবং ভেতরে ঝোপঝাড় রয়েছে। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর ঝোপের ফাঁক দিয়ে যা দেখলাম, তাতে বুকে সাত সাগরের ঢেউ খেলে গেল।
মাঝখানের কবরের উত্তর দেয়ালের পাশে বসে আছে উদ্বিগ্ন মা, সন্তান হারানোর চিন্তায় নিজের নিরাপত্তার কথা বেমালুম ভুলে গেছে সে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাকা সড়ক, যেকোনো সময় তার অস্তিত্ব ধরা পড়ে যেতে পারে মানুষের চোখে, নেমে আসতে পারে নিদারুণ আক্রমণ। তবু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। কেন জানি না, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বিপন্ন মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম, যদিও কাজটা ঠিক হয়নি। অনেকটা কাছাকাছি যাওয়ার পর বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ বনে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। ঠিক তখনই দুপুরের নিস্তব্ধ চরাচর যেন আমায় বলে দিল, মায়ের তুলনা শুধুই মা।
মাঝখানের কবরটির ভেতরের ঝোপঝাড়ের দুরবস্থা থেকে বুঝলাম মানুষ আজ সকালে কত নির্মম আক্রমণ চালিয়েছে এখানে। আবার মনে পড়ে গেল সেই অসাধারণ কিশোরের কথা। সভ্যতার চক্রান্ত মানুষকে ক্রমেই অমানবিক করে তুলেছে। মানবিক মূল্যবোধের এই চরম অবক্ষয়ের সময় কিশোরটির মনে যে মহান বোধ জাগ্রত হয়ে স্বজাতির হিংস্র থাবা থেকে সদ্য পৃথিবীর আলোতে আসা দুটো প্রাণীর জীবন বাঁচিয়েছে, তাকে আমরা কী বলব? মানুষ মানুষের জন্য এই সত্যকে অতিক্রম করে তার বুকে এসে ঠাঁই নিয়েছিল আরও গভীর এক সত্য: জীবন জীবনের জন্য।
মা বনবিড়ালটির ঠিকানা যখন খুঁজে বের করে ফেলেছি, ছেলেটির ঠিকানা বের করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এখন আশপাশের কাউকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না, তাতে ওরা আবার এ বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠবে। মায়ের জন্য তা মোটেও নিরাপদ নয়। আমি নিজেও সেখানে বেশিক্ষণ না থেকে ফিরে এলাম বাড়িতে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাচ্চাদের নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য খেলায় মেতে উঠলাম। সেইসাথে ওদের কিছু ছবি তুলে রাখলাম। বিকেলবেলা ওদের নিয়ে চলে এলাম বাগানবাড়িতে। বাচ্চাদের কাঠের বাক্সে ভরে নার্সারির কাজে মন দিলাম।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর বাক্সের ভেতর থেকে বিড়ালের বাচ্চার মতো মিউ মিউ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সন্ধ্যা এবং সকাল বনবিড়ালের বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়, তখন মা ওদের ঘুম ভাঙিয়ে খেলায় মেতে উঠে। আস্তে আস্তে অস্থির হয়ে উঠল বাচ্চা দুটো। অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করল ওদের ডাকাডাকি। এখনো ওদের নিয়ে বের হওয়ার সময় হয়নি, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষায় রইলাম।
রাত আটটার দিকে বাচ্চা দুটোকে চটের ব্যাগে ভরে রিকশায় করে রওনা দিলাম মিয়াবাড়ির গোরস্থানের উদ্দেশে। বাচ্চারা তখন আমার কোলের ওপর, বেশ চুপচাপ। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা, বাজারফেরত দু-একজনকে দেখা যাচ্ছে। এই রাস্তার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রোজ রাতেই কোথাও না কোথাও ডাকাতি হয়। সে যা-ই হোক, আমরা নিরাপদেই গোরস্থানের কাছে চলে এলাম। রিকশাচালক সৌরভ আমার বহুদিনের পুরোনো সঙ্গী। আমার এসব উল্টোপাল্টা (গ্রামের মানুষের মতে) কাজ সম্পর্কে তার খুবই স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। তাই এই নিশুতি রাতে যখন গোরস্থানের পাশে এসে রিকশা থামাতে বললাম, টুঁ শব্দটিও করল না সে। চুপচাপ রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে।
এক হাতে বাচ্চাভর্তি চটের ব্যাগ, অন্য হাতে টর্চলাইট নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সেই বিশেষ কবর তিনটির দিকে। কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে সামনের দিকে টর্চের আলো ফোকাস করতেই গ্রিলের বেষ্টনীর ভেতর থেকে ভেসে উঠল মার্বেলের মতো নীল দুটি চোখ। মা, এখনো বসে আছে সন্তানের অপেক্ষায়। আসলে সন্তানের মৃতদেহ নিজের চোখে না দেখে কোনো মা-ই বিশ্বাস করতে পারেনা যে তার সন্তান মারা গেছে। আসলে মা এমন এক সত্তা, যার মমতা কিংবা ভালোবাসা পশুত্ব কিংবা মনুষ্যত্বের কোনো মাপকাঠি দিয়ে মাপা সম্ভব নয়।
টর্চের আলো নিভিয়ে দিতে পৃথিবীর সন্তানহারা তাবৎ মায়ের যাতনা প্রচলিত নক্ষত্রের মতো আছড়ে পড়ল মনের জমিনে। নিথর অন্ধকারে ডুবে আছে চরাচর, গভীর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে গোরস্থানের বুকে। কাঁপাকাঁপা হাতে বাচ্চা দুটোকে ব্যাগ থেকে বের করে মাটিতে রাখলাম। তারপর ধীরলয়ে হেঁটে চললাম কবরস্থানের অদূরে দাঁড় করিয়ে রাখা সোহরাবের ত্রিচক্রযানের দিকে। পেছন থেকে মিউ মিউ ডাক ভেসে আসছে, চেনাজানা পরিমলের গন্ধ এসে লেগেছে তাদের নাকে, হয়তো মায়ের শরীরের সেই প্রাণপ্রিয় গন্ধ এসে দোলা দিচ্ছে মনে। তাই তো তাদের সেই সন্ধ্যার সকরুণ চিৎকার বদলে গিয়েছে স্বর্গীয় এক সুরে। মাকে ডাকছে ওরা, কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে এক মহামিলনের দৃশ্য মঞ্চস্থ হবে। মা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসবে তাদের দিকে, আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে তাদের শঙ্কিত হৃদয়। তারপর ওদের নিয়ে চলে যাবে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে। গভীর আনন্দে কানায় কানায় ভরে গেল আমার মন। বেঁচে থাকো বাচ্চারা, বড় হও নিরাপদে।
পরে অবশ্য আমি সেই হৃদয়বান কিশোরকে খুঁজে বের করেছিলাম, নাম তার অলী মোল্লা। বর্তমানে প্রবাসে কর্মরত এক যুবক।
আমি একটা জিনিস আজও ভেবে কূল পাই না, যে সময়টাতে গ্রামের মানুষ রীতিমতো উৎসব করে বন্যপ্রাণী আর বন্যপ্রাণীর বাচ্চাদের হত্যা করত, ঠিক তখন সাধারণ এক কিশোরের মনে কী করে এমন মহান চিন্তা এসে ভর করেছিল? কোন শক্তির বলে উত্তেজিত জনতাকে রুখে দিয়ে বাচ্চা দুটিকে সে নিয়ে এসেছিল আমার কাছে?