তিন হাজার বছরের পুরনো মেসোপটেমীয় সুগন্ধীর প্রতিরূপ তৈরি করেছে তুর্কি সুগন্ধী প্রস্তুতকারীরা
একজন সুগন্ধী প্রস্তুতকারক প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সুগন্ধী পুনরায় বানানোর জন্য একত্রিত হয়েছেন। তিন হাজার দুইশ বছর পুরনো এই সুগন্ধী পরিচিত 'নিসাবা' নামে। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের স্থানীয় গাছ থেকে বানানো এই সুগন্ধী তুরস্কের দিয়ারবাকির অঞ্চলের ঐতিহাসিক সেন্ট জর্জ গির্জায় প্রদর্শিত হয়।
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের সুগন্ধী নিয়ে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রদর্শনী আয়োজিত হল। দিয়ারবাকির এমন এক জায়গা যেটি প্রাচীনকাল থেকে সুগন্ধীর জন্য বিখ্যাত ছিল, বিশেষ করে সুগন্ধী আমদানি-রপ্তানির পথের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল এটি।
ডেইলি সাবাহের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিয়ারবাকিরের গভর্নর আলী ইহসান সু, সুগন্ধী প্রস্তুতকারক এবং সুগন্ধী বিশেষজ্ঞরা এই প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন এবং আগতদের অনেককেই এই প্রাচী মেসোপটেমীয় সুগন্ধী উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
কেন 'নিসাবা' নামকরণ?
মেসোপটেমিয়ার উঁচু অংশে জন্ম নেওয়া এক বিশেষ গাছ থেকে পাওয়া যায় এই সুগন্ধী। মূলত মেসোপটেমীয় শস্য এবং লেখার দেবী নিসাবার নামেই এই সুগন্ধীর নামকরণ করা হয়। প্রাচীনতম সুমেরীয় দেবতাদের মধ্যে একজন এই নিসাবা। শুরু থেকেই তাকে লেখার দেবী হিসেবে ধরা হলেও প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ান যুগে লেখার দেবতা হিসেবে নাবু নামে আরেক দেবতাকে ধরা হতে থাকে। তবে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লিখিত রেকর্ডে নিসাবা'র নাম বেশ কয়েক জায়গায় চোখে পড়ে।
এই প্রকল্পের সাথে জড়িত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি বিহতের তুরকান এরগুল জানান, "আমরা এর একটি নতুন নাম দিয়েছি মেসোপটেমীয় নিসাবা, যে শস্য, জমি এবং জ্ঞানের দেবী। আমরা এই নাম দিয়েছি কারণ শস্য জমি থেকেই ফলে। আর এই অঞ্চলের গাছ ও মাটি থেকেই এই সুগন্ধী তৈরি।"
দিয়ারবাকির এবং প্রাচীন সুগন্ধীর বাণিজ্য
মেসোপটেমীয় অববাহিকা থেকে জন্ম নিয়েছে সুমেরীয়, আসিরীয়, ব্যবিলনীয় এবং হিট্টাইট সভ্যতা, সেখানেই অবস্থিত দিয়ারবাকির। সুগন্ধী তৈরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এটি, এবং সুগন্ধী বাণিজ্যরুটের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল এটি, যে রুটে ধরে আরব থেকে ভারত থেকে শুরু করে মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, ইসরায়েল, মিশর, গ্রিস এবং রোম পর্যন্ত সুগন্ধী আমদানি-রপ্তানি করা হতো।
প্রাচীন সুগন্ধীগুলো বিশেষ ধরনের কাঁচ ও সিরামিকের পাত্রে রাখা হতো। প্রদর্শনীতে এই বিশেষ পাত্রগুলোর রেপ্লিকাও প্রদর্শিত হয়। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন অভিযানের সময় আসল পাত্রগুলো উদ্ধার করা হয়। বিশেষ করে তিন হাজার বছরের পুরনো জেরজেভান দুর্গ, যেটি রোমান আমলে দিয়ারবাকির এবং মারদিনের মাঝখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ছিল, সেখান থেকে বেশ কিছু আসল সুগন্ধী পাত্র আবিষ্কার করা হয়। প্রাচীনকালের সিরামিক, কাঁচের পাত্র এবং সুগন্ধী নিয়ে গবেষনা করা অধ্যাপক সেনকার আতিলা এই রেপ্লিকাগুলো তৈরির তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
প্রাচীন সুগন্ধীর আধুনিক সংস্করণ
প্রকল্পটিকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে । প্রথমত, প্রাচীনকালে কীভাবে সুগন্ধী প্রস্তুত করা হতো, তা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করতে হয়েছে, আধুনিক গবেষণাগারগুলোকে ঠিক একইভাবে সুগন্ধী তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তাছাড়া প্রাচীনকালে কোন গাছগুলো থেকে সুগন্ধী প্রস্তুত করা হয়েছে তা চিহ্নিত করাও বেশ কঠিন কাজ ছিল। এরগুল জানান, "আমাদেরকে সুগন্ধী সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে হয়েছে, বীশেষ করে যে এলাকায় সুগন্ধী প্রস্তুত করা হতো এবং ব্যবহার করা হতো তা সম্পর্কে জানতে হয়েছে। আমরা জানতাম এই গাছগুল মেসোপটেমিয়াতে জন্মায়, কিন্তু ঠিক এই প্রজাতির গাছই কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না।"
আসল বোতলের মতো রেপ্লিকা পাত্রগুলোও তৈরি করা বেশ কঠিন ছিল। আতিলা জানান, "আমরা আসল পাত্রগুলো দেখে একদম আসলের মতো রেপ্লিকা তৈরি করেছি এবং আনাতোলিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে এই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছি।"
এই প্রকল্প সফল হওয়ার পর এখন বাণিজ্যিকভাবে 'নিসাবা' তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সামনেও আরও কিছু প্রাচীন মেসোপটেমীয় সুগন্ধী পুনঃতৈরি করা হবে আশা করছেন তারা। এরগুল জানান, 'এই সুগন্ধীগুলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে বাজারজাত করা হবে, যেটী একইসাথে অনেকের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে।' গভর্নর সুও মেসোপটেমীয় সুগন্ধী তৈরির জন্য বড় কারখানা তৈরি করার পরিকল্পনা ঘোষণা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
সূত্র: এনশিয়েন্ট অরিজিন্স