গ্যাসলাইটারের মূল দুই লক্ষণ: কর্মক্ষেত্রে কি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন? কীভাবে বুঝবেন!
অফিসের কোনো সহকর্মীর সাথে বন্ধুত্ব করার পর থেকে কি কর্মক্ষেত্রে বিষণ্ণতায় ভুগছেন? অন্যান্য কর্মীরা তাকে কিভাবে অবমূল্যায়ন করছে তা শুনে কি আপনারও নিজের কর্মপরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে? কিংবা আপনি কি এমন কোনো বসের অধীনে কাজ করছেন যিনি নিজেই আপনাকে মিটিং এ না ডেকে পরবর্তীতে আপনার অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইছেন?
উপরের প্রশ্নগুলোর কোনোটির উত্তর যদি 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে ধরে নিতে পারেন আপনি আসলে একজন গ্যাসলাইটারের সঙ্গে কাজ করছেন।
গ্যাসলাইটার কারা? সহজ ভাষায় বলতে গেলে, কেউ যদি আপনার মনস্তত্ত্বকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে তাতে আপনি নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও বাস্তবতা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগেন, তাহলে এ ধরনের মানুষকে 'গ্যাসলাইটার' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর এ পুরো বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয় 'গ্যাসলাইটিং' হিসেবে। ব্যবসা-ক্যারিয়ার ভিত্তিক ওয়েবসাইট মার্কেট ওয়াচের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কর্মক্ষেত্রে গ্যাসলাইটার চেনার উপায় এবং এ ধরনের সহকর্মী এড়িয়ে চলার উপায়।
গ্যাসলাইটাররা একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা, সর্বোপরি মানসিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলে। এ ধরনের মানুষ বরাবরই নিজেদেরকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করে। আপনি তাকে বিশ্বস্ত বন্ধু বা সাপোর্টিভ সহকর্মী মনে করলেও, আসলে সে আপনাকে গ্যাসলাইট করেই চলে।
এ বছরের ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার হিসেবে 'গ্যাসলাইটিং'কে নির্বাচিত করেছে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার। ২০২২ সালে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডটকমে এ শব্দ খোঁজার হার ১,৭৪০ শতাংশ বেড়েছে।
১৯৩৮ সালে মুক্তি পাওয়া প্যাট্রিক হ্যামিল্টনের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার নাটক 'গ্যাস লাইট'-এ প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৪ সালে এই নাটকের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা জর্জ কিউকর-এর 'গ্যাসলাইট' সিনেমা শব্দটিকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। এ ছবিতে দেখা যায়, গ্রেগরি (চার্লস বয়ার) তার স্ত্রী পলাকে (ইনগ্রিড বার্গম্যান) বোঝাতে চেষ্টা করছে যে সে (পলা) মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। গ্রেগরি যখন চিলেকোঠায় লুকানো গয়ানা খুঁজতে যায়, তখন সারা বাড়িতে মিটমিট করে গ্যাসলাইট জ্বলতে থাকে। তখন গ্রেগরি পলাকে বলে যে সে (পলা) গ্যাসলাইট জ্বলার ব্যাপারটি কল্পনা করছে।
কীভাবে চিনবেন গ্যাসলাইটার?
গ্যাসলাইটারদের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা কোনো মিথ্যা বা ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা বাস্তবতা তৈরি করে। দ্বিতীয়টি হলো, নিজেদের শিকারকে সামাজিকভাবে হেয় করা।
এ ধরনের মানুষ বরাবরই অন্যের সাহায্যকারী এবং অবমূল্যায়নকারী- দুটো হিসেবেই কাজ করে। পরচর্চা করা, অন্যের কাজের কৃতিত্ব নেওয়া, অন্যদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া, বিরক্ত হওয়া, নিজের অবস্থানকে বসের সামনে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার জন্য অন্যদেরকে ছোট করা- এসবই গ্যাসলাইটারদের বৈশিষ্ট্য।
বেতন, পদোন্নতি, ক্ষমতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এসবই মূলত কর্মক্ষেত্রে গ্যাসলাইটিংয়ের কারণ। আবার গ্যাসলাইটিংয়ের বিস্তৃতিও বেশ অবাক করার মতো।
গ্যাসলাইটারদের কারণে কর্মক্ষেত্রে কেউ যেমন ব্যক্তিগত সীমানা বা 'পার্সোনাল স্পেস' হারাতে পারেন; তেমনি এমনও হতে পারে যে তাদের বলা কথার কারণে একই সেক্টরের অন্য কোথাও চাকরি পাওয়াটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
'স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইন্স দ্য রেস' এ প্রবাদটি গ্যাসলাইটারদের মূলমন্ত্র। প্রথমে তারা তাদের শিকারের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে নিজের বিষ তারা বপন করতে থাকে কর্মক্ষেত্রে। এ কাজে এমনকি অন্যদেরও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা। অফিসের কোনো সহকর্মী কি হঠাৎ করেই আরেক সহকর্মীর নামে নেতিবাচক কথা বলছেন আপনাকে? হতে পারে মনের অজান্তেই তার ফাঁদে পা দিয়েছেন আপনিও।
গ্যাসলাইটাররা যে সবসময় সরাসরি তাদের শিকারের ক্ষতি করে তার কিন্তু নয়। কোনো সহকর্মীর ক্ষতি করতে চাইলে, তাকে নিয়ে অন্যদের কাছে পরচর্চা করা এ ধরনের মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। একজন সহকর্মীকে নিয়ে অন্যদের মন কলুষিত করে ধীরে ধীরে তার ক্ষতিসাধন করে এরা।
আবার অনেকসময় গ্যাসলাইটাররা নিজেদের শিকারকে তোষামোদও করে, যা তাদের আচরণের শুরুতেই আপনি বুঝতে পারবেন না। জটিলভাবে বলা মিথ্যাগুলো হয়তো ধাপে ধাপে ধরা দিবে আপনার কাছে। কিন্তু ততদিনে দেখা যায়, তারা অন্যদের কাছে এরমধ্যেই আপনার একটা মিথ্যা নেতিবাচক অবতার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
সরাসরি নয়, স্মার্ট পদক্ষেপ নিন
একজন বিরক্তিকর সহকর্মী, মাইক্রোম্যানেজিং বস এবং একজন গ্যাসলাইটারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে- কোনোরকমের পদক্ষেপ নেয়ার শুরুতেই আগে তা বুঝতে হবে।
ক্যারিয়ার বিষয়ক ওয়েবসাইট মন্সটার ডটকম অনুসারে, "গ্যাসলাইটার চায় না আপনি উন্নতি করুন বা সফল হন। তারা আপনার কাজকে বিভ্রান্তমূলক কিংবা ভুল হিসেবে উল্লেখ করবে। আপনি যদি তাদের কোনো কথা নিয়ে প্রতিবাদ করেন তাহলে তারা উল্টো আপনারই দোষ ধরবে এবং অন্যদের সামনে আপনাকে 'ইনসিকিওর' হিসেবে তুলে ধরবে।"
গ্যাসলাইটার চেনা সহজ না হলেও, কিছু উপায়ে কর্মক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে পারেন আপনি। আপনার বস বা কোনো সহকর্মী আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখতে চাইছে কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। তাদের এধরনের আচরণের যৌক্তিকতা বিবেচনায় আনুন।
গ্যাসলাইটিং এর শিকার হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর আরেকটি বড় উপায় হলো নিজের সব কাজ ডকুমেন্ট করে রাখা। এতে কেউ চাইলেই আপনার কাজের কর্তৃত্ব দাবি করতে পারবে না।
মিটিং এর আগেই আপনার কাজ আলাদা করে ডকুমেন্ট করে রাখুন। কয়েকজন সহকর্মী মিলে কোনো মিটিং এ কাজ করছেন? বসকে সময়ে সময়ে নিজের অংশের কাজের অগ্রগতি পাঠান।
নিজের নেটওয়ার্কিং বজায় রাখুন। কর্মক্ষেত্রে আপনি নিজেই আপনার এজেন্ট। নিজেকে অন্যের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব, নিজের যোগ্যতা দেখানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার।
সর্বোপরি, কর্মক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে কোনো কিছু বলার আগে সতর্ক থাকুন। কখনোই ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করবেন না যা পরবর্তীতে আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা যেতে পারে।