ভারতবর্ষে একসময় কাছিমের স্যুপ ছিল বনেদি খাবার, বাংলাতেও তখন জনপ্রিয় ছিল কাছিম!
ব্রিটিশ ভারতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গভর্নর ছিলেন লর্ড জর্জ পিগোট। ১৭৭৬ সালে নিজের কাউন্সিলের বিদ্রোহের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। পরে তাকে বন্দি করা হয়। 'বায়ুপরিবর্তনের' জন্য কয়েক মাস পর পিগোটকে বন্দিদশা থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তার কিছুদিন পরেই মারা যান তিনি।
পিগোটের হঠাৎ মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনেক তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। তবে এর মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল একটি। ১৭৮৩ সালে জন কিং নামক এক লেখক তার বইয়ে দাবি করেন, 'মৃত্যুর আগে প্রচুর পরিমাণে কচ্ছপের স্যুপ খেয়েছিলেন লর্ড পিগোট।… উষ্ণ আবহাওয়ায় এ খাবারের কারণে মারাত্মক জ্বর আসাই স্বাভাবিক ছিল…'
সত্যিই কি কচ্ছপের স্যুপ খেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন এ গভর্নর, তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তবে জর্জিয়ান এ অভিজাত যে কাছিমের স্যুপের প্রতি যথেষ্ট রুচি তৈরি করতে পারেন, একথা ধারণা করা যায়।
১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অভিজাত ইংরেজদের বড় বড় ভোজে কচ্ছপের স্যুপ ছিল একটি অপরিহার্য খাবার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে এ কচ্ছপগুলো জীবন্ত আমদানি করা হতো। এ স্যুপ পরিবেশন করা হতো সুগন্ধি সবুজ পাতা, মশলা, মদিরা বা শেরি ইত্যাদি সহযোগে।
কচ্ছপের স্যুপ ছাড়াও তখন টার্টল স্টিক ও পটেজ, সালাদ ও জেলি, সুগন্ধি ঝোলে কচ্ছপের ডানা, কচ্ছপের ফ্রিকাসি ইত্যাদি পদও পাওয়া যেত। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল স্যুপটাই।
১৮ ও ১৯ শতকের রান্নাবিষয়ক বইগুলোতে এ খাবারের অহরহ রেসিপি দেখা যেত। এসব বইয়ে রান্নার বিভিন্ন প্রণালী ছাড়াও থাকত কীভাবে একটি কচ্ছপকে কাটতে হবে তার নিষ্ঠুর বর্ণনাও।
২
ক্যারিবিয়ানে যাত্রার সময় ইংরেজরা খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের সম্ভবনার কথা প্রথম টের পায়। তবে ভারতবর্ষে কচ্ছপ খাওয়া হতো তারও আগে থেকে।
সিন্ধু উপত্যকায় বাস করা মানুষেরা কচ্ছপ খেতেন বলে জানা যায়। ভারতীয় ঔষধশাস্ত্রে কচ্ছপের মাংসের গুণের কথা উল্লেখ রয়েছে। সুপ্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসক চরক তার রোগীদের অগ্নিমান্দ্য ও দুর্বলতার জন্য কচ্ছপের মাংস খেতে বলেছিলেন।
অবশ্য ভারতবর্ষের সব অঞ্চলের মানুষ কচ্ছপকে সুখাদ্য হিসেবে বিবেচনা করেনি। তবে প্রাচীন বাংলায় খাবার হিসেবে কচ্ছপের সমাদর ছিল। সমাজের বনেদি পরিবারগুলোতে হরিণ, পাঁঠা, ভেড়া, ও কচ্ছপের মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।
বাংলা অঞ্চলের তৎকালীন বিভিন্ন সাহিত্যকর্মেও কাছিমের ডিম ও মাংসের বিস্তর উল্লেখ পাওয়া যায়। নারায়ণ দেবের পদ্মপুরাণ-এর মূল চরিত্রের শ্যালিকাকে তার বিয়ের ভোজের জন্য কাছিমের পা রান্না করতে দেখা যায়। ১৮ শতকের প্রখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্ত বরিশাল অঞ্চলে কোরা নারিকেল দিয়ে কচ্ছপের মাংস রান্না করার কথা জানিয়েছেন। আসামের ১৬ শতকে লেখা গ্রন্থ কুমারহরণ-এ ডাল দিয়ে কচ্ছপের ডিম রান্নার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।
সবুজ কচ্ছপগুলো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে আনা হলেও ভারতীয়রা তাদের কচ্ছপ সংগ্রহ করতেন অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলো থেকেই। ইংরেজ প্রাণিবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ব্লাইথ ১৯ শতকে লিখেছেন বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ বিপুল পরিমাণে 'হুগলি নদীর মুখে' পাওয়া যেত। এগুলো ধরে কলকাতায় আনা হতো। কলকাতার নির্দিষ্ট কয়েক জাতের হিন্দুরা এ কচ্ছপ খেতেন। বাটাগুর বাসকা একসময় কচ্ছপের স্যুপের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়। তবে এ প্রজাতির কচ্ছপটি বর্তমানে মহাবিপন্ন।
কলকাতার দ্বিতীয় বিশপ রেজিন্যাল্ড হার্বার গঙ্গায় নৌকাযাত্রা করার সময় প্রথমবারের মতো দেশি নদীতে জন্মানো কচ্ছপের মাংস খেয়ে নিদারুণ প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন অন্য ইউরোপীয়রা। তারা মনে করতেন, হুগলিসহ ভারতবর্ষের অন্যান্য নদীগুলো মানুষের লাশের কারণে দূষিত ছিল। কারণ হিন্দু সাপের কামড়ে মৃতদের দাহ না করে নদীতে ভাসিয়ে দিত।
বলা বাহুল্য, ইউরোপীয়রা তখন ভারতবর্ষের নদীনালাতে পাওয়া কচ্ছপ খেতেন না। হার্বার তার এ কাজের জন্য যথেষ্ট সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। রবার্ট অ্যাডায়ার নামক এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন তো হার্বারের এ কচ্ছপ খাওয়া নিয়ে তাকে খোঁটা দিয়ে ঝাঁঝালো কবিতাও লিখেছিলেন।
৩
তবে অবশ্য পরে স্বাদ ও রুচি বদলাতে দ্বিধা করেননি গোরা সাহেব-মেমরা। দেশীয়ভাবে উৎপন্ন কাছিম খাওয়া শুরু করেন তারাও। কর্নেল আর্থার কেনি-হার্বার্ট তার কুলিনারি জটিংস ফর মাদ্রাজ গ্রন্থে ভারতবর্ষের নদীতে জন্মানো কচ্ছপ খাবার হিসেবে আরও মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য বলে উল্লেখ করেন।
ওয়াল্টার ক্যাম্পবেল নামক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনও স্থানীয় কচ্ছপের ভক্ত ছিলেন। নিজের লেখা মাই ইন্ডিয়ান জার্নাল (১৮৬৪)-এ ক্যাম্পবেল স্থানীয় রাজাকে উপহার দেওয়ার জন্য রামাপাতামের দুই জেলেকে তোষামোদ করে ও শেষে ঘুষ দিয়ে কীভাবে একটি বড় কাছিম জোগাড় করেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন।
ভারতবর্ষের জঙ্গলগুলোতে শিকারের সন্ধানে বের হলে কচ্ছপের খোঁজও করত ব্রিটিশরা। ওয়াইল্ড মেন অ্যান্ড ওয়াইল্ড বিস্ট গ্রন্থে লেফটেন্যান্ট কর্নেল গর্ডন কামিংস কচ্ছপ শিকার করার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। কচ্ছপ পানিতে দেখলে বা তীরে উঠে এলে গুলি করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কচ্ছপের স্যুপ সাধারণত পেশাদার রাঁধুনিরাই তৈরি করতেন। তবে বিকল্প হিসেবে ভারতবর্ষের ইউরোপীয়দের কাছে মক টার্টল স্যুপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮ শতকের শেষার্ধে লন্ডনের সরাইখানাগুলোর মতো কলকাতার সরাইখানাতেও কচ্ছপের স্যুপ পাওয়া যেতে শুরু করে। কলকাতার প্রখ্যাত রেস্তোরাঁ হারমোনিক ট্যাভার্ন বিখ্যাত ছিল এর ঝিনুক ও কচ্ছপের স্যুপের জন্য।
অভিজাতের প্রতীক হয়ে ওঠা কচ্ছপের স্যুপ একটা সময় কলোনিয়াল ভারতবর্ষের জেন্টলমেন'স ক্লাবগুলোতে জায়গা করে নেয়। ২০ শতক পর্যন্ত এসব ক্লাবে খাবার হিসেবে এ স্যুপ সমান জনপ্রিয় ছিল। তখন বেঙ্গল গেজেট ও মাদ্রাজ গেজেটের মতো সংবাদপত্রগুলোতেও কোন ক্লাব, সরাইখানা ইত্যাদিতে কোনদিন কচ্ছপ রান্না হবে সে বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো।
এরকম একটি বিজ্ঞাপন ছিল: 'চার্চের নিকটস্থ নিউ ট্যাভার্ন সরাইখানার রাইট মহাশয় কলিকাতার অধিবাসীদের জানাইতেছেন যে, তিনি কতিপয় জীবন্ত কচ্ছপ ক্রয় করিয়াছেন এবং একখানা কচ্ছপ ২৪ জুন শনিবার বধ করিবেন বলিয়া সিদ্ধান্ত লইয়াছেন।'
সূত্র: স্ক্রল ডটইন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত