বুকটক: টিকটকে বইয়ের দুনিয়া
দুয়ারে দুয়ারে তখন যমদূত। প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। মানুষ ঘরে খিল দিয়ে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দেশে দেশে লকডাউন নেমে এসেছে। কোভিড-১৯-এর সেই দিনগুলো ভীষণ ভয় আর আতঙ্কের। অচেনা রোগের ওষুধ জানা নেই কারও। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে চেনা মানুষ। টেলিভিশনে শুধু মৃত্যুর খবর। ঘর-মন-জানালা বন্ধের সেসব দিনে দুম করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থিতি বেড়ে যায়। সেখানেও শান্তি নেই। তিলকে তাল বানিয়ে গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার উৎকৃষ্ট এসব মাধ্যম স্বস্তি দিতে পারে না। মানুষের প্রয়োজন ভয়ডরহীন, শান্ত, সুস্থির সামান্য সময় কাটানোর ফুরসত। এ সময়েই একজন লেখকের মাথা থেকে চিন্তাটা আসে। কেট জ্যাকবস নামের এই তরুণী টিকটকে খুলে ফেলেন অ্যাকাউন্ট। এবং অবশ্যই প্রথম ভিডিওটি দিলেন নিজের প্রিয় জিনিস বই নিয়ে। বইপ্রেমীদের সহজে পেতে 'টিকটক' শব্দটিকে ভেঙে করে দিলেন 'বুকটক' হ্যাশট্যাগ। সেই শুরু। দ্রুত জনপ্রিয় কয়েকজন টিকটকারও তাদের প্রিয় বই নিয়ে ভিডিও দিলেন। বৈরী সময় একসঙ্গে কাটিয়ে প্রেমের বই সুপারিশ (রেকমেন্ড) করলেন তারা। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে গেল এই চর্চা।
হ্যাশট্যাগ বুকটক: ছোট আকারের ভিডিও সহজে তৈরি ও বিনিময়ের সুযোগ থাকায় তরুণ-তরুণীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম টিকটক। ভিডিও বিনিময়ের নেটওয়ার্কটির জন্য মজার ভিডিও তৈরি করে তারকা বনে গেছেন অনেকে। খ্যাতির পাশাপাশি অর্থ উপার্জন অনেককে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। যেখানে সম্পদ, খ্যাতি আর বিনোদন আছে সেখানে আর কী লাগে? তরুণদের কাছে তাই তুমুল জনপ্রিয় এই মাধ্যম। বাংলাদেশে একটা সময় টিকটক করা মানুষ বলতে উদ্ভট সাজপোশাকের কিশোর-কিশোরীদের ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু এ দেশেও এখন এই ধারণা বদলে যাচ্ছে। না বদলে উপায় নেই, চলতি মাসেরই ১৪ তারিখ টিকটকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী বব ডিলান; তা-ও ৮৩ বছর বয়সে। অন্যদিকে সেই কেট জ্যাকবস নিজের অ্যাকাউন্টে বিশ মিলিয়নের বেশি লাইক নিয়ে বসে আছেন। পেয়েছেন বুকটকের স্রষ্টার খ্যাতি।
তরুণদের বইয়ের দুনিয়া: টিকটকে বুকটক হ্যাশট্যাগ দিয়ে ভিডিও শেয়ার শুরুর পর খুব বেশি দিন লাগেনি, প্রায় ৬০ বিলিয়নের বেশি দর্শক পেয়ে যায় হ্যাশট্যাগটি। যেকোনো সামাজিক মাধ্যম বা ওয়েবসাইটের জন্য সংখ্যাটা মোটেও ছোট না। টিকটক তার নতুন এই বইপাগল গোষ্ঠীকে তাই উপযুক্ত গুরুত্বই দেয়। ২০২২ সালে এসে প্ল্যাটফর্মটি ঘোষণা দিয়েই তাদের সমর্থন জানায়। টিকটক জানায়, বুকটকের প্রভাব শুধু ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় সীমিত থাকেনি। বাস্তব জীবনেও এর অবিশ্বাস্য প্রভাব পড়েছে।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন দেখলে টের পাওয়া যায় কী প্রভাব পড়েছে। বুকটক শুরুর এক বছরের ভেতর শুধু যুক্তরাজ্যে বইয়ের বিক্রি অতিরিক্ত ৫ শতাংশ বেড়ে ৬.৭ বিলিয়ন পাউন্ডে পৌঁছে। দেশটির পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বইয়ের এই বিক্রি বাড়িয়েছে বুকটক। সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া পাঁচটি বইয়ের চারটিই ছিল বুকটক ট্রেন্ডিংয়ে। বইয়ের দোকানগুলোয় প্রচুর ক্রেতারা খুঁজে খুঁজে সেই বইগুলোই কিনেছেন, যেগুলো নিয়ে বুকটকাররা আলোচনা করেছেন বা ভিডিও দিয়েছেন।
বুকটক আসার পর ইউরোপ-আমেরিকার বইয়ের দোকানগুলোর পরিবেশ বদলে গেছে। দোকানগুলোয় এখন লেখা থাকছে এই মুহূর্তে কোন বইটা বুকটকে ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে। কোন বই নিয়ে কী আলাপ হচ্ছে, তার খোঁজ রাখতে হচ্ছে বিক্রেতাদেরও। এ কারণে প্রায় বিক্রেতারা নিজেরাও এখন টিকটকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। নিজেরাও বুকটক ভিডিও দিচ্ছেন বা মন্তব্য করছেন। অন্যদিকে লেখক-প্রকাশকেরাও বই বিপণনের এই মওকা লুফে নিচ্ছেন। এক মিনিটেরও কম দৈর্ঘ্যরে ভিডিওতে কেউ নিজের পছন্দের বইয়ের ব্যাপারে ছোট মন্তব্য করছেন। কেউ রিভিউ দিচ্ছেন। কেউ ভালো লাগা দুয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। কেউ তো বইয়ের ভেতরের গল্প বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আর বই নিয়ে এই তেলেসমাতি আঁকড়ে ধরে রাখছে তরুণ-তরুণীদের। সমসাময়িক কথাসাহিত্য থেকে শুরু করে রোমান্স ও ফ্যান্টাসি সব ঘরানার বই তারা পড়ার তালিকায় রাখছে।
সাহিত্যানুরাগীদের জন্য 'বুক ক্লাব': বুকটকের জনপ্রিয়তা আর প্রভাবের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে টিকটক নতুন ঘোষণা দেয়। সাহিত্যানুরাগীদের জন্য তারা চালু করে 'বুক ক্লাব'। বুক ক্লাবের জন্য টিকটক অ্যাপে একটি নির্দিষ্ট জায়গা রাখে। সেখানে প্রতি মাসে নতুন বই যুক্ত করা হয়। প্রতি মাসে সদস্যরা বইটি পড়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তার কথা জানাতে পারেন কমিউনিটির সদস্যদের।
এ বিষয়ে টিকটকের পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিটি বিভাগের প্রধান জেমস স্ট্যাফোর্ড তখন বলেন, হ্যাশট্যাগ বুকটক ইতিমধ্যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে আগ্রহ তৈরিতে সাহায্য করেছে। স্বল্প পরিচিত লেখক ও তাদের লেখাগুলো তুলে ধরতেই তাদের এ উদ্যোগ। ভার্চ্যুয়াল এ কমিউনিটিতে 'বুকটক লরিয়েটস' নামে বইপ্রেমী একদল টিকটকার থাকবেন, যারা বই পড়ার পর বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে তা বিনিময় করবেন। মাসের শেষে তারা বই নিয়ে সরাসরি (লাইভ) অনুষ্ঠানে আলোচনাও করবেন।
বুক ক্লাবে প্রথম যে বইটি নির্বাচন করা হয়, সেটি হলো ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক জেন অস্টেনের 'পারসুয়েশন'। ১৮১৭ সালে লিখিত এই ক্ল্যাসিক উপন্যাসের ওপর কিছুদিন পরই নেটফ্লিক্সে একই নামে চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। অস্টেন আগে থেকেই বুকটকার মাঝে জনপ্রিয় ছিলেন। টিকটকের এই ঘোষণা দেওয়ার আগেই অস্টেনটক শিরোনামে অনেক হ্যাশট্যাগ পড়েছে; যা ১৬.২ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বুক ক্লাবের প্রথম নির্বাচিত ক্ল্যাসিক হিসেবে সেটি আরও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
টিকটক বুক অ্যাওয়ার্ড: বুকটক, বুক ক্লাবের পর টিকটক নিয়ে আসে 'টিকটক বুক অ্যাওয়ার্ড'। কয়েকটি শাখায় বুকটকারদের ভোটের মাধ্যমে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। গত বছর এই পুরস্কার পেয়েছেন দুই লেখকও। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লেখক লিসা জুয়েল এবং অ্যাডাল্ট ফ্যান্টাসির লেখক রেবেকা ইয়ারোস পেয়েছেন পুরস্কার। বুক অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন লিসা, বুক অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড (ইন্টারন্যাশনাল) পেয়েছেন রেবেকা। বুকটক ব্রেকথ্রো অথর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তালিয়া হিবার্ট, বুকটক ক্রিয়েটর অব দ্য ইয়ার হয়েছেন মাইসি মাটিল্ডা, বুকটক রাইজিং স্টার ক্রিয়েটর হয়েছেন জন পল কুনরুনমি। পুরস্কৃত করা হয়েছে একটি বইয়ের দোকান এবং একটি বইকেও।
ছাপা বই নিয়ে আসছে টিকটক: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ছাপা বই প্রকাশ করা শুরু করতে যাচ্ছে টিকটকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স। ইতিমধ্যে তারা ই-বুক প্রকাশ করেছে। ফেব্রুয়ারিতে তারা বইয়ের দোকানগুলোয় ছাপা বই বিক্রি শুরু করবে। বাইটড্যান্সের সম্পাদকীয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান জ্যাকব ব্রনস্টেইন গত নভেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বুকটকের জনপ্রিয়তা কাজে লাগাবে বাইটড্যান্স।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, মার্কিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জান্ডোর সঙ্গে অংশীদারত্বে ছাপা বই প্রকাশ করবে বাইটড্যান্স। কবে কোন বই প্রকাশ করবে, তারও একটি ছোট তালিকা তারা দিয়েছে। এ বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ছাপা অক্ষরে তারা প্রকাশ করবে ক্যাটলিন ক্রসের লেখা 'অন স্ক্রিন অ্যান্ড অব অ্যাগেইন'। এরপর ১৮ মার্চ সৈয়দ এম মাসুদের লেখা 'দ্য লাস্ট ম্যান ইন প্যারাডাইস' প্রকাশের কথা রয়েছে। ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত হবে সানিবেলের লেখা 'টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ মোর'।
বুকটকবিডি: বাংলাদেশের টিনেজারদের কাছেও টিকটক তুমুল জনপ্রিয়। কিন্তু এখানে 'কোয়ালিটি কনটেন্ট'-এর অভাব রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। এখানকার বেশির ভাগ আধেয়ই নকল করা। অন্যের গানে বা ভিডিওকে অনুকরণ করে বানানো। বেশির ভাগ সময়ই অন্যের কথা বা গানে ঠোঁট মেলাতে পছন্দ করেন এখানকার উঠতি তরুণ-তরুণীরা। নাচ-গান আর কৌতুকই বেশি। তবে এর মাঝেও বুকটক গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে। বৃহৎ ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর তুলনায় সংখ্যায় সামান্য হলেও অনেকেই বই নিয়ে ভিডিও তৈরি করছেন। বাংলাদেশি বুকটকাররা আবার হ্যাশট্যাগ যুক্ত করছেন বুকটকবিডি শিরোনামে। বইয়ের নান্দনিক ছবি বা ভিডিও, সহজ পাঠপ্রতিক্রিয়া, বিশেষ কোনো লেখার উদ্ধৃতি এসবই করছেন তারা। ছোট গোষ্ঠী বলে বইয়ের বাজারে খুব একটা প্রভাব তারা ফেলতে পারছেন না। অন্যদিকে লেখক বা প্রকাশকদের একেবারেই বুকটক নিয়ে আকর্ষণ দেখা যায় না। বাংলাদেশে টিকটকার মানে এখনো অনেকের কাছে নেতিবাচক কিছু।
একুশে বইমেলায় টিকটক: বুকটককে জনিপ্রয় করে তুলতে অমর একুশে বইমেলায় স্টলও নিয়েছে টিকটক। ২০২৪ সালের বইমেলায় তাদের স্টলের একটি কর্নার রাখা হয় বুকটক নামে। টিকটকে বুকটক হ্যাশট্যাগে যেসব বই আলোচনায় রয়েছে, সেগুলো রাখা হয় কর্নারে। যেসব গল্প এবং লেখকদের নিয়ে অনেক আলোচনা বা ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে বইপ্রেমীদের জানানোর ব্যবস্থা করে তারা। তবে খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি স্টলটি। লেখক-পাঠকদের মনোযোগ টানতে না পারার কারণ অনেকটা হতে পারে টিকটকের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব।