প্রতিবাদ, প্রেম, শিল্প: ভারতে রক্তের অদ্ভুত সব ব্যবহার
প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের একটি অলাভজনক সংগঠন এর সদস্যদের দান করা রক্ত দিয়ে ছবি তৈরি করছে।
দিল্লিভিত্তিক 'শহীদ স্মৃতি চেতনা সমিতি' নামক এ সংগঠনটি রক্ত ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন বিপ্লবী ও শহীদদের ২৫০টি চিত্রকর্ম তৈরি করেছে।
এ ছবিগুলো সচরাচর আশ্রম ও বিভিন্ন ছোটখাটো জাদুঘরকে দিয়ে দেয় সমিতিটি। আবার কখনো রক্তে আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শনীতেও দেখানো হয়।
'প্রতীকীবাদে সমৃদ্ধ রক্ত। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের প্রেরণা ছড়িয়ে দিতে আমরা রক্ত দিয়ে আমাদের ছবিগুলো আঁকাই। শিশুদের মধ্যে এখন দেশের প্রতি ভালোবাসা কমে যাচ্ছে,' বলেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক প্রেম কুমার শুক্লা।
শহীদ স্মৃতি চেতনা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা রবি চন্দ্র গুপ্ত ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল অধ্যক্ষ। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার আগে তিনি ১০০টি ছবির জন্য রক্ত দিয়েছিলেন। 'রক্ত দিয়ে ছবি আঁকলে তাতে মানুষ বেশি আগ্রহ দেখায়। রক্ত আবেগ জাগ্রত করে,' এক সাক্ষাৎকারে একবার জানিয়েছিলেন গুপ্ত। ২০১৭ সালে মারা যান তিনি।
বর্তমান পরিচালক শুক্লার বয়স হলেও এখনো বেশ শক্তিশালী ও উদ্যমী একজন মানুষ তিনি। পেশায় স্কুলশিক্ষক শুক্লা কবিতাও লিখেন। নিজেও শখানেক ছবির জন্য রক্ত দিয়েছেন বলে দাবি তার।
শুক্লার মতো দাতারা স্থানীয় একটি ল্যাবে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসেন। এরপর ওই রক্তকে জমাটবাঁধা হতে রক্ষা করতে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ৫০ মিলিলিটার বোতলে সংরক্ষণ করা হয়। তারপর সেগুলো শিল্পীদের কাছে সরবরাহ করা হয়।
সাধারণত ১০০ মিলি রক্ত দিয়ে দুই থেকে তিনটি চিত্রকর্ম তৈরি হয়ে যায়। শুক্লা জানান, তিনি বছরে চারবার ছবির জন্য রক্তদান করেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।' তার এ উক্তি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই 'রক্তচিত্র' আঁকার উৎসাহ পায় শুক্লার সংগঠন।
রক্তের রাজনীতি ভারতীয় সংস্কৃতির সুগভীরে প্রোথিত। মহাত্মা গান্ধী নিয়মিত তার রক্তচাপ মাপতেন। রক্ত বিষয়ে তিনি 'আবিষ্ট' ছিলেন বলে জ্যাকব কোপম্যান ও দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির লেখা রক্ত ও রাজনীতির সম্পর্ক বিষয়ক বই হেমাটোলজিস থেকে জানা যায়।
রক্তকে ভারতবর্ষে দেখা হতো উপনিবেশবিরোধী উপমা হিসেবে। ১৯৪৮ সালে খুন হওয়ার দিন যে পোশাক পরেছিলেন গান্ধী, সেই রক্তাক্ত পোশাকটি এখন দক্ষিণ ভারতের মাদুরাইয়ের একটি জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়।
একইসঙ্গে আনুগত্য ও ত্যাগের রূপকও রক্ত। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কড়া সমর্থকেরা তাদের রক্ত দিয়ে মোদীর ছবি এঁকেছেন।
এছাড়া রক্ত প্রতিবাদেরও মাধ্যম ভারতে। জমি দখল করে সড়ক তৈরির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ২০১৩ সালে গুজরাটের প্রায় শতাধিক নারী নরেন্দ্র মোদীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। মাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পর বিচার চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন উত্তর প্রদেশের এক কিশোরী।
বেতন বাড়ানো, হাসপাতাল ও স্কুল তৈরির দাবি; নির্মম আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো—ইত্যাদি আন্দোলনে ভারতের মানুষ নিজেদের দাবিসমূহ রক্ত দিয়ে লেখে। অনেকে প্রেমপত্রও লেখে রক্ত ব্যবহার করে। এর পাশাপাশি রাজনীতিবিদরা জনগণের 'রক্ত চুষে খান' বলে আক্ষেপ ও ক্ষোভ জানানোর বিষয়টি তো আছেই।
১৯৮৪ সালে ভারতের ভূপালে গ্যাস দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা ২০০৮ সালে ৮০০ কিমি হেঁটে দিল্লিতে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে রক্ত দিয়ে লেখা চিঠির মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন।
১৯৮০ সালে আসামে বিক্ষোভের সময় ২২ বছর বয়সী এক যুবক নিজের রক্তে গুয়াহাটির রাস্তায় স্লোগান লিখে বেড়ান। 'আমরা রক্ত দেব, তেল নয়,' একটি স্লোগান ছিল এমন।
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে তহবিল নিয়ে বিতর্ক হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) এর সমর্থকদের রক্ত বিক্রি করে প্রয়োজনীয় অর্থ উত্তোলন করতে আহ্বান করে।
তবে সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে সংগ্রহ করা বেশিরভাগ রক্ত শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়। আর ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয় জাপানি ঋণের সাহায্য নিয়ে। এ ঘটনার মোটামুটি এক দশক পরে ভারতে রক্ত বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়।
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে রক্তদান ক্যাম্পের আয়োজন করে। এটা স্পষ্ট, রক্ত একটি কার্যকর প্রতীক।
'জাতের বিশুদ্ধতার সঙ্গে রক্ত সম্পর্কিত। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবেই, রক্ত দিয়ে লেখাটা একটি পুরুষোচিত কাজ বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আনুগত্যের সর্বোচ্চ রূপ হিসেবেও রক্তকেই দেখা হয়,' বলেন সমাজতাত্ত্বিক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব।
অধুনা সময়ে ভারতে ঋতুস্রাব বিষয়ে 'ট্যাবু' ভাঙতে রক্ত ব্যবহার করেছেন নারীরা। ২০০৪ সালে চেন্নাইয়ের (তৎকালীন মাদ্রাজ) এক কারাতে প্রশিক্ষক নিজের রক্ত দিয়ে তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ারাম জয়ললিতার ৫৭টি ছবি আঁকেন।