অবিকল ভিঞ্চি, ভ্যান গগদের মতো ছবি আঁকছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! ভবিষ্যতে শিল্পীদের সঙ্গী না হুমকি?
২০২২ সালের শেষ কয়েক মাসে ইন্টারনেট মেতে উঠেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে আঁকা ছবি নিয়ে। লেনসা, ডাল-ই, মিডজার্নি ইত্যাদি এআই আর্ট জেনারেটর টুলকে ফরমায়েশ দিয়ে ব্যবহারকারীরা সহজেই মুহূর্তের মধ্যে তাদের পছন্দমতো ছবি আঁকিয়ে নিতে পারেন।
লেনসা অ্যাপটি ব্যবহার করে যেকোনো মানুষের ছবিতে জাদুবাস্তবতার রূপ দেওয়া সম্ভব। ডাল-ই টুলটির মাধ্যমে ছবির বর্ণনা লিখেই ছবি তৈরি করতে পারেন ব্যবহারকারী। এসব এআই ডিজিটাল আর্ট জেনারেটরগুলো এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় মান, গতি ইত্যাদিতে যেমন এগিয়ে; তেমনি নেটিজেনরা আগের চেয়ে অনেক সহজেই এগুলো ব্যবহার করতে পারছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এ মডেলগুলোকে আগে থেকেই লাখো ছবি ও লেখার সমন্বয়ে তৈরি করা ডেটাসেটের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর ফলে ক্রমশ নিজেদের কাজে দক্ষ হয়ে ওঠে এ মডেলগুলো। কিন্তু সর্বোচ্চ কতটুকু ভালো ছবি এসব মডেলের পক্ষে আঁকা সম্ভব—এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
কোনো কম্পিউটারের পক্ষে কি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মগুলোর প্রকৃত আবেশকে তুলে ধরা সম্ভব? অথবা বিলাসবহুল কোনো ব্র্যান্ডের হয়ে ভিজ্যুয়াল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন করার জন্য যে পরিমাণ দক্ষতা প্রয়োজন, তা কি কখনো অর্জন করতে পারবে এআই মেশিনগুলো?
অতীতে যখন এআই ছবি তৈরি করত, তখন সেগুলো দেখেই বোঝা যেত ওই ছবিগুলো কোনো ডিজিটাল যন্ত্র তৈরি করেছে। কিন্তু এ সময়ে এসে ছবিগুলো ধীরে ধীরে নিখুঁত হয়ে উঠছে। আর তা শিল্পীদের জন্য কিছুটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৃজনশীল শিল্পচর্চার সঙ্গে হয়তো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সৃষ্টির এখনো তুলনা করা চলে না। কিন্তু যেসব শিল্পী অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন, বিশেষত ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার বা কমার্সিয়াল ইলুস্ট্রেটর, তাদের জন্য এ ধরনের এআই আদতেই হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
এআই ব্যবহার করে পেশাদার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ২০২২ সালে স্যান ফ্রান্সিসকো ব্যালে নামক একটি প্রতিষ্ঠান তাদের একটি শোয়ের ভিজ্যুয়াল ক্যাম্পেইন তৈরির জন্য মিডজার্নি ব্যবহার করেছে। তবে কোম্পানিটির একজন প্রতিনিধি জানিয়েছিলেন, এআই ব্যবহার করা সত্ত্বেও ৩০ জন মানুষ কারিগর কাজ করেছিলেন ওই ক্যাম্পেইনটিতে।
আরও একটি হুমকি হচ্ছে, এসব এআই মেশিন শিল্পীদের আঁকার শৈলীকে নকল করে নতুন শিল্প তৈরি করতে পারে। যেমন, ঋষি সুনক ইউনিকর্নে চড়ে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করছেন এমন দৃশ্য ভ্যান গগের চিত্রকর্মের ধাঁচে এঁকে ফেলতে সক্ষম এআই।
তেমনিভাবে যেকোনো বিখ্যাত চিত্রকরের ধারা, শৈলী, ভাব ইত্যাদিকে ব্যবহারকারীর চাহিদা মতোন নতুন চিত্রকর্মে জুড়ে দিতে পারে এআই সফটওয়্যারগুলো।
এতে হয়তো আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এআই আর্ট জেনারেটরগুলো যদি কোনো জীবন্ত শিল্পীর স্টাইল অনুকরণ করে ছবি তৈরি করতে শুরু করে, তাহলে তা ওই শিল্পীর জন্য সমস্যা তৈরি করবে বইকি।
এক্ষেত্রে এসব টুলের বিরুদ্ধে শিল্পীরা কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইলেও তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) এআইকে কপিরাইট করা ছবি ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বৈধতা বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন সেখানকার আইনজীবীরা। এদিকে যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ইচ্ছেমতো এআই প্রশিক্ষণ বিষয়ে পূর্ণক্ষমতা দেওয়ার জন্য একটি বিল প্রস্তাব করেছে।
যদিও এ বিষয়গুলো অতি সম্প্রতিই মূলধারার আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। একদল শিল্পী এআইয়ের এ সম্ভাবনার সূচনালগ্ন থেকেই এটির ভবিষ্যৎ বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তারা এর সমাধান খুঁজতেও কাজ শুরু করেছিলেন।
বার্লিনভিত্তিক শিল্পী ম্যাট ড্রাইহাস্ট ও হলি হার্নডন এমন একটি সার্চ ফাংশন উদ্ভাবন করেছেন যেটি ব্যবহার করে যেকোনো শিল্পী তার চিত্রকর্ম কোনো এআইকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা খুঁজে বের করতে পারবেন।
এছাড়া এ শিল্পীজুটি আরও একটি টুল তৈরি করেছেন যার মাধ্যমে শিল্পীরা চাইলে তাদের শৈলী ও প্রতিচ্ছায়া কীভাবে ব্যবহার করা যাবে তার অনুমতির ব্যবস্থা ঠিক করে রাখতে পারবেন।
তবে কিছু শিল্পী পুরো বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। তারা মনে করছেন, আরও ভালো কাজ করার জন্য এআই প্রযুক্তি তাদের সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইলাস্ট্রেটর মিশেল থম্পসন বলেন, 'আমি এটাকে হুমকির চেয়ে বরং সুযোগ হিসেবে বেশি দেখব। আর সবকিছুর মতো, এ টুলসমূহ আরও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করার মতো অনেক শিল্পীই পাওয়া যাবে সামনে।'
এআই ফটো জেনারেটরগুলোর ক্ষমতা নির্ভর করে এগুলোকে কোন ধরনের ডেটাসেটের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তার ওপর। কিন্তু পক্ষান্তরে মানুষের কল্পনাশক্তির তো কোনো সীমা নেই। একজন শিল্পী ভবিষ্যতে কী তৈরি করতে পারবেন, এআইয়ের পক্ষে তা অনুমান করে বর্তমানে সেটা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
যারা এআইয়ের এ বিপ্লবকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা ইতোমধ্যে টের পাচ্ছেন এআইর তৈরি এ ছবিগুলো ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। শীঘ্রই সাদা চোখে দেখলেও মানুষ বুঝে ফেলতে পারবে কোন ছবিটি মেশিনে আঁকা, আর কোনটি মানুষের।
তবে মানবশিল্পীর স্থান দখল করতে সক্ষম এমন রোবটের অস্তিত্ব এখনো না থাকলেও, ভবিষ্যতে তেমনটা দেখতে হবে মানুষকে। ভবিষ্যতের শিল্পী, ইলাস্ট্রেটর ও নকশাকারীদের এআই টুলগুলো ব্যবহার করবেন কি না, তা নয় বরং কীভাবে ব্যবহার করবেন সে দিকটা নিয়েই ভাবতে হবে।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান