এআই চ্যাটবট দুনিয়ায় ডিপসিকের উত্থান: ধস নামল এনভিডিয়াসহ শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারে
বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারে আলোড়ন তুলেছে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-চালিত চ্যাটবট ডিপসিক। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে উন্মোচিত এ চ্যাটবটটি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া বিনামূল্যের অ্যাপ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
ধস নামিয়েছে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারেও। এই ধাক্কায় বিশ্বের ৫০০ শীর্ষ ধনী ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে ১০৮ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এনভিডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেনসেন হুয়াং। তার সম্পদ কমেছে ২০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, যা তার মোট সম্পদের ২০ শতাংশ।
ডিপসিকের ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং তুলনামূলক কম খরচে এই এআই চ্যাটবটটির তৈরি করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এআই কোম্পানিগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করেছে। সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারী মার্ক অ্যান্ড্রেসেন ডিপসিককে এআই ক্ষেত্রে 'সবচেয়ে বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ অগ্রগতি' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ডিপসিক দাবি করেছে, তাদের তৈরি এআই মডেল যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এআই প্রযুক্তি, যেমন চ্যাটজিপিটির সমতুল্য এবং তুলনামূলকভাবে অনেক কম খরচে তৈরি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, নতুন এই এআই মডেল তৈরিতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলার, যেখানে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ব্যয় দাঁড়ায় কয়েক বিলিয়ন ডলারে।
ডিপসিক প্রতিষ্ঠা করেছেন চীনা উদ্যোক্তা লিয়াং ওয়েনফেং। হাংঝু ভিত্তিক এই কোম্পানি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে যাত্রা শুরু করে।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করা ৪০ বছর বয়সি লিয়াং, এনভিডিয়া এ১০০ চিপের বড় মজুদ সংগ্রহ করেন। এই চিপ বর্তমানে চীনে রপ্তানিতে নিষিদ্ধ হলেও তিনি প্রায় ৫০ হাজার চিপ সংগ্রহ করেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই চিপগুলোর সঙ্গে সস্তা চিপ মিলিয়ে তিনি ডিপসিক তৈরি করেছেন।
ডিপসিক অ্যাপটি মূলত চ্যাটজিপিটির মতোই কাজ করে। এটি ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং বিভিন্ন কাজ সহজ করতে সক্ষম। অ্যাপটির জনপ্রিয়তা এতোই বেড়েছে যে, এটি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে বিনামূল্যের অ্যাপগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেছে। তবে কিছু ব্যবহারকারী নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সমস্যার কথা জানিয়েছেন।
অ্যাপটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে এর স্বতঃস্ফূর্ত লেখার ক্ষমতার জন্য। তবে এটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয় এড়িয়ে চলে। যেমন, তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে অ্যাপটি কোনো উত্তর দেয় না।
ডিপসিকের সাশ্রয়ী প্রযুক্তি মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে চিপ নির্মাতা ও ডেটা সেন্টার কোম্পানিগুলো। প্রযুক্তি খাতে সামগ্রিকভাবে ৯৪ বিলিয়ন ডলার সম্পদ হ্রাস পেয়েছে, যা ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্সের মোট ক্ষতির ৮৫ শতাংশ। নাসডাক কম্পোজিট সূচক ৩ দশমিক ১ শতাংশ এবং এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে।
বিশেষ করে এনভিডিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিন কোম্পানিটির বাজারমূল্য প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার কমে যায়, যা মার্কিন ইতিহাসে এক দিনে কোনো কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। শেয়ারের মূল্য ১৭ শতাংশ কমে যাওয়ার ফলে এনভিডিয়া বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি থেকে তৃতীয় স্থানে নেমে আসে। এর বর্তমান বাজারমূল্য ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগে এটি ছিল ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, অরাকলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন ২২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার খুইয়েছেন। ডেলের মাইকেল ডেল ১৩ বিলিয়ন ডলার এবং বিন্যান্সের চাংপেং ঝাও ১২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
ডিপসিক উন্নতমানের চিপের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ ব্যবহার করে এই সফলতা অর্জন করেছে। এটি প্রমাণ করেছে, এআই প্রযুক্তি উন্নত করতে বিশাল বাজেট ও সর্বাধুনিক চিপ সবসময় অপরিহার্য নয়। ফলে উচ্চমানের চিপের প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যৎ নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন