ছবি জাল এটা প্রমাণ করা এক বিষয়, ছবি জাল নয় তা প্রমাণ করা আরেক বিষয় নয়!
সত্য যে যুদ্ধের প্রথম নিহত বস্তু, তা একটি পুরনো কথা। এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ইউক্রেন এবং সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের ছড়িয়ে পড়া ছবি এবং ভিডিও। এগুলোর অনেকগুলোই নির্ভেজাল নকল। অনেকগুলো আবার সত্য ছবিকে বিকৃত করে তৈরি করা। গত বছর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একটি নকল ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তাকে দেখা যায় তিনি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বলছেন।
যদিও এই ধরনের নকল ছবি বা ভিডিওর বিস্তার মিথ্যা বলাকে আরও সূক্ষ্মতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এদের সর্বব্যাপীতা আসল ছবিগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগানো শুরু করেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছর রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পরপরই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস মারিউপোলের ওপর হামলায় একটি অল্পবয়সী মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার পর ডাক্তারদের একটি ভিডিও প্রকাশ করে। ফুটেজটি রুশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়, তবে তার ওপর প্রদর্শিত হয় 'ফেক' শব্দটি। যেহেতু এ ধরনের জিনিসকে ভুল প্রমাণ করা কঠিন (অর্থাৎ, ছবি বা ভিডিওটি জাল সেটি প্রমাণ করা), তাই এই ধরনের প্রমাণকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে, এমনকি আদালতের প্রমাণকেও।
তাই, কোনো ডিজিটাল ছবি বা ভিডিও আসল নাকি জাল তা নিশ্চিত করা আগামী সময়ে মূল্যবান হয়ে উঠবে। এবং এ ধরনের একটি ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছে। আর সেটি হলো 'গ্লাস-টু-গ্লাস ওয়ার্নিং সিস্টেম'। এর মাধ্যমে বিশেষ সফটওয়্যার 'ইকোসিস্টেম' তৈরি করা হয়, যেখানে ছবি এবং ভিডিওগুলো এমনভাবে তোলা, সংরক্ষণ এবং প্রেরণ করা হয়, যেখানে ছবির কোনো পরিবর্তন হলেই দর্শকদেরকে সে ব্যাপারে সতর্ক করবে।
মেটাডাটা থেকে হ্যাশ
লন্ডনভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থা 'আইউইটনেস টু অ্যাট্রোসিটিস' এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। তাদের অ্যাপটি দুটি কাজ করে। প্রথমত, যখন অ্যাপটি ইন্সটলড থাকা ফোনের মাধ্যমে কোনো ছবি বা ভিডিও তোলা হয়, তখন এটি সেটির সময় এবং অবস্থান রেকর্ড করে রাখে, যেমন জিপিএস স্যাটেলাইট, কাছাকাছি মোবাইল-ফোন টাওয়ার এবং ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক। এটিকে কন্ট্রোল্ড ক্যাপচার অফ মেটাডাটা বলা হয় এবং মোবাইল থেকে সরাসরি মেটাডাটা সংগ্রহের চেয়ে এই পদ্ধতি বেশি নিরাপদ। কারণ ফোনের সময় এবং অবস্থান পরিবর্তন করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, অ্যাপটি ছবিটির সম্পূর্ণ ডিজিটাল সিকোয়েন্স (০ এবং ১ দিয়ে তৈরি কোড) পড়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করে সেই ছবির জন্য অনন্য একটি আলফানিউমেরিক মান বের করে, যা হ্যাশ নামে পরিচিত। এই দুই ধাপ শেষ করার পর, তারা মেটাডেটা এবং হ্যাশকে একটি ফাইলে রাখে, যাকে বলা হয় প্রুফ বান্ডেল। এটি ইমেজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ফাইল হিসেবে একটি বিশেষ সার্ভারে এনক্রিপ্ট করা ছবি এবং এর প্রুফ বান্ডেলটি সংরক্ষণ করে রাখে।
আইউইটনেস টু অ্যাট্রোসিটিসের পরিচালক ওয়েন্ডি বেটস এই সার্ভারকে একটি ডিজিটাল প্রুফ লকার হিসাবে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। যদি কোনো ইমেজের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন হয়, তবে এর ডিজিটাল সিকোয়েন্স পুনরায় স্ক্যান করে, এর হ্যাশ পুনরায় গণনা করে তার সাথে ছবির হ্যাশ মেলানো হবে। যদি ছবির একটি পিক্সেলও পরিবর্তন করা হয়, তবে মূল ছবির হ্যাশের সাথে পরবর্তী ছবির হ্যাশ মিলবে না। যদি মিলে যায়, তবে বোঝা যাবে, ছবিটি স্পর্শ করা হয়নি।
একটি অতিরিক্ত সার্ভিস হিসেবে প্রায় ৮০ জন আইনজীবী প্রত্যেকে সপ্তাহে কয়েক ঘন্টা বিনা বেতনে দাতব্য সংস্থার জন্য কাজ করে থাকেন, যেখানে তারা অ্যাপে পাঠানো ছবিগুলো পর্যালোচনা করেন। ইউরোপোল, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং ইউক্রেনের প্রসিকিউটর-জেনারেল অফিসসহ বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের কাজে সাহায্যের জন্য তারা এ কাজ করে থাকেন।
প্রসিকিউটর-জেনারেল অ্যান্ড্রি কোস্টিন স্বয়ং আইউইটনেসের এই ব্যবস্থার একজন ভক্ত। কারণ এর ফলে যে আদালতের সত্যতা প্রমাণ হচ্ছে, তা-ই নয়। একইসাথে সাক্ষীদের ছবি তুলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়টিও থাকবে না।
সংযোগ তৈরি
ইউক্রেনের যে এলাকাগুলো রাশিয়ার দখলে, সেখানে ছবি তোলা একটি মারাত্মক ঝুঁকি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সৈন্যরা যদি কোনো চেকপয়েন্ট তৈরি করে যেখানে ব্যক্তির মোবাইল চেক করা হবে, এবং যদি কোনোভাবে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ ভিডিও বা ছবি তুলে রেখেছে সেরকম কিছু সৈন্যদের কাছে ধরা পড়ে যায়, তার পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে। এর সম্ভাবনা কমানোর জন্য অ্যাপের আইকনটি এমনভাবে তৈরি যেটি এর আসল উদ্দেশ্য বোঝায় না। তারপরেও যদি কোনো অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা যদি এর পাসওয়ার্ড ভুল করে, তবে এটি ফোনের সাধারণ ফটো গ্যালারি খুলে দেখাবে। কিয়েভের মানবাধিকার সংস্থা ট্রুথ হাউন্ডসের প্রধান তদন্তকারী মেরিনা স্লোবোদিয়ানিউক জানান, যদি কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ধরাও পড়ে যান, তারপরেও সেই ছবিতে কেউ অ্যাকসেস করতে পারবে না,
আইউইটনেস সিস্টেমের প্রথম সংস্করণ ২০১৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, তাই এর বাগগুলো এর মধ্যবর্তী সময়েই দূর করা গিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর এই অ্যাপ ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে। আইউইটনেসের পরিচালক বেটস জানান, ২০২২ সালে ৪০ হাজার ছবি তারা তদন্তের জন্য পেয়েছেন, যার ২৭ হাজারই এসেছে ইউক্রেন থেকে।
পুলিশ অফিসার এবং সাংবাদিকদের মধ্যে এই অ্যাপ বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। কিয়েভকেন্দ্রিক ইউক্রেনের একটি থিংকট্যাঙ্ক সংস্থা ইউক্রেনীয় হেলথ কেয়ার সেন্টারের বিশ্লেষকরাও তাই মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটির ওপর হামলার প্রমাণ সংগ্রহ করতে অ্যাপটিকে ব্যবহার করছেন।
তবে আইউইটনেসই গ্লাস টু গ্লাস সার্ভিস প্রদানকারী একমাত্র সংস্থা নয়। নিউ ইয়র্কের দ্য গার্ডিয়ান প্রজেক্ট নামের একটি সংস্থা প্রুফমোড নামের একটি স্মার্টফোন অ্যাপ তৈরি করেছে। আই উইটনেসের মতো প্রুফমোডও কন্ট্রোল্ড-ক্যাপচার মেটাডেটা এবং ইমেজের হ্যাশকে প্রুফ বান্ডেল হিসেবে সংগ্রহ করে। তবে নিজেদের সার্ভার হিসেবে পরিচালনা করার পরিবর্তে প্রুফমোড গুগলের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সার্ভারকে ব্যবহার করে। এই প্রমাণগুলোকে তালিকা হিসেবে রেকর্ড করে রাখা হয়। প্রুফমোডের মাধ্যমে তোলা ছবিগুলো দর্শকরা গার্ডিয়ান প্রজেক্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করতে পারে, যা এর হ্যাশ পুনরায় গণনা করে। যদি মিল খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে ছবিকে নকল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
শীঘ্রই সিংক্রনি নামে গার্ডিয়ান প্রজেক্ট নতুন একটি ফিচার যোগ করতে যাচ্ছে। এটি ছবি তোলার সময় সে জায়গার অবস্থান অবস্থান এবং সময়কে রেকর্ড করে, ওপেনস্ট্রিট ম্যাপ নামের একটি জিওগ্রাফিক রেকর্ড রাখা অ্যাপের তথ্যের সাথে মেলাবে, যেখানে ঐ অঞ্চলের আবহাওয়ার রেকর্ডও থাকবে। এর মাধ্যমে ছবি তোলার স্থান এবং সময়ের সাথে বাস্তব আবহাওয়ার অসঙ্গতি পরীক্ষা করা হবে। যদি কেউ দাবি করে সে জায়গায় সেই সময়ে ছবিটি তোলা হয়েছে, তবে স্থানীয় ল্যান্ডস্কেপ এবং সেদিনের আবহাওয়ার অবস্থার সাথে দাবির যথার্থতা পরীক্ষা করতে সাহায্য করবে এটি। গার্ডিয়ান প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা নাথান ফ্রেইটাস জানান, এর মূল আইডিয়া হলো 'ছবিগুলোকে বাস্তব জগতের সাথে মিলিয়ে দেখা বা সিঙ্ক করা'। বিক্ষোভ-আন্দোলনের বিষয়গুলো নিয়ে আগামীতে কাজ করতে চান তিনি।
ট্রুপিক নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কিছুটা বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে এগিয়েছে। দাতব্য সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে কোনো অর্থ খরচ না করতে হলেও, যে প্রতিষ্ঠানগুলো সাপ্লাই চেইন, কন্সট্রাকশন সাইটের অগ্রগতিসহ অন্যান্য বিষয়ের ওপর নজর রাখতে এই অ্যাপটিকে ব্যবহার করে তাদেরকে অবশ্যই পয়সা খরচ করতে হবে।
ট্রুপিক স্মার্টফোন স্ক্যান করে দেখে যে মোবাইলটিতে ছবি বা ভিডিওর মেটাডাটা পরিবর্তন করার মতো কোনো প্রোগ্রাম রয়েছে কিনা। ট্রুপিকের পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের প্রধান মুনির ইব্রাহিম, যিনি একসময় আমেরিকার কূটনৈতিক কর্পস-এর সদস্য হিসেবে নকল ফটোগ্রাফ ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্রস্থল দামাস্কাসে কাজ করেছেন, অ্যাপটি কীভাবে কাজ করে সেটি সম্পর্কে জানান। তার মতে, ছবির সবগুলো পিক্সেল একেবারেই একটি ফ্লাট সার্ফেসে রয়েছে মনে হলে ছবিটি নকল কিনা তা বোঝা যায়।
২০২১ সালে অ্যাডোবি, বিবিসি, ইন্টেল এবং মাইক্রসফটের সাথে কন্টেন্ট প্রোভেন্যান্স অ্যান্ড অথেনটিসিটি (সিটুপিএ) নামের একটি জোটে যোগ দিয়েছে ট্রুপিক, যাদের লক্ষ্য হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার নির্মাতাদের জন্য ছবির সত্যতা প্রমাণের প্রযুক্তিগুলোর জন্য একটি মানদণ্ড তৈরি করা। এর ফলে আলাদা আলাদা অ্যাপে বারবার পরিবর্তন করতে হবে না। বরং ছবির মেটাডাটা, হ্যাশ সংরক্ষণ ও এ ধরনের সব প্রযুক্তি একসাথে করা সম্ভব হবে। এবং এই প্রযুক্তি কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকবে না, বিনামূল্যেও অ্যাকসেস করা যাবে সেই সুবিধাটি।
যদি সিটুপিএ-এর কাজ সবজায়গায় কার্যকর করা যায়, তবে ওয়েব ব্রাউজারগুলো নিজেরাই হ্যাশ পরীক্ষা করে ছবি আসল না নকল তা দেখাতে পারবে। একইসাথে, হ্যাশগুলোকে ব্লকচেইনেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক স্টারলিং ল্যাব এ ধরনের একটি সিস্টেম নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে।
তবে এর ফলে একেবারেই বাধা যে নেই তা নয় বলেও জানিয়েছে স্টারলিং ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জোনাথন ডোটান। এই প্রযুক্তির ফলে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ছবি কে তুলেছে সে ডিভাইস সম্পর্কে জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার ফলে কে ছবি তুলেছে তাও জেনে যেতে পারে । তিনি জানান, গবেষকদেরকে খুঁজে বের করতে হবে, কীভাবে এই ট্রেসিং সিস্টেমকে অসম্ভব করে তোলা যায়। স্বচ্ছতা থাকা ভালো, কিন্তু একেবারেই খোলামেলা থাকা, অনেকসময় ভালো জিনিসের জন্যেও বেশি হয়ে যেতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট