কিম জং-ইল: উ. কোরিয়ার সিনেমাপোকা স্বৈরশাসকের চলচ্চিত্র অভিযান
টম ক্রুজের গায়ে কাঁটা দেওয়া স্টান্টগুলো দেখে অনেকে হয়তো বিজ্ঞের মতো মাথা ঝেঁকে বলে ওঠেন, 'এ ব্যাটা একদিন না একদিন মারা পড়বে।' সিনেমার স্টান্টম্যানদের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ, এসব করতে গিয়ে অনেক সময় তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। শ্যুটিংয়ের সময় স্টান্ট-পার্সনদের মারা যাওয়ার নজিরও অনেক আছে। আবার অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার জেরেও সিনেমা নির্মাণকালে অনেকে মারা যান। রাস্ট সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের হাতে থাকা বন্দুকের গুলি বেরিয়ে ইউক্রেনীয় সিনেমাটোগ্রাফার হ্যালিনা হাচিন্সের মৃত্যু গতবছর বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সিনেমার কলাকুশলীদের কাছে বিপদটা একটু ভিন্ন ছিল। স্বৈরশাসকের অধীনে থাকা এ দেশটিতে একসময় সিনেমাশিল্প বেশ রমরমা ছিল। আর সেগুলো যারা তৈরি করতেন, তার জানতেন বড়কর্তাদের পছন্দ না হলে তাদের গর্দানও যেতে পারে। তাই, তাদেরকে সিনেমা বানানোর মতো আনন্দের একটি কাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই করতে হতো।
উত্তর কোরিয়ার সিনেমাশিল্পের পেছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন দেশটির তখনকার স্বৈরশাসক ও সুপ্রিম লিডার কিম জং-ইল। সিনেমা নিয়ে ভদ্রলোকের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। তাই দেশে সিনেমা বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন তিনি। সেজন্য প্রতিবেশি দেশ থেকে পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীকে অপহরণ করে নিয়ে আসতেও দ্বিধা করেননি তিনি।
সুপ্রিম লিডার হিসেবে কিম জং-ইল উত্তর কোরিয়া শাসন করেন ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। অবশ্য ১৯৯৪ সাল থেকেই দেশটির ডে-ফ্যাক্টো নেতা ছিলেন তিনি। ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে আরোহণের আগে তিনি ১৯৭৩ সালে দলের সচিব হিসেবে অর্গানাইজেশন, প্রোপাগান্ডা, ও অ্যাজিটেশন-এর দায়িত্ব পালন করেন।
উত্তর কোরিয়ায় শিল্প-সাহিত্য করার সুযোগ কম, তাই এখানকার নাগরিকদের তাদের সৃজনশীলতার চর্চারও বিশেষ উপায় নেই। এজন্য ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে সিনেমা বানানোর জন্য জং-ইল পর্যাপ্ত তহবিলের ব্যবস্থা রাখলেও উত্তর কোরীয় নির্মাতারা তাদের কাজ দিয়ে তার মন জয় করতে পারেননি।
তখন কিম জং-ইল এক অবাক কাণ্ড করে বসেন। তিনি আদেশ করেন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পরিচালক ধরে আনতে। এজন্যই ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক শিন স্যাং-ওক ও তার তৎকালীন স্ত্রী, অভিনেত্রী চোই ইয়ুন-হিকে অপহরণ করে উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে আসা হয়। শিনকে বাধ্য করা হয় দেশটির হয়ে সিনেমা বানাতে।
শেষ পর্যন্ত শিন নিজের দক্ষতায় ভালো বিনোদনধর্মী বেশকিছু সিনেমা তৈরি করেন। অবশ্য এসব সিনেমার মূল লক্ষ্যই ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষে প্রোপাগান্ডা প্রচার করা। তার জনপ্রিয় কয়েকটি সিনেমার তালিকায় আছে রানঅ্যাওয়ে, ও পালগাসারি। প্রথমটি পুরোদস্তুর অ্যাকশন ফিল্ম, পরেরটি জাপানের গডজিলা থেকে অনুপ্রাণিত।
১৯৮৬ সালে ভিয়েনায় একটি ব্যবসায়িক সফরের সময় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন শিন ও চোই দম্পতি। তাদের অপহৃত হওয়ার এ ঘটনা নিয়ে ২০১৬ সালে দ্য লাভার্স অ্যান্ড দ্য ডেসপট নামক একটি ব্রিটিশ ডকুমেন্টারি ফিল্ম মুক্তি পায়।
প্রোপাগান্ডা সিনেমায় শক্তিশালী আ্যান্টাগনিস্ট থাকা দরকার। এ জন্য উত্তর কোরিয়া বেছে নিয়েছিল আমেরিকা ও জাপানকে। কিন্তু এগুলোর জন্য তো ওসব দেশের অভিনেতার দরকার। তাই উত্তর কোরিয়ায় বাস করা মার্কিন ও জাপানি নাগরিকদের ভিলেন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বলত স্বৈরাচারী সরকার।
এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করাটা যে বোকামি হবে, তা সবাই জানত। এজন্য জোর করে অভিনয় করানো এসব শখের অভিনেতারা খুবই কাঁচা অভিনয় করতেন সিনেমাগুলোতে। দেশটির সিনেমায় অভিনয় করা কয়েকজন সুপরিচিত মার্কিন অভিনেতা হলেন চার্লস জেনকিন্স, ল্যারি অ্যাবশিয়ার, জেরি পারিশ ও জেমস ড্রেসনক প্রমুখ।
অভিনেতারা যেমন কতকটা বাধ্য হয়ে সিনেমায় নামতেন, তেমনি উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষদেরও সিনেমাগুলো না দেখে উপায় ছিল না। দেশটির যেসব গ্রামে সিনেমাহল ছিল না, সেগুলোতে কারখানা ও দলীয় কার্যালয়ে পর্দা বসিয়ে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করা হতো।
সিনেমা দেখে চুপচাপ বাড়ি ফেরারও উপায় ছিল না। হলে সিনেমা চলার সময় উপস্থিত থাকত সরকারি লোকজন। দেখা শেষ হওয়ার পর দর্শকদেরকে এ কর্তৃপক্ষের কাছে সিনেমা নিয়ে তাদের অনুভূতি ও মূল্যায়ন জানাতে হতো। অবশ্য এসব সত্ত্বেও ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে উত্তর কোরিয়ানদের বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল এ সিনেমাগুলো।
দ্য লাভার্স অ্যান্ড দ্য ডেসপট ডকুমেন্টারিতে দেখানো তথ্য অনুযায়ী, কিম ভেবেছিলেন তার দেশের মানুষেরা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন থাকায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ডকুফিল্মটিতে দক্ষিণ কোরিয়ান দম্পতির গোপনে ধারণ করা কিম জং-ইলের বক্তৃতার একটি টেপ প্রকাশ করা হয়।
ওই টেপে কিম জং-ইলকে বিক্ষুব্ধচিত্তে বলতে শোনা যায়, 'আমাদের ফিল্মগুলো বেশ নীরস! সবগুলো ফিল্ম কেন একই আদর্শগত গল্পের ওপর দাঁড় করে গড়ে উঠবে? এগুলোতে এত কান্নার দৃশ্য কেন?'
উত্তর কোরিয়ায় এখনো বিদেশি চলচ্চিত্র প্রবেশের অনুমতি নেই। এ ধরনের সিনেমা দেখা দেশটির নাগরিকদের জন্য অবৈধ। তা সত্ত্বেও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশি চলচ্চিত্র সংগ্রহ করেন। তবে এ নিয়ম খাটেনি কিম জং-ইলের ক্ষেত্রে। তরুণ বয়সে এ স্বৈরশাসক ১৫,০০০-এর বেশি সিনেমা সংগ্রহ করেছিলেন।
তার প্রিয় সিনেমার তালিকায় ছিল জেমস বন্ড আর র্যাম্বোর মতো হলিউড সিনেমা। পছন্দের তারকারাও ছিলেন পশ্চিমা। উত্তর কোরিয়ার চলচ্চিত্র তত্ত্ব নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন কিম জং-ইল। নিজে সিনেমা পরিচালনার কাজেও হাত দিয়েছিলেন তিনি।
জং-ইলের বইয়ের নাম ছিল অন আর্ট অ্যান্ড দ্য সিনেমা। তার স্বৈরশাসক বাবা কিম ইল-সাং সিনেমাকে দেখতেন স্রেফ প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু জং-ইল প্রোপাগান্ডা টুলের পাশাপাশি সিনেমাকে একটি শৈল্পিক মাধ্যম হিসেবেও দেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অনুধাবন করেন, সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে এ দুটোকে একসুতোয় গাঁথা সম্ভব নয়।
এজন্যই জং-ইলের বানানো সিনেমাগুলো হলিউডের সিনেমার ধারেকাছেও হয়নি। আর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পরিচালক তুলে আনার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ ছিল। শিন স্যাং-ওককে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, এমন একটা ফিল্ম বানাতে হবে যা কোনো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রবেশ করবে এবং পুরষ্কার জেতার দৌড়ে যথেষ্ট এগিয়ে থাকবে।
ম্যানিপুলেশন ছিল কিম জং-ইলের সিনেমা দর্শনের আরেকটি বড় দিক। কং ড্যান ওহ তার থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস বইয়ে উত্তর কোরিয়ায় ডিফেক্ট করা একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই ডিফেক্টরের ভাষ্যমতে, উত্তর কোরিয়ার প্রপোগান্ডায় ভরপুর সিনেমা দেখে আবেগে তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। কিন্তু পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরত যাওয়ার পর তিনি যখন সিনেমাটি আবার দেখেন, তখন সেটি তার কাছে মোটাদাগে অর্থহীন মনে হয়েছিল।
সিনেমাশিল্পকে কিম এত তুখোড় ব্যবস্থাপনার মধ্যে রেখেছিলেন যে, সেটা আর্ট ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা দেশটির সাবেক একজন তারকা কিম হাই ইয়াং জানান, 'একজন অভিনেত্রী হিসেবে তারা আপনাকে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস জোর করে পরাত, আবার অনেক কিছুই পরতে দিত না।'
আর দশজনের মতোই অ্যাকশন, যৌনতা, ভয় ইত্যাদি ধাঁচের সিনেমা পছন্দ করতেন কিম জং-ইল। তার শাসানামালেই উত্তর কোরিয়ায় প্রথম পশ্চিমা সিনেমা হিসেবে বেন্ড ইট লাইক বেকহাম কিছুটা সম্পাদনা করে ২০০৪ সালে পিয়ংইয়ং ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রায় ১২,০০০ লোকের সামনে দেখানো হয়।
তথ্যসূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, বিগ থিংক, বিবিসি