পরিত্যক্ত ট্রেন স্টেশন যেভাবে হয়ে গেল জমকালো এক হোটেল!
তুষারঢাকা পিরেনিজ পর্বতকে পেছনে রেখে আরাগন উপত্যকার ভেতরে দেখা যাবে অসাধারণ এক সুন্দর ভবন। ক্যানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনে সবাইকে স্বাগতম। একসময়ের পরিত্যক্ত ট্রেন স্টেশন এখন রূপ নিয়েছে এক বিলাসবহুল হোটেলে।
দক্ষিণ ইউরোপের রেল যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্টেশনটি ১৯২৮ সালে উদ্বোধন করতে হাজির হয়েছিলেন স্পেনের রাজা এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট দুজনেই। স্পেনের সীমানার ভেতরে হলেও স্টেশনটি ফ্রান্স সীমান্ত থেকেও খুব বেশি দূরে নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্যানফ্রাঙ্ক স্টেশনের নামের সাথে গুপ্তচরবৃত্তি, সোনা চোরাচালান আর পলাতক গ্রেপ্তারের ছাপ লেগে যায়। ১৯৭০ সালের মধ্যে স্টেশনটির দরজা বন্ধ হয়ে যায় সাধারণ যাত্রীদের জন্য।
কয়েক দশক ধরে এভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল স্টেশনটি। অবশেষে স্টেশনটির দায়িত্ব নেয় বারসেলো হোটেল গ্রুপ। কয়েক বছর ধরে সংস্কার করার পর এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো অতিথি বরণ করে নেয় হোটেলটি।
রেলওয়ে আর ইতিহাস নিয়ে আগ্রহীদের বাকেট লিস্টে গন্তব্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে এই স্টেশনটি।
ক্যানফ্রাঙ্ক শহরের মেয়র ফার্নান্দো সানচেজ মোরালেস জানান, "আমরা খুবই খুশি যে স্টেশনটি আবার বেঁচে উঠেছে, আবারো আলোকিত হয়ে উঠেছে।"
নতুন অধ্যায়
পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপ হলেও ক্যানফ্রাঙ্ক কখনোই ফাঁকা থাকেনি। স্প্যানিশ স্থপতি ফার্নান্দো রামিরেজ দ্যু দাম্পিয়েরের ডিজাইন করা ইউরোপের রেল ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্টেশনটির ছবি তুলতে ফটোগ্রাফাররা ভিড় জমিয়েছে নিয়মিত।
যারা পরিত্যক্ত ভবনে সৌন্দর্য খুঁজে পান, তাদের কাছে হোটেলের বর্তমান অবস্থাকে খুব একটা আকর্ষণীয় মনে না হলেও হোটেলটি ইতিমধ্যেই অতিথিদের দৃষ্টি কেড়েছে।
স্থপতি থমাস ও'হেয়ার হঠাৎ করেই দুর্ঘটনাক্রমে দুই বছর আগে ক্যানফ্রাঙ্ক স্টেশনের খোঁজ পান। যখন তিনি জানতে পারেন যে, স্টেশনটি অচিরেই হোটেলে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি এর কাজ শেষ হওয়ামাত্রই অতিথি হিসেবে ফিরবেন।
বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে বাস করা ও'হেয়ার তার পরিবারের সাথে হোটেলটিতে ছুটি কাটাচ্ছেন। "এর বাহ্যিক গঠন অত্যন্ত জমকালো। একে দেখে মনে হয় ভিন্ন কোনো সময়ে চলে এসেছি।"
ও'হেয়ার তার পরিবারের সাথে হোটেলের পাশেই থাকা স্পেনের অন্যতম প্রাচীন স্কি রিসোর্ট কানদাঞ্চুতে স্কি করে সময় কাটাচ্ছেন।
টালামাটাল ইতিহাস
স্পেন এবং ফ্রান্সের সীমান্তে থাকার কারণে ক্যানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের মালিকানা দুই দেশেরই ছিল। তবে বর্তমানে এটি স্পেনের আরাগন প্রদেশের সরকারের অধীনে রয়েছে, যারা বারসেলো হোটেল গ্রুপের সাথে স্টেশনটিকে হোটেলে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্টেশনটির সক্রিয় ভূমিকা ছিল, যেটি একইসাথে আশা এবং হতাশার জন্ম দিয়েছিল।
নাৎসিরা স্টেশনটি দখল করার আগে তাদের হাত থেকে পালানো অনেক ইহুদিই এই স্টেশনের সাহায্যে মুক্তি পেয়েছিলেন। স্টেশনটির ইতিহাস নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক র্যামন হাভিয়ের ক্যাম্পো ফ্রেইলে জানান, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম কয়েক বছরে, ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত হাজার হাজার ইহুদি ক্যানফ্র্যাঙ্ক স্টেশন হয়ে লিসবন এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।"
এই পালিয়ে যাওয়া ইহুদিদের মধ্যে ছিলেন চিত্রকর ম্যাক্স আর্নস্ট এবং মার্ক শাগাল। মার্কিন অভিনেত্রী জোসেফিন বেকারও এই স্টেশনে পা রেখেছিলেন।
গুপ্তচররাও ক্যানফ্রাঙ্ক স্টেশন হয়ে নাৎসিবিরোধী ফ্রেঞ্চ রেজিজট্যান্স দলে যোগ দিতেন। মিত্রবাহিনীর কাছে বিভিন্ন সংবাদ পাচার করার কাজেও এই স্টেশনকে ব্যবহার করা হতো। মেয়র সানচেজ মোরালেস জানান, "গুপ্তচরদের এক নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে ফ্রান্স এবং স্পেনে বিভিন্ন তথ্য পাচার করার অন্যতম মূল পথ ছিল স্টেশনটি।"
তবে নাৎসিরা ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে স্টেশনটি দখল করে নেয়, যেটিকে তারা ১৯৪৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। নাৎসিদের হাতে যাওয়ার পর ক্যানফ্র্যাঙ্ক হয়ে পালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে এবং নাৎসিদের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করা অনেককেই এখানে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্যানফ্র্যাঙ্ক ছিল নাৎসিদের দখলে থাকা একমাত্র স্প্যানিশ অঞ্চল। সাংবাদিক র্যামন জানান যে ৩০০ জনেরও বেশি পলাতক লিসবনের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাওয়ার সময় এখানে গ্রেপ্তার হন এবং তাদেরকে স্পেনের বিভিন্ন জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নাৎসিরা এই স্টেশনের মাধ্যমে 'নাৎসি গোল্ড' পাচার করেছে বলেও বহুদিন ধরে গুজব ছিল। অবশেষে ২০০০ সালে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। র্যামনের মতে, এক স্থানীয় বাস ড্রাইভার বেশ কিছু সূত্র খুঁজে পান, যেটি প্রমাণ করে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে নাৎসিরা এই স্টেশনের মাধ্যমে ৮৬ টন সোনা পাচার করেছে। তিনি জানান, "ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে পাওয়া ডকুমেন্ট থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে ১০০ টনেরও বেশি সোনা এই স্টেশনের মাধ্যমে পাচার হয়েছিল।"
সতর্ক সংস্কার
ক্যানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের এই নতুন সংস্কার অবশ্য স্টেশনের পুরনো ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চায় না, বরং আরও সুন্দরভাবে এর ইতিহাসকে সংরক্ষণের উদ্যোগ হিসেবেই এই স্টেশনকে সংস্কার করা হয়েছে। ক্যানফ্র্যাঙ্ক হোটেল ম্যানেজার মারিয়া বেলোস্তা জানান, সংস্কারের সময় 'প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া হয়েছে'।
এর ঐতিহ্য ও বিশালতা রক্ষা খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি। একইসাথে যোগ করেন, 'এর এই বিশাল ঐতিহ্য রক্ষার সাথে বিশাল চ্যালেঞ্জও চলে আসে'।
১৯২৮ সালে তৈরি এই ভবনকে এর ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে কোনোভাবেই নষ্ট যাতে না হয় সেভাবেই এর সংস্কার কাজ চালানো হয়, একইসাথে বিলাসবহুল হোটেলের স্ট্যান্ডার্ড ও বিলাসিতাও ধরে রাখা হয়।
"আমরা এর ডিএনএ ধরে রাখতে চেয়েছি, এর আন্তর্জাতিক রেলওয়ের চেতনাটি ধরে রাখতে চেয়েছি," বলে জানান বেলোস্তা।
হোটেলটির ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছে মাদ্রিদভিত্তিক ডিজাইন স্টুডিও ইলমিওডিজাইন। তাদের লক্ষ্য হোটেলের কাপড়, ডেকোরেশন থেকে শুরু করে স্টাফদের ইউনিফর্ম পর্যন্ত সবকিছুতে ১৯২০-এর দশকের ডিজাইন ফিরিয়ে আনা। বেলোস্তা একে অভিহিত করেছেন, 'ক্যানফ্র্যাঙ্কের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ঐতিহ্য হিসেবে।'
হোটেলের রঙেও প্রাকৃতিক একটি ভাব ফুটে উঠেছে, যা হোটেলটির চারপাশে থাকা পার্বত্য পরিবেশের সাথে মানানসই।
হোটেলটিতে ১০৪টি রুম রয়েছে, যার মধ্যে ৪টি স্যুইটও অন্তর্ভুক্ত। একটি পুল এবং তিনটি রেস্তোরাঁও রয়েছে এখানে। রেলওয়ে স্টেশনটির যেখানে জনমানুষ জমায়েত হতো, ঠিক সে জায়গাটিকেই হোটেলের রিসেপশন বানানো হয়েছে।
হোটেলের অতিথি থমাস ও'হেয়ার স্টেশনের কনকোর্সটিকে হোটেলের রিসেপশনে রূপান্তর করার বিষয়টিকে বেশ প্রশংশা করেছেন। তিনি বলেন, "রুম আর রেস্তোরাঁগুলোতে আধুনিক ডিজাইনের সাথে এর রেলওয়ের ইতিহাস অনুভব করা যায়।"
তার একমাত্র অভিযোগ: হোটেলের পুল ব্যবহার করার জন্য অতিথিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১৫ ইউরো টাকা নেওয়া। ক্যানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের ইতিহাসকে যদি ডিসপ্লে করা যায়, তবে এটা আরও সুন্দর হতো বলে পরামর্শ দেন তিনি। তবে হোটেলের স্টাফরা এ বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শী বলেও জানান তিনি।
নতুন অধ্যায়
যখন ক্যানফ্র্যাঙ্ক ধ্বংসস্তূপ ছিল, তখন ফটোগ্রাফারদের স্বর্গ ছিল স্টেশনটি। বেলোস্তা জানান সংস্কারের পর এই অসাধারণ সংস্কারকে তাদের ফটোগ্রাফের মাধ্যমে কেবল অমর করেই রাখতে পারবে না, সাথে 'ভালো খাবার'ও উপভোগ করতে পারবে তারা।
মেয়র জানান যে তিনি খুবই খুশি যে কীভাবে হোটেলের সাথে সাথে স্টেশনটির ইতিহাস এবং রেলওয়ের পরিবেশটি অক্ষত রাখা হয়েছে। তিনি জানান, "আমরা আশা করি যে এই সংস্কার ক্যানফ্রাঙ্ককে একটি পর্যটন স্থান হিসেবে দৃঢ় করবে।"
সূত্র: সিএনএন