আমদানি জটিলতায় জর্জরিত দেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলো
বিদেশিসহ অন্যান্য অতিথিদের পরিষেবার মান নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলো। আমদানি-নির্ভর পণ্য যেমন, খাদ্য পণ্য, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় এবং রুম অ্যামেনিটির অভাবে পরিষেবার যথাযথ মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরকারি বিধিনিষেধ এবং ডলার সংকটের ফলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
যেমন, বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ পেতে হোটেল মালিকদের কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময় লাগে, কারণ পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য একাধিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে অবকাশকালীন পর্যটকের উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে একটি কারণ হিসেবে এ জটিলতাকে দায়ী করেছে খাত সংশ্লিষ্টরা। এ দেশে বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে আসা ৭০%ই বিদেশি অতিথি, যারা মূলত ভ্রমণকারী ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, হোটেগুলোতে পরিষেবা সম্পর্কিত প্রায় ১০০০-১২০০ ধরনের পণ্য ব্যবহার করা হয়; এ পণ্যগুলোর ৫০-৬০% আমদানি নির্ভর।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত ৪৬টি তারকা হোটেল রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই এসব পণ্যের জন্য তৃতীয় পক্ষের সরবরাহকারী এবং আমদানিকারকদের উপর নির্ভরশীল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এলসি খোলা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠায় এ পণ্যগুলো সরবরাহেও জটিলতা দেখা দিয়েছে।
রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত গোল্ডেন টিউলিপ-দ্য গ্র্যান্ডমার্ক নামক একটি ৪ তারকা হোটেলের খাদ্য ও পানীয় হিসেবে প্রায় ১৬৫টি পণ্য ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে মাত্র ১১টি (যা মাত্র ৭%) পণ্য আসে স্থানীয় উৎস থেকে, বাকিগুলো আমদানি-নির্ভর।
হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালেদ উর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ প্রক্রিয়া এতই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ যে আমরা নিজেরাই খাদ্য বা অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে সাহস পাই না। এলসি খোলা, বিএসটিআই সিল পাওয়া এবং সর্বোপরি উচ্চমানের খরচের কারণে আমরা নিজেরা আমদানি না করে এসব পণ্য তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে কিনি।"
অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুসারে, দেশের হোটেলগুলো তাদের প্রয়োজনীয় মোট অ্যালকোহলের ৪০% পর্যটন কর্পোরেশনের শুল্ক-মুক্ত দোকান থেকে বা আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারে, বাকি ৬০% অবশ্যই দেশীয়ভাবে উৎপাদিত উৎস থেকে শুল্ক ও কর মিটিয়ে কিনতে হবে।
বেশিরভাগ হোটেলই পর্যটন কর্পোরেশন থেকে মদ সংগ্রহ করে, কারণ এটি নিজেরা আমদানি করার চেয়ে তুলনামূলকভাবে সহজ।
তবে এক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের পূর্বানুমতি প্রয়োজন, যা কমপক্ষে ছয় মাসব্যাপী দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া।
চট্টগ্রামের একটি চার তারকা হোটেল গত বছরের মে মাসে কর্পোরেশন থেকে মদের চালানের জন্য আবেদন করে এবং চলতি বছরের জুন মাসে তারা সে চালান পেয়েছে বলে জানায় কর্মকর্তারা।
ঢাকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক রাজীব মিনা টিবিএসকে বলেন, "বিদেশি মদের জন্য একটি হোটেলের আবেদন একাধিক পর্যায়ে তদন্ত করা হয়। অধিদপ্তরের জেলা পর্যায় থেকে তা আমাদের বিভাগীয় পর্যায়ে আসে। বিভাগ থেকে, আমরা সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে হেড অফিসে পাঠাই। তাই আমাদের এখানে প্রক্রিয়ায় কোনো বিলম্ব নেই।"
"এ তদন্ত একটি চেকলিস্টের ভিত্তিতে করা হয় যেখানে সমস্ত প্রাসঙ্গিক নথি যাচাই করা হয়। যদি একটি হোটেলের অনুমোদন পেতে বিলম্ব হয়, তাহলে হয়তো তাদের কোনোকিছুতে সমস্যা আছে," বলেন এ বিভাগের অন্য একজন কর্মকর্তা।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে অবস্থিত একটি তারকা হোটেলের পরিচালক টিবিএসকে বলেন, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া পেতে হোটেলটির ম্যানেজমেন্টকে এক বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
"আবেদনের অনেকদিন পর পর্যটন কর্পোরেশন আমাকে জানায়, আমাদের চাহিদা অনুযায়ী পছন্দসই ব্র্যান্ডটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। পরে আমি যে দাম দিয়ে আবেদন করেছিলাম, তারচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। এতে ট্যাক্স বৃদ্ধির অজুহাতে কর্পোরেশন আমাদের অতিরিক্ত চার্জ করেছে," বলেন তিনি।
পর্যটন কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার (শুল্কমুক্ত অপারেশন) মোহাম্মদ শফিউজ্জামান ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, "আমাদের প্রক্রিয়ায় কোনো বিলম্ব নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অনুমোদন দিলে গুদামে প্রাপ্যতার সাপেক্ষে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে হোটেলগুলোতে মদ হস্তান্তর করি।"
পর্যটন কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সাধারণত প্রতি বছর অনুরোধকৃত পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণে আমদানি অনুমোদন করে। এর ফলে কর্পোরেশন পর্যাপ্তভাবে চাহিদা মেটাতে পারে না।
২০২১-২২ অর্থবছরে, পর্যটন কর্পোরেশন ৭,০০,০০০ ডলার মূল্যের মদ এবং বিয়ার আমদানি করেছে, যা আগের বছর ছিল ১.১ বিলিয়ন ডলার।
আতিথেয়তা খাতকে যেভাবে প্রভাবিত করছে ডলার সংকট
এলসি খোলার জটিলতার কারণে আমদানিকারকরা আতিথেয়তা (হসপিটালিটি) খাতে প্রত্যাশিত পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না।
অ্যালিয়ন ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. পারভেজ ভূঁইয়া বলেন, "হোটেলে দুধ, সস এবং তেলের মতো বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করি আমি। বর্তমানে সরকার ঘন ঘন ট্যাক্স পরিবর্তন করে, একইসাথে বিলাসবহুল পণ্য আমদানিও সীমাবদ্ধ রাখে। আমি আগে প্রতি মাসে ৬-৭টি এলসি খুলতে পারলেও এখন এলসি খুলতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আমদানি করতে না পারায় চাহিদা অনুযায়ী হোটেলগুলোতে পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না।"
পাঁচ তারকা হোটেলের একজন ম্যানেজার বলেন, সম্প্রতি পচনশীল পণ্য নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ খাদ্যসামগ্রী আমদানিকারক ও সরবরাহকারী সমিতির সহ-সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ডলার সংকটের কারণে আমরা এলসি খুলতে পারছি না।"
এদিকে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাকিম আলী টিবিএসকে বলেন, "আমরা যদি পর্যটন শিল্পের বিকাশ চাই, তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলোর নীতি অনুসরণ করতে পারি।"
মদ আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না।"
দেশীয় মাংস নিয়ে অসন্তুষ্ট হোটেল ব্যবসায়ীরা
স্থানীয় গবাদি পশু খামারিদের রক্ষায় সরকার ভারত থেকে হিমায়িত মাংস, বিশেষ করে মহিষের মাংস আমদানি বন্ধ করায় দেশীয় উৎস থেকে মাংস ব্যবহার করতে হচ্ছে হোটেলগুলোকে।
আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী, হিমায়িত মহিষের মাংসসহ অন্যান্য প্রাণীর মাংস আমদানির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি নিতে হয়।
গুলশানের একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থাপক বলেন, "সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে অস্ট্রেলিয়ান গরুর মাংস আমদানি বন্ধ রয়েছে, যার ফলে স্থানীয় গরুর মাংসের দাম বেড়েছে।"
"এসব কারণে বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশকে অনাকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে দেখতে পারে। আমাদের কাছে এসব আকর্ষণীয় আইটেমের বেশ অভাব রয়েছে এবং এক্ষেত্রে পণ্যের উচ্চ মূল্যও নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। শেষমেশ, এটি আসলে রেপুটেশনের বিষয়," বলেন তিনি।
তারকা হোটেলের কাঙ্ক্ষিত মান বজায় রাখার জন্য স্থানীয় মাংস যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে পাঁচ তারকা প্রতিষ্ঠান ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের নির্বাহী পরিচালক শহীদ হামিদ টিবিএসকে বলেন, "সরকার যেহেতু আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না, আমাদের স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ খাবার দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে।"