ঢাকার ‘সবচেয়ে খারাপ’ কলেজে একদিন
ঢাকা শহরে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য কোনো উন্মুক্ত মাঠ নেই বললেই চলে। তাই ঢাকা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তুলনামূলক বিশাল উন্মুক্ত মাঠ দেখলে এ শহরের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি হবে।
২০১৫ সালে কলেজ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। দুটি দোতলা ভবনসহ প্রায় আট কাঠার জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিজ্ঞাপনী সাইন বোর্ডে বলছে, অন্টারিও সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকা অক্সফোর্ড। আর স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিকক্ষের সুবিধা পায়।
শিক্ষার্থী টানার জন্য উপরে উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধাগুলোই যথেষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু ঢাকা অক্সফোর্ডের 'শিক্ষার্থী' কম হওয়ার কারণ সম্ভবত এই—একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম যে মান থাকা দরকার, তা এর নেই।
২০২২ সালে ঢাকা অক্সফোর্ডের বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ থেকে ২৭ জন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিল। পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র তিনজন। তাদের কেউই পাশ করেনি।
ঢাকা অক্সফোর্ডের স্কুল শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭০ জন, আর কলেজে এখন ৩০ জন শিক্ষার্থী আছে যারা ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় বসবে।
আমরা যখন গেলাম, তখন জলপাই-সবুজ রঙের শার্ট, কাঁধে লাল ব্যাজ ও কালো ট্রাউজার পরা কয়েকজন স্কুল শিক্ষার্থীকে পেয়েছি। কিন্তু কলেজের কোনো ছাত্র দেখিনি। তাদের শ্রেণিকক্ষেও তালা মারা ছিল।
একজন অভিভাবক তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানকে বাড়ি নিতে এসেছিলেন ঢাকা অক্সফোর্ড ক্যাম্পাস থেকে। আমরা তার সঙ্গে কথা বললাম।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই অভিভাবক বলেন, 'বেশিরভাগ সময় আমার স্ত্রীই আমাদের ছেলেকে নিয়ে আসে। তাই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। এখন বুঝতে পেরেছি এটা ভালো স্কুল না। আমি শিগগিরই আমার ছেলেকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাব।'
দোতলায় একজন তরুণীর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ান। কলেজের বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে পারলেন না।
তাহলে কলেজের শিক্ষকদের পাব কোথায়? ওই তরুণী শিক্ষক আমাদের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিলেন।
অনেক চেষ্টার পর অবশেষে অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দীন মজুমদারকে পাওয়া গেল তার অগোছালো অফিসকক্ষে।
কক্ষের মেঝেতে উত্তরপত্রের স্তূপ—সবই ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার। শাহাবুদ্দীন জানালেন, তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বাংলার প্রধান পরীক্ষক।
মজার বিষয় হলো, তার কক্ষের দেওয়ালে বেশ কয়েকজন নবাগত ও বিশিষ্ট গায়কের পোস্টার লাগানো। কিছু তারকার কাছ থেকে ক্রেস্ট নিচ্ছেন শাহাবুদ্দীন, এমন কয়েকটি ফ্রেমবন্দি ছবিও আছে। একটা শোকেসে টেপ ও সিডি ডিস্কের সংগ্রহ সাজিয়ে রাখা।
শাহাবুদ্দীন দাবি করলেন, 'আমি একজন গীতিকার এবং সুরকার। রুনা লায়লা ছাড়া নামীদামি সব শিল্পীই আমার লেখা গান গেয়েছেন। বর্তমানে সরকারি অনুষ্ঠানে বাজানো প্রায় সব প্রচলিত গানই আমার সুর করা।' শাহাবুদ্দীন আরও জানালেন, তিনি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরামের অত্যন্ত সক্রিয় সদস্যও বটে।
স্পষ্টতই নিজের খ্যাতির বিষয়ে রং চড়িয়ে বলছিলেন তিনি।
যে প্রতিষ্ঠানে তিনি শীর্ষ প্রশাসক হিসেবে কর্মরত আছেন, সেই ঢাকা অক্সফোর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলাম তার কাছে।
শাহাবুদ্দীন বললেন, '২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত ঢাকা অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীদের পাশের হার ৭০ শতাংশ ছিল। ২০২২ সালে কলেজ নিজেই ২৭ জন শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষার ফি পরিশোধ করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রবেশপত্র নিয়েছিল মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী। বাকিদের বাড়িতে গিয়েও আমরা ওদের পাইনি। দুর্ভাগ্যবশত, পরীক্ষায় বসা তিনজন ছাত্রই সব বিষয়ে ফেল করে।'
অধ্যক্ষের ধারণা, 'নিখোঁজ' ছাত্রদের মধ্যে অন্তত আটজন সৌদি আরব ও দুবাইয়ে চলে গেছে।
আমরা ২৭ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য, যেমন সেলফোন নম্বর চাইলাম। এর আগে শাহাবুদ্দীন বলেছিলেন, এইচএসসি পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ব্যাংকের কাগজপত্রের বিষয়েও জানতে চাইলাম আমরা। কারণ শাহাবুদ্দীন দাবি করেছিলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের পক্ষে সমস্ত বকেয়া ও ফি পরিশোধ করেছে।
শাহাবুদ্দীন উত্তর দিলেন, 'আমার কাছে কোনো রেকর্ড নেই। এগুলো হানিফ স্যারের কাছে পেতে পারেন।'
এসএম আবু হানিফ ঢাকা অক্সফোর্ডের ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। শাহাবুদ্দিনের তথ্যমতে, রমনা থানা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হানিফ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিয়ে থাকেন।
আমরা ফোনে হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সংবাদপত্র থেকে ফোন পেয়ে দৃশ্যতই বিরক্ত ছিলেন তিনি। হানিফ জানালেন, গত দুই মাস ধরে তিনি অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিতে আছেন।
'প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলুন। তিনি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবেন,' এই বলে হানিফ ফোন কেটে দেন।
আমরা যেদিন অধ্যক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলি, সেদিন শাহাবুদ্দীনকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিল, কারণ তিনি সবে দৈনিক সংবাদ সমাচার নামে একটি পত্রিকার 'সম্পাদকের' পদ পেয়েছেন। শিগগিরই তার নতুন চাকরি শুরু করার কথা।
শাহাবুদ্দীন গর্ব করে বললেন, 'আবেদনের দেড় মাসের মধ্যেই অনুমোদন এসেছে।'
শাহাবুদ্দীন জানালেন, তিনিও সাংবাদিক। 'দুই দশকের বেশি সময় আমি দৈনিক প্রাইম, বাংলা বাজার, বিনোদন ধারা, আনন্দ ভুবনসহ অনেক সংবাদমাধ্যমের প্রধান হিসেবে কাজ করেছি।'
কলেজের অধ্যক্ষ, মিউজিশিয়ান ও সাংবাদিক হিসেবে সময় মেলান কী করে? আমরা প্রশ্ন করলাম।
তিনি হেসে উত্তর দিলেন, 'আফতাব নগরে ঢাকা বাংলা কলেজ নামে একটা নতুন প্রতিষ্ঠান খুলছি। এটা ইতিমধ্যে শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন পেয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়ে গেছে। শিগগিরই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।'
ঢাকা অক্সফোর্ড কলেজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিলাম আমরা। জানতে চাইলাম, ২০২৩ সালের এইএসসি পরীক্ষায় আপনার ইন্টারমিডিয়েটের ৩০ জন শিক্ষার্থী পাশ করতে পারবে?
অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দীন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিলেন, 'পারবে না কেন? [আমাদের] বাজে ভাবমূর্তি দূর হবে। ২০২২ সালের ব্যর্থতাটা দুর্ঘটনা ছিল। মিডিয়া বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করছে।'
বেশ কিছু প্রশ্ন করলাম আমরা। যেমন: ছাত্রদের পড়াবে কে? কারণ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একটি ওয়েব পেজ বলছে, ঢাকা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল কলেজে শাহাবুদ্দীন ও হানিফসহ মাত্র চারজন শিক্ষক আছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অন্য শিক্ষকদেরও ইমেল করেছিল, কিন্তু তারা কেউ উত্তর দেননি।
শাহাবুদ্দীন বললেন, 'কী হাস্যকর! বোর্ড হয়তো আমাদের তথ্য আপডেট করেনি। কয়েকজন খণ্ডকালীন শিক্ষকসহ আমাদের মোট ২৪ জন শিক্ষক আছেন।'
এই শিক্ষকরা কোথায় গেলেন? আপনার কলেজের শিক্ষার্থীরা কোথায়? উত্তরে শাহাবুদ্দীন বললেন, 'সংস্কার কাজের জন্য সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছি।'
আমরা অবশ্য ঢাকা অক্সফোর্ডের নোটিশ বোর্ডে কোনো ছুটির ঘোষণা পাইনি।